বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত কুয়াকাটা—একটি স্বপ্নময় সমুদ্রসৈকত, যেখানে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত উপভোগ করা যায়। দেশের একমাত্র সৈকত হিসেবে কুয়াকাটার এই বৈশিষ্ট্য তাকে দিয়েছে ‘সানরাইজ অ্যান্ড সানসেট পয়েন্ট’ খ্যাতি, যা এশিয়ার পর্যটন মানচিত্রে এক বিশেষ অবস্থান এনে দিয়েছে।
ইতিহাসের পাতা থেকে: কুয়া খুঁড়ে কুয়াকাটার শুরু
‘কুয়াকাটা’ নামের উৎপত্তি ১৮ শতকে। রাখাইন সম্প্রদায়ের মানুষ বার্মা (বর্তমান মিয়ানমার) থেকে বিতাড়িত হয়ে এই অঞ্চলে বসতি গড়ার সময় খাবার পানির অভাবে তারা একটি কুয়া খনন করে। সেই কুয়া থেকেই এলাকাটির নাম হয় “কুয়াকাটা”। আজও সেই ঐতিহাসিক কুয়ার অবস্থান পর্যটকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ রূপ
কুয়াকাটা শুধুই সমুদ্র নয়, এটি প্রকৃতির এক জীবন্ত চিত্রপট—
বিশাল ঝাউবন, লবণাক্ত বালিয়াড়ি, নারিকেল গাছের সারি
শুটকি পল্লীর কর্মমুখর দৃশ্য
রাখাইন পল্লীর সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য
গঙ্গামতির জঙ্গল, তিন নদীর মোহনা, লেবুর চর
সবকিছু মিলিয়ে কুয়াকাটা হয়ে উঠেছে নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পর্যটন গন্তব্য।
পর্যটনের নতুন সংযোজন: চর বিজয়
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে বঙ্গোপসাগরের তীরে জেগে ওঠা একটি চর পর্যটন মানচিত্রে নতুন সংযোজন হিসেবে উঠে আসে। স্থানীয়ভাবে পরিচিত ছিল ‘হাইরের চর’ নামে, তবে বিজয়ের মাসে আবিষ্কৃত হওয়ায় এর নামকরণ করা হয় ‘চর বিজয়’।
চর বিজয়ের বৈশিষ্ট্য:
হাজার হাজার লাল কাঁকড়ার অবাধ বিচরণ
ফাঁকা নির্জনতা, গর্জনহীন নীল সাগর আর আকাশের মিতালি
পরিযায়ী পাখির অভয়াশ্রম
গঙ্গামতির দক্ষিণে জেগে ওঠা এক নীরব স্বর্গ
বর্ষায় কিছুটা ডুবে থাকলেও শীত মৌসুমে চর বিজয় পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে। বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে এখানে ইতোমধ্যে ঝাউ ও কেওড়াসহ নানা গাছ লাগানো হয়েছে।
পর্যটন উদ্যোক্তাদের ভাবনা ও পরিকল্পনা
চর বিজয়কে ঘিরে স্থানীয় ট্যুর অপারেটররা নতুন ভ্রমণপথ তৈরি করেছেন।
ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার সভাপতি রুমান ইমতিয়াজ তুষার বলেন,
> “চর বিজয় একটি অপার সম্ভাবনার দ্বীপ। পরিবেশ সংরক্ষণ সাপেক্ষে এটি দেশের অন্যতম প্রধান ইকো-ট্যুরিজম সাইট হতে পারে।”
জল তরণী ট্যুরিজম, আন্ধারমানিক ট্যুরিজমসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান চর বিজয়ে নৌবিহার, সানরাইজ ট্যুর ও জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করেছে।
সতর্কতার বার্তা: প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় সচেতনতা জরুরি
প্রকৃতি আমাদের উপহার, কিন্তু এই উপহার ধরে রাখতে হলে প্রয়োজন সচেতনতা।
পর্যটকদের যথাসম্ভব প্লাস্টিক বর্জন এড়িয়ে চলা, গাছের ক্ষতি না করা, পাখি বা প্রাণীদের বিরক্ত না করার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।
গ্লোবাল এভিয়েশন অ্যান্ড টুরিজম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশনের ভ্রমণ উৎসব
চর বিজয়ের এই সম্ভাবনাকে আরও সামনে আনতে গ্লোবাল এভিয়েশন অ্যান্ড টুরিজম জার্নালিস্ট এসোসিয়েশন ১৪–১৬ জুলাই ২০২৫ কুয়াকাটায় আয়োজন করছে তিন দিনব্যাপী পর্যটন উৎসব।
আয়োজনে থাকছে:
মতবিনিময় সভা, কবিতা পাঠ ও চা-চক্র
“পর্যটন শিল্পের উন্নয়নে কুয়াকাটার সম্ভাবনা” শীর্ষক আলোচনা
তথ্যচিত্র প্রদর্শনী ও ট্যুরিজম আইকনিক অ্যাওয়ার্ড
চর বিজয়, গঙ্গামতির জঙ্গল, লাল কাঁকড়ার চর ভ্রমণ
সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত অবলোকন
রাখাইন পল্লী, বৌদ্ধ বিহার এবং ঝাউবন পরিদর্শন
কুয়াকাটা কেবল একটি সমুদ্রসৈকত নয়, এটি বাংলাদেশের প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্ভাবনার আধার। চর বিজয়ের মতো নতুন সংযোজন কুয়াকাটাকে করে তুলেছে আরও বৈচিত্র্যময় ও গৌরবময়।
আসুন, আমরা প্রকৃতিকে ভালোবাসি,
ভ্রমণে যাই, কিন্তু পরিবেশকে রক্ষা করি।