০২:২২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫, ৯ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
আহমেদ আবু জাফর :

রাজনৈতিক দলে সাংবাদিকদের ভূমিকা: দলীয় পদ নাকি পেশাদারিত্ব

  • প্রকাশিত ০২:৩৭:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৬ বার দেখা হয়েছে

রাজনৈতিক দল গুলোতে সাংবাদিকদের সরাসরি পদ না দিয়ে পাবলিক রিলেশন অফিসার -পিআরও অথবা মিডিয়া সেলের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। এতে করে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের দোসর কিংবা তেসর হবার দায়ভার থাকবেনা। মিথ্যা, হয়রানীমূলক ভাবে হামলা মামলার শিকার হতে হবে না। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা শেষে পালিয়ে বেড়াতে হবেনা। সাংবাদিকরা পিআরও হিসেবে শুধু পেশাদারিত্ব পালন করবে। দল গুলো কেন্দ্র থেকে জেলা -উপজেলা শাখার চাহিদা এবং সামথ্যমত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ সকল সাংবাদিক নিয়োগ দেবেন।

অন্যদিকে দল থেকে নিযুক্ত সাংবাদিকরা মাসিক বেতন বা সম্মানী ভাতা পেতে পারেন। তাদের কাজ থাকবে শুধু মাত্র মিডিয়া গুলোতে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো। এতে দলগুলোর সংবাদ প্রচার প্রকাশে গুরুত্ব বাড়বে। বিষয় টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকরা ভেবে দেখতে পারেন।

আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাংবাদিকদের সম্পৃক্ততা বহুদিন ধরেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিশেষত, কোনো সাংবাদিক যখন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে পদ গ্রহণ করেন, তখন তার পেশাগত নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করেও কেউ যদি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের কোনো পদে অধিষ্ঠিত হন, তাহলে সেটি সাংবাদিকতার মৌল নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।

এই বাস্তবতায়, একটি বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রস্তাবনা হচ্ছে—রাজনৈতিক দলগুলো সাংবাদিকদের পদ না দিয়ে ‘পাবলিক রিলেশন অফিসার (পিআরও)’ বা ‘মিডিয়া সেল’-এর দায়িত্বে নিয়োগ দিতে পারে। এতে করে সাংবাদিকরা মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের দ্বারা হয়রানি কিংবা হামলা-মামলা-হয়রানীর দায়ভার থেকেও মুক্ত থাকবেন এবং একইসাথে দলের প্রচার কার্যক্রম পেশাদারভাবে পরিচালিত হবে। ফলে সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করছি।

বিশ্বজুড়েই রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট’, ‘পিআর কনসালটেন্ট’ কিংবা ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজার’ পদে দায়িত্বপ্রাপ্তরা থাকেন যারা দলীয় মতবাদের প্রচার ও জনসংযোগের কাজ করেন। বাংলাদেশেও যদি এই ধারা অনুসরণ করা হয়, তবে সাংবাদিকদের প্রতি জনআস্থা বাড়বে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সংবাদ প্রচারেও শৃঙ্খলা আসবে। এতে রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার সাংবাদিকদের মাঝে সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এই প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত সাংবাদিকরা মাসিক সম্মানী বা নির্ধারিত ভাতা পেতে পারেন। তাদের দায়িত্ব হবে শুধুমাত্র মিডিয়াগুলোতে নির্ধারিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো, দলীয় কর্মসূচি কাভার করার জন্য মিডিয়াকে সহায়তা করা এবং প্রয়োজনে দলের বক্তব্য স্পষ্ট করে উপস্থাপন করা। এখানে তারা দলের পক্ষে কাজ করলেও তা হবে একটি চুক্তিভিত্তিক পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে—যার ফলে তাদের সাংবাদিকতা নীতি বা নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

সবচেয়ে বড় কথা, এতে সাংবাদিকরা কোনো রাজনৈতিক দলের দাস হয়ে পড়বেন না, বরং পেশার প্রতি সম্মান রেখে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। একইসঙ্গে দলগুলোও একটি সুশৃঙ্খল ও দক্ষ মিডিয়া কাঠামোর আওতায় আসবে।

