১১:৪০ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৭ নভেম্বর ২০২৫, ২৩ কার্তিক ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
সোমা ঘোষ মণিকা :

শারদীয়ার মাহাত্ম্য ও কুমারী পূজা

  • প্রকাশিত ০১:১২:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫
  • ১১১ বার দেখা হয়েছে

বনে বনে আজ লেগেছে দোল, শারদ-প্রভাতে শিশিরের হিল্লোল।
সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে আকাশে পেজা তুলো ছড়াতে ছড়াতে ডাক, ঢোল বাজিয়ে হাজির হয় শারদীয়া ঊমা।”

শরৎকালে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম আরাধ্যা দেবী দুর্গা। কথিত আছে যে, দেবী দুর্গা দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন। আবার তিনি ভক্তদের দুর্গম বা দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন, তাই তাঁর নাম দুর্গা। দেবী দুর্গা মাতৃরূপে পূজিত হয়ে থাকেন।

সাধারণত শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। সেই থেকে শরৎকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজাকে শারদীয়া দুর্গাপূজা বা অকালবোধন বলা হয়ে থাকে। মহালয়া ও শ্রীপঞ্চমী থেকে মহাবিজয়া দশমী পর্যন্ত দেবীর আরাধনা চলে।

শ্রীপঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী

শ্রীপঞ্চমী: দেবীর আঁচল ধীরে ধীরে মর্ত্যে স্পর্শ করে। এটি পূজার সূচনা ধাপ।

ষষ্ঠী: দেবীর বোধন, অধিবাস ও আমন্ত্রণ সম্পন্ন হয়। মা দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।

সপ্তমী: কল্পারম্ভ ও নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।

অষ্টমী: মহাপূজার শ্রেষ্ঠ দিন। অঞ্জলি, আরতি ও স্যান্ডি পূজা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কুমারী পূজার আয়োজনও থাকে।

নবমী: চণ্ডীপাঠ, হোম ও দেবীর পূর্ণ আরাধনা করা হয়। দেবীকে তুষ্ট করার দিন।

বিজয়া দশমী: দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মর্ত্যলোক থেকে দেবীর স্বর্গারোহণ হয়।

কুমারী পূজা:

সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
কুমারী পূজা হলো হিন্দুধর্মের এক পবিত্র আচার, যেখানে এক বা একাধিক কুমারী (অজাতপুষ্পা) বালিকার মধ্যে দেবী দুর্গার রূপ দেখে তাকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে এই পূজা বিশেষত নবরাত্রির অষ্টমী ও নবমীর দিন অনুষ্ঠিত হয়। এটি নারীশক্তিকে সম্মান জানানোর এক প্রতীকী প্রথা।

মূল ধারণা:

দেবী রূপ: কুমারী বালিকাদের মধ্যে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ (নবদুর্গা)-এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

নারীশক্তির উপাসনা: নারীশক্তি ও সৃষ্টিকে সম্মান জানানোর এক মাধ্যম।

শাস্ত্রের উল্লেখ: দেবীপুরাণে ১-১৬ বছর বয়সী কুমারী বালিকাদের পূজা করার নির্দেশ রয়েছে।

পূজার নিয়ম:

১-১৬ বছরের অবিবাহিতা কুমারী বালিকাকে নির্বাচন করা হয়।

অষ্টমী বা নবমী তিথিতে পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

কুমারী বালিকাকে দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা করা হয়।

গুরুত্ব:

নারীকে সম্মান জানানোর বিশেষ প্রথা।

নারীশক্তির প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ ও নারীজাগরণের প্রতীক।

স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা:

১৯০১ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও বেলুড় মঠে নয়জন কুমারীর পূজা করেছিলেন।

কুমারী পূজা দুর্গাপূজার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিচিত।

কুমারী পূজার ইতিহাস:

শাস্ত্রমতে: কোলাসুরকে বধ করার ঘটনায় কুমারী রূপে দেবীর আবির্ভাব।

প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ: মহাভারতে কুমারী পূজার উল্লেখ।

আধুনিক যুগ: স্বামী বিবেকানন্দের প্রচেষ্টায় কাশ্মীরে ১৮৯৮ সালে এবং বেলুড় মঠে ১৯০১ সালে এর সূচনা।

