বাংলাদেশ মূলত দক্ষিণ এশিয়ার একটি অংশ, যেখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ সহাবস্থানে বাস করেছে। অন্যভাবে বলা যায় বাংলাদেশ একটি বহু-ধর্ম, বহু-সংস্কৃতির দেশ। এখানে মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বসবাস করছে। আমাদের দেশের সংবিধানে প্রতিটি নাগরিকের ধর্মীয় স্বাধীনতা নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তব জীবনে ধর্মীয় ভিন্নতার কারণে মাঝে মাঝে ভুল বোঝাবুঝি, বৈষম্য ও সংঘাত সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতি নিরসন এবং সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্তধর্মীয় সংলাপ বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। ধর্মীয় পর্যালোচনায় জানা যায় প্রায় ৯০% জনসংখ্যা মুসলিম। বাংলার ইতিহাসে ইসলামের প্রভাব গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে মুঘল এবং সুলতানি যুগে। আবার বাংলাদেশের বৃহত্তর অংশে হিন্দু সম্প্রদায় দীর্ঘকাল ধরে বসবাস করছে। বৌদ্ধ ধর্মের ক্ষেত্রে প্রাচীনকালে বৌদ্ধধর্ম সমৃদ্ধ ছিল, বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও বরিশাল অঞ্চলে। এবং খ্রিস্টধর্মের ক্ষেত্রে তুলনামূলকভাবে ছোট সম্প্রদায়, মূলত মিশনারি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে এসেছে। ধর্মীয় মূল্যবোধ ধর্মের বিস্তার কে সম্প্রসারিত করেছে যুগে যুগে। ধর্মীয় সম্প্রীতি বজায় রাখার ক্ষেত্রে নিম্নে কয়েকটি বিষয়ে আলোকপাত করলাম
১. পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সহনশীলতা বৃদ্ধি:
আন্তধর্মীয় সংলাপ ভিন্ন ধর্মের মানুষের মাঝে বোঝাপড়া বাড়ায়। মানুষ যখন একে অপরের বিশ্বাস, আচার-অনুষ্ঠান ও মূল্যবোধকে কাছ থেকে জানতে পারে, তখন ভুল ধারণা কমে এবং সহনশীলতা বাড়ে।
২. ধর্মীয় সম্প্রীতি রক্ষা
বাংলাদেশ ঐতিহ্যগতভাবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। আন্তধর্মীয় সংলাপ ধর্মীয় বিভাজনকে কমিয়ে সমাজে শান্তি, সৌহার্দ্য ও ভ্রাতৃত্ব বজায় রাখতে সাহায্য করে।
৩. সামাজিক সংঘাত নিরসন
ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যা, উগ্রবাদী চিন্তা বা গুজব অনেক সময় সংঘাতের জন্ম দেয়। সংলাপের মাধ্যমে এসব সমস্যার সমাধান করা যায়, কারণ আলোচনার মাধ্যমে মানুষ সত্যের মুখোমুখি হয় এবং বিভ্রান্তি দূর হয়।
৪. জাতীয় ঐক্য ও উন্নয়ন
জাতীয় উন্নয়নের জন্য সামাজিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য। যখন সব ধর্মের মানুষ সম্মানের সাথে শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করে, তখন জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। আন্তধর্মীয় সংলাপ সেই ঐক্যকে মজবুত করে।
৫. মানবিক মূল্যবোধ জাগ্রত করা
প্রত্যেক ধর্মেই শান্তি, মানবপ্রেম, ন্যায় ও কল্যাণের শিক্ষা রয়েছে। সংলাপের মাধ্যমে এসব অভিন্ন মূল্যবোধকে সামনে আনা যায়, যা মানুষকে মানবিক হতে অনুপ্রাণিত করে।
৬. উগ্রবাদ ও সহিংসতা প্রতিরোধ
যুব সমাজকে অনেক সময় ভ্রান্ত মতবাদে প্রভাবিত করা হয়। আন্তধর্মীয় সংলাপ সঠিক ধর্মীয় শিক্ষা ও মানবিক আদর্শ তুলে ধরে উগ্রবাদ প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখে।
৭. গ্লোবালাইজেশনের প্রভাব মোকাবিলা
বর্তমান বিশ্বে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের সাথে খাপ খাওয়ানো জরুরি। আন্তধর্মীয় সংলাপ তরুণ প্রজন্মকে বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে সহায়তা করে।