আমরা দেখতে পেয়েছি, এ সরকার আমলে অগণিত মিডিয়া এবং সাংবাদিককে সরাসরি রাজনৈতিক দলের দোসর সাজিয়ে বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। মূলত: সাংবাদিকতা কোন অনুঘটক পেশা ছিলনা, যা ঘটবে তারা তা-ই লিখবে। কিন্তু নানা দলীয় সরকার আমলে নষ্ট কালচারের কারণে পেশাটি এখন অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা পেশায় শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল মানুষেরা আসবেনা। ফলে পেশাটি মেধাশূন্য হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। তাই এখনই সময় রাষ্ট্র যন্ত্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এই পেশাটি রক্ষার জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেন।

এই প্রস্তাবনাটি রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারক ও মিডিয়া সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত বলে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম মনে করে। বিষয়টি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিক সংগঠন সমূহের নেতৃবৃন্দ ভাবতে পারেন।

আমরা এ-ও লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন তাদের দলে সদস্য বাড়াতে সরকারি দপ্তরে চাকুরীজীবি লোকজনকেও দলে বেড়ান, যা সমীচীন নহে। আমরা মনে করি সরকারি চাকরিজীবী, আইনজীবী, মসজিদের ইমাম, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকদের জন্য সরাসরি রাজনীতি নয়। কিন্তু এরা নিয়মিত রাজনীতি করায় সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর চোখে গণমাধ্যম তখনই সাহসী, যখন তারা শত্রু। আর প্রশংসা কুড়োলে সেটা ধরে নেওয়া হয় তেলবাজি। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই সত্যটি যেন শাশ্বত। দৈনিক প্রথম আলো তার প্রকাশের শুরু থেকেই একাধিক সরকারের রোষানলে পড়েছে। ১৯৯৮ সালে আত্মপ্রকাশের পরপরই আওয়ামী লীগ তার বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপিও একই পথ ধরে। এক-এগারোর সময়ও পত্রিকাটি নিরাপদ থাকেনি। আর ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একটানা ক্ষমতাসীন সরকারের চোখে প্রথম আলো হয়ে ওঠে এক ধরনের ‘বিরোধীদল’। বিজ্ঞাপন বন্ধ, হামলা, এমনকি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল। এমন স্টিমরোলার এখন দেশের বিভিন্ন মিডিয়ার ওপর পড়তে শুরু করছে। তেমনি বিগত সরকার আমলে দৈনিক নয়াদিগন্ত বন্ধ ঘোষণা, ইসলামিক টিভি সহ বর্তমান সরকার ভোরের কাগজের প্রকাশণা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শত শত সাংবাদিক পেশা হারিয়েছেন।

ভয়েস অব আমেরিকার সূত্রমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত প্রথম আলোর বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আরও নতুন শত্রু জন্ম নেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ওঠে—পত্রিকাটি কি দিল্লির বয়ানের প্রতিনিধিত্ব করছে?

এখন আর শুধুমাত্র ট্যাগিং নয়, প্রতিটি রিপোর্টই রাজনৈতিক বয়ানের চশমায় বিশ্লেষিত হচ্ছে। সম্প্রতি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির এক সভা ঘিরে হাসনাত আব্দুল্লাহকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রথম আলো নিয়ে ফের বিতর্কে শুরু হয়। হাসনাতের পাল্টা অভিযোগ—“নিউজটা দিল্লি থেকে পাঠানো।” কালেরকণ্ঠও শিরোনাম করে, “হাসনাতকে নিয়ে মিথ্যাচার: প্রথম আলোর অপসাংবাদিকতা রুখে দেওয়ার আহ্বান।”

এই ঘটনাটি প্রমাণ করে দিয়েছে দেশের সব সংবাদমাধ্যমই এখন রাজনৈতিক বয়ানের ফাঁদে পড়েছে। নিরীহ নিউজও বয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাচাই হচ্ছে। দেশে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির বয়ান বিশ্লেষণে যেভাবে সোচ্চার হয়েছে, তা বিস্ময়কর। কেবল শহরের নয়, গ্রামের মানুষও এখন রাজনৈতিক ভণ্ডামি ও প্রচারের কৌশল সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক সচেতন।