তাৎপর্য:

কুমারী কন্যাকে জীবন্ত দেবী প্রতিমা হিসেবে পূজা।

নারীর শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য।
মন্ত্র ও ব্যবহার:

হৃদয় মন্ত্র: ঐং হ্রীং শ্রীং ক্রীং হেসৌঃ কুলকুমারিকে হৃদয়ায় নমঃ

শির মন্ত্র: হৈং বৈং হ্রৈং শ্রীং হ্রীং ঐং স্বাহা শিরসে স্বাহা

শিখা মন্ত্র: ঐং হ্রীং শিখায়ৈ বষট্ নমঃ।

শারদীয়া দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল। মহালয়া থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিটি দিনই মা দুর্গার প্রেম, ভক্তি ও করুণার আবহ সৃষ্টি করে।

কুমারী পূজা সেই ধারার এক অনন্য প্রকাশ, যেখানে কন্যা শিশুদের মধ্যে দেবী দুর্গার রূপে নারীশক্তিকে সম্মান জানানো হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মা, কন্যা ও নারী—তিনিই শক্তির, সৌন্দর্যের ও করুণার প্রতীক।

তাই শারদীয়া পূজা ও কুমারী পূজা শুধুই আচার নয়, বরং জীবন্ত শক্তি ও মানবিক মূল্যবোধকে উদযাপনের এক মহৎ প্রতীক।

Tag :
জনপ্রিয়

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আশ্বাসে অনশন ভঙ্গ ১৮ তম নিবন্ধন প্রত্যাশীরা

সোমা ঘোষ মণিকা :

শারদীয়ার মাহাত্ম্য ও কুমারী পূজা

প্রকাশিত ০১:১২:১৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫

বনে বনে আজ লেগেছে দোল, শারদ-প্রভাতে শিশিরের হিল্লোল।
সাদা মেঘের ভেলায় ভেসে আকাশে পেজা তুলো ছড়াতে ছড়াতে ডাক, ঢোল বাজিয়ে হাজির হয় শারদীয়া ঊমা।”

শরৎকালে অনুষ্ঠিত শারদীয়া দুর্গাপূজা হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব। সেই প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি হিন্দুদের অন্যতম আরাধ্যা দেবী দুর্গা। কথিত আছে যে, দেবী দুর্গা দুর্গম নামক অসুরকে বধ করেছিলেন। আবার তিনি ভক্তদের দুর্গম বা দুর্গতি থেকে রক্ষা করেন, তাই তাঁর নাম দুর্গা। দেবী দুর্গা মাতৃরূপে পূজিত হয়ে থাকেন।

সাধারণত শরৎকালে শ্রীরামচন্দ্র দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। সেই থেকে শরৎকালে অনুষ্ঠিত দুর্গাপূজাকে শারদীয়া দুর্গাপূজা বা অকালবোধন বলা হয়ে থাকে। মহালয়া ও শ্রীপঞ্চমী থেকে মহাবিজয়া দশমী পর্যন্ত দেবীর আরাধনা চলে।

শ্রীপঞ্চমী থেকে বিজয়া দশমী

শ্রীপঞ্চমী: দেবীর আঁচল ধীরে ধীরে মর্ত্যে স্পর্শ করে। এটি পূজার সূচনা ধাপ।

ষষ্ঠী: দেবীর বোধন, অধিবাস ও আমন্ত্রণ সম্পন্ন হয়। মা দুর্গার আবির্ভাব ঘটে।

সপ্তমী: কল্পারম্ভ ও নবপত্রিকা প্রবেশের মাধ্যমে পূজার মূল অনুষ্ঠান শুরু হয়।

অষ্টমী: মহাপূজার শ্রেষ্ঠ দিন। অঞ্জলি, আরতি ও স্যান্ডি পূজা হয়। অনেক ক্ষেত্রে কুমারী পূজার আয়োজনও থাকে।

নবমী: চণ্ডীপাঠ, হোম ও দেবীর পূর্ণ আরাধনা করা হয়। দেবীকে তুষ্ট করার দিন।

বিজয়া দশমী: দেবী দুর্গাকে বিদায় জানিয়ে জলাঞ্জলি দেওয়া হয়। বিসর্জনের মধ্য দিয়ে মর্ত্যলোক থেকে দেবীর স্বর্গারোহণ হয়।

