বাংলাদেশের আর্থিক খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে অবস্থান করছি আমরা, যেখানে প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে নতুন এক পরিসরে প্রবেশ করেছে দেশের অর্থনীতির সেবা কাঠামো। ব্যাংকিং খাতের এ উন্নয়নে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হলো এজেন্ট ব্যাংকিং। এটি মূলত ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় আর্থিক সেবা পৌঁছে দেওয়ার একটি কার্যকর মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। ব্যাংকগুলোর শাখা, এটিএম বা ডিজিটাল ব্যাংকিং প্ল্যাটফর্মের বাইরে যে অঞ্চলে ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব ছিল না, সেখানেই ভূমিকা রেখেছে এজেন্ট ব্যাংকিং। এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চল বা দুর্গম এলাকায় বসবাসকারী মানুষ এখন সহজেই আমানত জমা, ঋণ গ্রহণ, রেমিট্যান্স উত্তোলন এবং অন্যান্য আর্থিক সেবা পাচ্ছেন।
বাংলাদেশে এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমের সূচনা হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার মাধ্যমে ২০১৩ সালে, তবে পূর্ণ মাত্রায় তা কার্যকর হয় ২০১৪ সাল থেকে। এই উদ্যোগের মূল উদ্দেশ্য ছিল ‘আর্থিক অন্তর্ভুক্তি’ নিশ্চিত করা—অর্থাৎ সেইসব জনগণকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত করা, যারা আগে কখনো ব্যাংকিংয়ের সুযোগ পায়নি। দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষ, বিশেষত গ্রামীণ নারী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী এবং প্রবাসীদের পরিবারের সদস্যরা এই সেবার অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন। সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিগত সহায়তা, পাশাপাশি ব্যাংকগুলোর উদ্ভাবনী উদ্যোগের ফলে, অল্প সময়ের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
এই সেবার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, ব্যাংক নিজস্ব কোনো শাখা না খুলে একজন স্বীকৃত এজেন্ট বা ব্যবসায়ীকে নির্দিষ্ট চুক্তির মাধ্যমে ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। এজেন্টরা ব্যাংকের পক্ষে আমানত গ্রহণ, নগদ উত্তোলন, রেমিট্যান্স বিতরণ, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানের মতো কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। প্রথাগত ব্যাংকিংয়ের তুলনায় এটি অপেক্ষাকৃত সাশ্রয়ী, দ্রুতগামী এবং সহজলভ্য। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর গ্রাহকভিত্তি যেমন বেড়েছে, তেমনি দেশের প্রান্তিক জনগণের মধ্যে সঞ্চয় অভ্যাস ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণও বৃদ্ধি পেয়েছে।
বর্তমানে দেশের প্রায় সব প্রধান বাণিজ্যিক ব্যাংকই এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এই খাতে যেসব ব্যাংক প্রভাবশালী অবস্থান তৈরি করতে পেরেছে, তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি। ব্যাংকটি ২০১৭ সালে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করে এবং অল্প সময়ের মধ্যেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত তাদের সংগ্রহিত আমানতের পরিমাণ ২০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা দেশের এজেন্ট ব্যাংকিং সেক্টরের মোট আমানতের প্রায় ৪২ শতাংশ। এই বিপুল সংখ্যক আমানত শুধুমাত্র ইসলামী ব্যাংকের প্রতি গ্রাহকদের আস্থা এবং ব্যাংকটির কার্যকর পরিচালন ব্যবস্থার সাক্ষ্য বহন করে না, বরং এটি বাংলাদেশের আর্থিক খাতের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনাও নির্দেশ করে।
ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং সেবার আওতায় বর্তমানে ৫৩ লাখের বেশি গ্রাহক রয়েছে। এই সংখ্যা শুধু পরিসংখ্যানগত গুরুত্ব বহন করে না, বরং এটি বাংলাদেশের বৃহৎ গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে আর্থিক ব্যবস্থায় যুক্ত করার একটি বাস্তব প্রমাণ। এই গ্রাহকদের মধ্যে অর্ধেক নারী, যা নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের দিক থেকেও একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। এদের সিংহভাগই গ্রামীণ এলাকার বাসিন্দা, যাদের জন্য আগে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাংকিং সেবা প্রাপ্তি ছিল দূরহ।
ইসলামি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতির প্রাত্যহিক গতি-প্রকৃতিতে এ সেবার গুরুত্বকে তুলে ধরে। এখানেই শেষ নয়, প্রবাসী আয় আহরণের ক্ষেত্রেও ইসলামী ব্যাংক এককভাবে শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছে। ২০২৪ সালে তারা এজেন্ট ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ১৫ হাজার ৩৫২ কোটি টাকা রেমিট্যান্স আহরণ করেছে, যা দেশের মোট রেমিট্যান্সের ৫৪ শতাংশেরও বেশি। ২০২৫ সালের প্রথমার্ধেই তারা ইতিমধ্যে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স সংগ্রহ করেছে। এই সাফল্য প্রমাণ করে, প্রবাসীরা ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোকে নিরাপদ ও সুবিধাজনক বলে বিবেচনা করছেন।