এ বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য বিপদের ঘন্টা বাজছে। দলঘেঁষা সাংবাদিকতা আর দলীয় বয়ান প্রমোট করে এখন আর চলবে না। সাংবাদিক সংগঠনে নেতাদের পা চেটে সুবিধা নেওয়ার যুগও শেষের পথে। কারণ, আজকের নেতারা সংবাদমাধ্যমের মানহীন, দলানুগত সেবাকে এখন বিপজ্জনক মনে করছেন।

সত্যিই, যারা বয়ান তৈরি করে জনগণের চেতনা, নৈতিকতা আর সম্মতির নিয়ন্ত্রক হতে চায়, তাদের জন্য দিন এখন আর আগের মতো নেই। আর যারা সত্য তুলে ধরতে চায়, তাদের জন্য এখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়।
সাংবাদিকতা ও রাজনীতি—এই দুই ভিন্ন পেশা যদি পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে আলাদা রাখা যায়, তবে গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহি, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি সবকিছুই লাভবান হবে বলে মনে করছি।

Tag :
জনপ্রিয়

গোমস্তাপুর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত আনজুম অনন্যার হাতে দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা পত্রিকা উপহার

আহমেদ আবু জাফর :

রাজনৈতিক দলে সাংবাদিকদের ভূমিকা: দলীয় পদ নাকি পেশাদারিত্ব

প্রকাশিত ০২:৩৭:২৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২২ এপ্রিল ২০২৫

রাজনৈতিক দল গুলোতে সাংবাদিকদের সরাসরি পদ না দিয়ে পাবলিক রিলেশন অফিসার -পিআরও অথবা মিডিয়া সেলের দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে। এতে করে সাংবাদিকরা রাজনৈতিক দলের দোসর কিংবা তেসর হবার দায়ভার থাকবেনা। মিথ্যা, হয়রানীমূলক ভাবে হামলা মামলার শিকার হতে হবে না। রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা শেষে পালিয়ে বেড়াতে হবেনা। সাংবাদিকরা পিআরও হিসেবে শুধু পেশাদারিত্ব পালন করবে। দল গুলো কেন্দ্র থেকে জেলা -উপজেলা শাখার চাহিদা এবং সামথ্যমত নির্দিষ্ট সময়ের জন্য এ সকল সাংবাদিক নিয়োগ দেবেন।

অন্যদিকে দল থেকে নিযুক্ত সাংবাদিকরা মাসিক বেতন বা সম্মানী ভাতা পেতে পারেন। তাদের কাজ থাকবে শুধু মাত্র মিডিয়া গুলোতে প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো। এতে দলগুলোর সংবাদ প্রচার প্রকাশে গুরুত্ব বাড়বে। বিষয় টি রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকরা ভেবে দেখতে পারেন।

আমরা লক্ষ্য করেছি, বাংলাদেশের রাজনীতিতে সাংবাদিকদের সম্পৃক্ততা বহুদিন ধরেই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। বিশেষত, কোনো সাংবাদিক যখন সরাসরি কোনো রাজনৈতিক দলে পদ গ্রহণ করেন, তখন তার পেশাগত নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। সংবাদপত্র বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় কাজ করেও কেউ যদি রাজনৈতিক দলের কেন্দ্রীয় বা স্থানীয় পর্যায়ের কোনো পদে অধিষ্ঠিত হন, তাহলে সেটি সাংবাদিকতার মৌল নীতিমালার সাথে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়ে।

এই বাস্তবতায়, একটি বাস্তবসম্মত ও ভারসাম্যপূর্ণ প্রস্তাবনা হচ্ছে—রাজনৈতিক দলগুলো সাংবাদিকদের পদ না দিয়ে ‘পাবলিক রিলেশন অফিসার (পিআরও)’ বা ‘মিডিয়া সেল’-এর দায়িত্বে নিয়োগ দিতে পারে। এতে করে সাংবাদিকরা মাঠ পর্যায়ে রাজনৈতিক দলের দ্বারা হয়রানি কিংবা হামলা-মামলা-হয়রানীর দায়ভার থেকেও মুক্ত থাকবেন এবং একইসাথে দলের প্রচার কার্যক্রম পেশাদারভাবে পরিচালিত হবে। ফলে সাংবাদিকদের ভাবমূর্তি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হবে বলে মনে করছি।