কুমারী পূজা:

সংক্ষিপ্ত পরিচয়:
কুমারী পূজা হলো হিন্দুধর্মের এক পবিত্র আচার, যেখানে এক বা একাধিক কুমারী (অজাতপুষ্পা) বালিকার মধ্যে দেবী দুর্গার রূপ দেখে তাকে মাতৃরূপে পূজা করা হয়। দুর্গাপূজার অঙ্গ হিসেবে এই পূজা বিশেষত নবরাত্রির অষ্টমী ও নবমীর দিন অনুষ্ঠিত হয়। এটি নারীশক্তিকে সম্মান জানানোর এক প্রতীকী প্রথা।

মূল ধারণা:

দেবী রূপ: কুমারী বালিকাদের মধ্যে দেবী দুর্গার নয়টি রূপ (নবদুর্গা)-এর প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।

নারীশক্তির উপাসনা: নারীশক্তি ও সৃষ্টিকে সম্মান জানানোর এক মাধ্যম।

শাস্ত্রের উল্লেখ: দেবীপুরাণে ১-১৬ বছর বয়সী কুমারী বালিকাদের পূজা করার নির্দেশ রয়েছে।

পূজার নিয়ম:

১-১৬ বছরের অবিবাহিতা কুমারী বালিকাকে নির্বাচন করা হয়।

অষ্টমী বা নবমী তিথিতে পূজা অনুষ্ঠিত হয়।

কুমারী বালিকাকে দেবীর আসনে বসিয়ে পূজা করা হয়।

গুরুত্ব:

নারীকে সম্মান জানানোর বিশেষ প্রথা।

নারীশক্তির প্রতি শ্রদ্ধার প্রকাশ ও নারীজাগরণের প্রতীক।

স্বামী বিবেকানন্দের ভূমিকা:

১৯০১ সালে রামকৃষ্ণ মঠ ও বেলুড় মঠে নয়জন কুমারীর পূজা করেছিলেন।

কুমারী পূজা দুর্গাপূজার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হিসেবে পরিচিত।

কুমারী পূজার ইতিহাস:

শাস্ত্রমতে: কোলাসুরকে বধ করার ঘটনায় কুমারী রূপে দেবীর আবির্ভাব।

প্রাচীন গ্রন্থে উল্লেখ: মহাভারতে কুমারী পূজার উল্লেখ।

আধুনিক যুগ: স্বামী বিবেকানন্দের প্রচেষ্টায় কাশ্মীরে ১৮৯৮ সালে এবং বেলুড় মঠে ১৯০১ সালে এর সূচনা।

তাৎপর্য:

কুমারী কন্যাকে জীবন্ত দেবী প্রতিমা হিসেবে পূজা।

নারীর শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধির উদ্দেশ্য।
মন্ত্র ও ব্যবহার:

হৃদয় মন্ত্র: ঐং হ্রীং শ্রীং ক্রীং হেসৌঃ কুলকুমারিকে হৃদয়ায় নমঃ

শির মন্ত্র: হৈং বৈং হ্রৈং শ্রীং হ্রীং ঐং স্বাহা শিরসে স্বাহা

শিখা মন্ত্র: ঐং হ্রীং শিখায়ৈ বষট্ নমঃ।

শারদীয়া দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, এটি বাঙালির সংস্কৃতি, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার মিলনস্থল। মহালয়া থেকে বিজয়া দশমী পর্যন্ত প্রতিটি দিনই মা দুর্গার প্রেম, ভক্তি ও করুণার আবহ সৃষ্টি করে।

কুমারী পূজা সেই ধারার এক অনন্য প্রকাশ, যেখানে কন্যা শিশুদের মধ্যে দেবী দুর্গার রূপে নারীশক্তিকে সম্মান জানানো হয়। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে, মা, কন্যা ও নারী—তিনিই শক্তির, সৌন্দর্যের ও করুণার প্রতীক।

তাই শারদীয়া পূজা ও কুমারী পূজা শুধুই আচার নয়, বরং জীবন্ত শক্তি ও মানবিক মূল্যবোধকে উদযাপনের এক মহৎ প্রতীক।