এক সময় ‘শিক্ষার শহর’ নামে পরিচিত ময়মনসিংহ এখন একটি বিভাগীয়, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, সংস্কৃতি, কৃষি ও প্রযুক্তিতে এই অঞ্চলের সম্ভাবনা ও অবদান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঐতিহাসিক এবং ভৌগোলিক বাস্তবতায়, ময়মনসিংহে একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন, আধুনিক ও গবেষণাভিত্তিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এখন কেবল চাহিদা নয়, বরং সময়োপযোগী জাতীয় কর্তব্য।
ময়মনসিংহের বর্তমান উচ্চশিক্ষা পরিকাঠামোঃ
ময়মনসিংহে বহু ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যেগুলোর অবদান জাতীয় পর্যায়ে স্বীকৃত। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যঃ
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (BAU)- দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, যা কৃষি ও জীববিজ্ঞানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষণার কেন্দ্র।
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ- দেশের অন্যতম পুরাতন ও নামকরা সরকারি মেডিকেল কলেজ।
CBMCB (Community-Based Medical College, Bangladesh)- একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ, যা এই অঞ্চলে বেসরকারি স্বাস্থ্যশিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ।
ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজ- সরকারি নার্সিং শিক্ষায় ডিপ্লোমা ও গ্র্যাজুয়েট লেভেলে শিক্ষার সুব্যবস্থা করছে।
ময়মনসিংহ গার্লস ক্যাডেট কলেজ- একটি অত্যন্ত মানসম্পন্ন আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যা নারী নেতৃত্ব ও সুশাসনের ভিত্তি গড়ে তুলছে।
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়- সৃজনশীলতা ও মানবিক শিক্ষায় নিরলস ভূমিকা রাখা একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়।
সরকারি ময়মনসিংহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ- প্রকৌশল শিক্ষার আধুনিক সুবিধা নিয়ে পরিচালিত একটি সরকারি প্রকৌশল কলেজ।
NAPE (National Academy for Primary Education)- প্রাথমিক শিক্ষায় নীতি নির্ধারণ ও শিক্ষক প্রশিক্ষণের জাতীয় স্তরের প্রতিষ্ঠান, যার সদর দপ্তর ময়মনসিংহেই অবস্থিত।
এইসব প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ময়মনসিংহে বহু স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যা একটি বড় শিক্ষার্থীবহুল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এখনও এই নগরীতে নেই কোনো পূর্ণাঙ্গ বেসরকারি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বা সৃজনশীল শিল্পকলাভিত্তিক আর্টস ও মিডিয়া ফ্যাকাল্টির বিশ্ববিদ্যালয়।
শহরের পরিবর্তিত ভূচিত্র ও চাহিদাঃ
বর্তমানে ময়মনসিংহ একটি করপোরেট ও আবাসিক শহরে রূপ নিচ্ছে। এখানে রয়েছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ব্যাংক, করপোরেট অফিস, বীমা কোম্পানি, স্বাস্থ্য ক্লিনিক, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এবং বহুল মানুষের স্থায়ী ও অস্থায়ী বসবাস। শহরের ভেতরে ও বাইরে থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ প্রবেশ করে, শিক্ষা, চিকিৎসা বা পেশাগত প্রয়োজনে।
এই বাস্তবতায় উচ্চশিক্ষার একটি আধুনিক, প্রযুক্তি ও শিল্পকলা-ভিত্তিক বিকল্প শিক্ষাকেন্দ্রের অনুপস্থিতি বিস্ময়কর। স্থানীয় শিক্ষার্থীরা আজ ঢাকামুখী- শুধু একটি বিজ্ঞানভিত্তিক, আধুনিক এবং সৃজনশীল উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকার কারণে।
নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের কাঠামোগত প্রস্তাবঃ
১. বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফ্যাকাল্টিঃ
কম্পিউটার বিজ্ঞান, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ডেটা সায়েন্স, বায়োটেকনোলজি, পরিবেশ প্রকৌশল, কৃষি প্রযুক্তি- এসব বিষয়ের সমন্বয়ে একবিংশ শতাব্দির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় উপযুক্ত শিক্ষা।
২. সৃজনশীল শিল্প ও মিডিয়া ফ্যাকাল্টিঃ
গ্রাফিক ডিজাইন, ভিজ্যুয়াল আর্টস, সিনেমাটোগ্রাফি, সংগীত, নাট্যকলা, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা- এসব বিষয়ে শিক্ষার জন্য একটি পূর্ণাঙ্গ ‘School of Arts and Creativity’ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে, যা জাতীয় সংস্কৃতি ও গণতন্ত্রচর্চার বিস্তারেও অবদান রাখবে।
৩. পূর্বাভাস ও ভবিষ্যৎ দক্ষতা কেন্দ্র (Foresight Lab)
বিশ্বের শীর্ষ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মতো এখানে প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে একটি ‘ফিউচার স্কিলস ইনস্টিটিউট’, যেখানে শিক্ষার্থীরা ভবিষ্যৎ শ্রমবাজারের জন্য প্রস্তুত হতে পারবে।
নীতি সহায়তা ও বিনিয়োগের সুযোগঃ
এই প্রকল্প বাস্তবায়নে রয়েছে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ-
সরকারি অনুমোদনঃ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদন এবং স্থানীয় প্রশাসনের নীতিগত সহায়তা।
স্থানীয় ও প্রবাসী বিনিয়োগঃ ময়মনসিংহের অনেক প্রবাসী নাগরিক শিক্ষা-উদ্যোগে অংশ নিতে আগ্রহী; একটি নন-প্রফিট ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।
শিক্ষানুরাগী উদ্যোক্তা ও একাডেমিশিয়ানদের সম্পৃক্ততাঃ যারা বাণিজ্যিক নয়, গুণগত উচ্চশিক্ষা বিস্তারে আগ্রহী
উপসংহারঃ
ময়মনসিংহের অতীত আমাদের গর্ব, বর্তমান আমাদের দায়, আর ভবিষ্যৎ আমাদের পরিকল্পনা দাবি করে। এখানে একটি আন্তর্জাতিকমানের বেসরকারি বিজ্ঞান ও সৃজনশীলতা বিশ্ববিদ্যালয় শুধু উচ্চশিক্ষার বিকল্প নয়, বরং একটি নতুন জ্ঞাননগরী গড়ার সূচনা।
এই মুহূর্তে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগের—যেখানে স্থানীয় সরকার, প্রশাসন, সমাজ, প্রবাসী নাগরিক ও শিক্ষানুরাগীরা এক হয়ে ময়মনসিংহকে আবার শিক্ষা-আলোয় আলোকিত করে তুলবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ভূমিতে পাবে প্রযুক্তি ও শিল্পে ভারসাম্যপূর্ণ, নৈতিক ও মানবিক একটি শিক্ষাব্যবস্থা।