বিশ্বজুড়েই রাজনৈতিক দলগুলোতে ‘কমিউনিকেশন স্পেশালিস্ট’, ‘পিআর কনসালটেন্ট’ কিংবা ‘মিডিয়া অ্যাডভাইজার’ পদে দায়িত্বপ্রাপ্তরা থাকেন যারা দলীয় মতবাদের প্রচার ও জনসংযোগের কাজ করেন। বাংলাদেশেও যদি এই ধারা অনুসরণ করা হয়, তবে সাংবাদিকদের প্রতি জনআস্থা বাড়বে এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সংবাদ প্রচারেও শৃঙ্খলা আসবে। এতে রাজনৈতিক দল ও মিডিয়ার সাংবাদিকদের মাঝে সম্পর্কের আমূল পরিবর্তন ঘটতে পারে।

এই প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত সাংবাদিকরা মাসিক সম্মানী বা নির্ধারিত ভাতা পেতে পারেন। তাদের দায়িত্ব হবে শুধুমাত্র মিডিয়াগুলোতে নির্ধারিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি পাঠানো, দলীয় কর্মসূচি কাভার করার জন্য মিডিয়াকে সহায়তা করা এবং প্রয়োজনে দলের বক্তব্য স্পষ্ট করে উপস্থাপন করা। এখানে তারা দলের পক্ষে কাজ করলেও তা হবে একটি চুক্তিভিত্তিক পেশাদার দৃষ্টিকোণ থেকে—যার ফলে তাদের সাংবাদিকতা নীতি বা নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে না।

সবচেয়ে বড় কথা, এতে সাংবাদিকরা কোনো রাজনৈতিক দলের দাস হয়ে পড়বেন না, বরং পেশার প্রতি সম্মান রেখে নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। একইসঙ্গে দলগুলোও একটি সুশৃঙ্খল ও দক্ষ মিডিয়া কাঠামোর আওতায় আসবে।

আমরা দেখতে পেয়েছি, এ সরকার আমলে অগণিত মিডিয়া এবং সাংবাদিককে সরাসরি রাজনৈতিক দলের দোসর সাজিয়ে বিভিন্ন স্পর্শকাতর মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করা হচ্ছে। মূলত: সাংবাদিকতা কোন অনুঘটক পেশা ছিলনা, যা ঘটবে তারা তা-ই লিখবে। কিন্তু নানা দলীয় সরকার আমলে নষ্ট কালচারের কারণে পেশাটি এখন অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গেছে। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে সাংবাদিকতা পেশায় শিক্ষিত এবং দায়িত্বশীল মানুষেরা আসবেনা। ফলে পেশাটি মেধাশূন্য হয়ে পড়তে বাধ্য হবে। তাই এখনই সময় রাষ্ট্র যন্ত্র, সরকার, রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ সহ বিভিন্ন পেশার মানুষ এই পেশাটি রক্ষার জন্য দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে পারেন।

এই প্রস্তাবনাটি রাজনৈতিক দলগুলোর নীতিনির্ধারক ও মিডিয়া সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দ এবং সাংবাদিকদের সংগঠনগুলোর গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা উচিত বলে বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক ফোরাম মনে করে। বিষয়টি বিভিন্ন রাজনৈতিক দল এবং সাংবাদিক সংগঠন সমূহের নেতৃবৃন্দ ভাবতে পারেন।

আমরা এ-ও লক্ষ্য করেছি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের লোকজন তাদের দলে সদস্য বাড়াতে সরকারি দপ্তরে চাকুরীজীবি লোকজনকেও দলে বেড়ান, যা সমীচীন নহে। আমরা মনে করি সরকারি চাকরিজীবী, আইনজীবী, মসজিদের ইমাম, চিকিৎসক এবং সাংবাদিকদের জন্য সরাসরি রাজনীতি নয়। কিন্তু এরা নিয়মিত রাজনীতি করায় সামাজিক গ্রহনযোগ্যতা হারিয়ে ফেলেছে।