ইসলামী ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম বর্তমানে দেশের ৪৭২টি উপজেলায় ছড়িয়ে পড়েছে। ২ হাজার ৭৯১টি আউটলেটের মাধ্যমে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে, যার অধিকাংশই স্থাপিত হয়েছে দুর্গম গ্রামাঞ্চলে, যেখানে প্রচলিত ব্যাংকিং সেবার অবকাঠামো নেই। ফলে এসব অঞ্চলের মানুষ এখন তাদের নিজ এলাকায় বসেই ব্যাংকিং সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। এটি শুধু সময় ও অর্থ সাশ্রয় করছে না, বরং স্থানীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে গতিশীল করে তুলছে।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে ইসলামী ব্যাংক পল্লী উন্নয়নের লক্ষ্যে ‘রুরাল ডেভেলপমেন্ট স্কিম (আরডিএস)’ চালু করেছে। এই প্রকল্পের আওতায় ১৩৫টি আউটলেট থেকে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ সহায়তা পাচ্ছেন। এটি গ্রামের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, কৃষক এবং নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এক যুগান্তকারী সুবিধা হিসেবে কাজ করছে। ক্ষুদ্র ঋণের এই প্রবাহ নতুন উদ্যোক্তা তৈরিতে, স্বনির্ভরতা গঠনে এবং দারিদ্র্য বিমোচনে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।
ইসলামী ব্যাংকের এই সাফল্যের পেছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, তারা শরীয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং নীতিমালা অনুসরণ করে, যা তাদের লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ গ্রাহকের কাছে বিশেষভাবে গ্রহণযোগ্য। দ্বিতীয়ত, তাদের পরিচালনা কাঠামোতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রতি অঙ্গীকার রয়েছে। তৃতীয়ত, আধুনিক প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহার এবং সময়োপযোগী ডিজিটাল সেবা তাদেরকে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিয়েছে। সর্বোপরি, তাদের গ্রাহকবান্ধব মনোভাব এবং মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর আগ্রহই তাদের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রমকে একটি মডেল হিসেবে গড়ে তুলেছে।
যদিও ইসলামী ব্যাংক সবচেয়ে অগ্রণী অবস্থানে রয়েছে, অন্যান্য ব্যাংকগুলোর মধ্যেও এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় প্রতিযোগিতা তৈরি হয়েছে। ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া, এবং প্রথম আলোচনায় আসা কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাদের এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে আমানত, রেমিট্যান্স এবং গ্রাহকসংখ্যার দিক থেকে ইসলামী ব্যাংক এদের মধ্যে আলাদা এক জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।
বর্তমানে দেশে প্রায় ৩৫ হাজারের মতো এজেন্ট ব্যাংকিং আউটলেট রয়েছে এবং এই সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। ব্যাংকিংয়ের প্রথাগত ধারা থেকে বের হয়ে এক ধরনের জনমুখী ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, যার মাধ্যমে অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তি বাস্তব রূপ পাচ্ছে। সরকারি বিভিন্ন ভাতা বিতরণ, উপবৃত্তি কার্যক্রম কিংবা সামাজিক সুরক্ষা খাতেও এখন এজেন্ট ব্যাংকিং ব্যবহৃত হচ্ছে। ফলে এই প্ল্যাটফর্ম শুধু একটি বাণিজ্যিক সেবা নয়, বরং একটি সামাজিক দায়িত্বও পালন করছে।
এই প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এজেন্ট ব্যাংকিং শুধু একটি বিকল্প ব্যাংকিং সেবা নয়, বরং এটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অন্তর্ভুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর মাধ্যমে দেশের কোটি মানুষ ব্যাংকিং ব্যবস্থার আওতায় আসছে, যার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ছে জাতীয় সঞ্চয় হার, বিনিয়োগ প্রবণতা এবং দারিদ্র্য বিমোচনে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি এই খাতে নেতৃত্ব দিয়ে যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তা অন্যান্য ব্যাংকের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। এই গতিপথ অব্যাহত থাকলে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ একটি সর্বজনীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক আর্থিক ব্যবস্থায় পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
১০:০৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম
রাজু আলীম :
ব্যাংকিংয়ের অগ্রযাত্রা নয়া দিগন্ত , ইসলামী ব্যাংকের ২০ হাজার কোটি টাকার মাইলফলক
Tag :
জনপ্রিয়