রাজনৈতিক দলগুলোর চোখে গণমাধ্যম তখনই সাহসী, যখন তারা শত্রু। আর প্রশংসা কুড়োলে সেটা ধরে নেওয়া হয় তেলবাজি। সংবাদমাধ্যমের ক্ষেত্রে এই সত্যটি যেন শাশ্বত। দৈনিক প্রথম আলো তার প্রকাশের শুরু থেকেই একাধিক সরকারের রোষানলে পড়েছে। ১৯৯৮ সালে আত্মপ্রকাশের পরপরই আওয়ামী লীগ তার বিজ্ঞাপন বন্ধ করে দেয়। ২০০০ সালে ক্ষমতায় এসে বিএনপিও একই পথ ধরে। এক-এগারোর সময়ও পত্রিকাটি নিরাপদ থাকেনি। আর ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত একটানা ক্ষমতাসীন সরকারের চোখে প্রথম আলো হয়ে ওঠে এক ধরনের ‘বিরোধীদল’। বিজ্ঞাপন বন্ধ, হামলা, এমনকি বন্ধ করে দেওয়ার চেষ্টাও হয়েছিল। এমন স্টিমরোলার এখন দেশের বিভিন্ন মিডিয়ার ওপর পড়তে শুরু করছে। তেমনি বিগত সরকার আমলে দৈনিক নয়াদিগন্ত বন্ধ ঘোষণা, ইসলামিক টিভি সহ বর্তমান সরকার ভোরের কাগজের প্রকাশণা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে শত শত সাংবাদিক পেশা হারিয়েছেন।

ভয়েস অব আমেরিকার সূত্রমতে, ১৯৯৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত প্রথম আলোর বিরুদ্ধে শতাধিক মামলা হয়েছে। ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে জনগণের পক্ষে অবস্থান নেওয়ায় আরও নতুন শত্রু জন্ম নেয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রশ্ন ওঠে—পত্রিকাটি কি দিল্লির বয়ানের প্রতিনিধিত্ব করছে?

এখন আর শুধুমাত্র ট্যাগিং নয়, প্রতিটি রিপোর্টই রাজনৈতিক বয়ানের চশমায় বিশ্লেষিত হচ্ছে। সম্প্রতি নতুন রাজনৈতিক দল এনসিপির এক সভা ঘিরে হাসনাত আব্দুল্লাহকে নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে প্রথম আলো নিয়ে ফের বিতর্কে শুরু হয়। হাসনাতের পাল্টা অভিযোগ—“নিউজটা দিল্লি থেকে পাঠানো।” কালেরকণ্ঠও শিরোনাম করে, “হাসনাতকে নিয়ে মিথ্যাচার: প্রথম আলোর অপসাংবাদিকতা রুখে দেওয়ার আহ্বান।”

এই ঘটনাটি প্রমাণ করে দিয়েছে দেশের সব সংবাদমাধ্যমই এখন রাজনৈতিক বয়ানের ফাঁদে পড়েছে। নিরীহ নিউজও বয়ানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে যাচাই হচ্ছে। দেশে গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে তরুণ প্রজন্ম রাজনীতির বয়ান বিশ্লেষণে যেভাবে সোচ্চার হয়েছে, তা বিস্ময়কর। কেবল শহরের নয়, গ্রামের মানুষও এখন রাজনৈতিক ভণ্ডামি ও প্রচারের কৌশল সম্পর্কে আগের চেয়ে অনেক সচেতন।

এ বাস্তবতায় সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য বিপদের ঘন্টা বাজছে। দলঘেঁষা সাংবাদিকতা আর দলীয় বয়ান প্রমোট করে এখন আর চলবে না। সাংবাদিক সংগঠনে নেতাদের পা চেটে সুবিধা নেওয়ার যুগও শেষের পথে। কারণ, আজকের নেতারা সংবাদমাধ্যমের মানহীন, দলানুগত সেবাকে এখন বিপজ্জনক মনে করছেন।

সত্যিই, যারা বয়ান তৈরি করে জনগণের চেতনা, নৈতিকতা আর সম্মতির নিয়ন্ত্রক হতে চায়, তাদের জন্য দিন এখন আর আগের মতো নেই। আর যারা সত্য তুলে ধরতে চায়, তাদের জন্য এখনই সবচেয়ে বিপজ্জনক সময়।
সাংবাদিকতা ও রাজনীতি—এই দুই ভিন্ন পেশা যদি পেশাদারিত্বের ভিত্তিতে আলাদা রাখা যায়, তবে গণতন্ত্র, সুশাসন, জবাবদিহি, গণমাধ্যম ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি সবকিছুই লাভবান হবে বলে মনে করছি।