এখানে একটু বলে রাখা প্রয়োজন আসলে আন্তধর্মীয় সংলাপের মূল উদ্দেশ্য হলো প্রত্যেক ধর্মের ভেতরে যে শান্তি, মানবপ্রেম, সহনশীলতা ও ভ্রাতৃত্বের বার্তা আছে, সেগুলোকে সামনে আনা। প্রত্যেক ধর্মেই এমন কিছু শিক্ষা আছে যা আন্তধর্মীয় সংলাপকে শক্তিশালী ভিত্তি দেয়। নিচে প্রধান ধর্মগুলো থেকে কিছু মূল কথা তুলে ধরা হলো—
ক) ইসলাম ধর্মে আন্তধর্মীয় সংলাপ সম্পর্কে আল-কুরআনে বলা হয়েছে:
“তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমার ধর্ম আমার জন্য।” (সূরা কাফিরুন ৬)
“আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না, যারা তোমাদের সাথে ধর্মের কারণে যুদ্ধ করেনি… তাদের সাথে সদাচরণ করতে।” (সূরা মুমতাহিনা ৮)
এখানে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীর প্রতি সহনশীলতা ও সদ্ব্যবহার করার নির্দেশনা রয়েছে।
খ) হিন্দু ধর্মে আন্তধর্মীয় সংলাপ সম্পর্কে
ঋগ্বেদে বলা হয়েছে:
“একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি” — অর্থাৎ “সত্য এক, তবে জ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন নামে প্রকাশ করেন।”
এই শিক্ষা দেখায় যে ভিন্ন ধর্মের মানুষ ভিন্নভাবে একই সত্যকে উপলব্ধি করে।
ভগবদ্ গীতাতেও বলা হয়েছে সকল প্রাণীকে সমভাবে দেখার কথা।
গ) বৌদ্ধ ধর্মে আন্তধর্মীয় সংলাপ সম্পর্কে
গৌতম বুদ্ধ শিখিয়েছেন:
অহিংসা, করুণা ও সহমর্মিতা হলো জীবনের মূল ভিত্তি।
“সকল প্রাণীই দুঃখী; তাই সকলের প্রতি করুণা প্রদর্শন কর।”
বৌদ্ধ ধর্মে তাই অন্য ধর্মাবলম্বীর প্রতি বিদ্বেষ নয়, বরং মমত্ববোধকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
ঘ) খ্রিস্টান ধর্মে আন্তধর্মীয় সংলাপ সম্পর্কে
বাইবেলে বলা হয়েছে:
“তোমরা তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে।” (ম্যাথিউ ২২:৩৯)
“যেমনভাবে ঈশ্বর সবাইকে ভালোবাসেন, তেমনি তোমরাও একে অপরকে ভালোবাস।”
খ্রিস্টান ধর্মে তাই ভিন্ন ধর্মের মানুষের প্রতিও প্রেম ও ভ্রাতৃত্বকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে।
ঙ) ইহুদি ধর্মে আন্তধর্মীয় সংলাপ সম্পর্কে
তোরাহতে বলা হয়েছে:
“তুমি তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে।” (লেবিটিকাস ১৯:১৮)
ভিন্ন জাতি বা ধর্ম হলেও প্রতিবেশীকে সম্মান করার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে।
আন্তধর্মীয় সংলাপ নিয়ে বিশ্বের অনেক মনীষী, ধর্মীয় পণ্ডিত ও সমাজসংস্কারক গুরুত্বপূর্ণ উক্তি দিয়েছেন। এগুলো মানুষকে ভিন্ন ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা, সহনশীলতা ও মানবিক বন্ধনে উদ্বুদ্ধ করে। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি উক্তি উল্লেখ করা হলো—
ইসলামিক মনীষীদের উক্তি
হযরত আলী (রা.)
“মানুষ দুই প্রকার – হয় সে তোমার ধর্মের ভাই, নয়তো সে তোমার মানবিক ভাই।”
এখানে ধর্ম নির্বিশেষে মানবিক বন্ধনের কথা বলা হয়েছে।
মাওলানা আবুল কালাম আজাদ
“ধর্মের উদ্দেশ্য বিভেদ নয়, বরং ঐক্য সৃষ্টি করা।”
হিন্দু ধর্মের মনীষীদের উক্তি
স্বামী বিবেকানন্দ (শিকাগো ধর্ম সম্মেলন, ১৮৯৩)
“আমি এমন এক ধর্মে বিশ্বাস করি, যা সব ধর্মকে সত্য বলে স্বীকার করে।”
আন্তধর্মীয় সংলাপের অন্যতম ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত।
মহাত্মা গান্ধী
“আমি হিন্দু, মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও ইহুদি – সব ধর্মের অনুসারী। কারণ সব ধর্মই সত্যকে শেখায়।”
বৌদ্ধ ধর্মের মনীষীদের উক্তি
গৌতম বুদ্ধ
“ঘৃণা কখনো ঘৃণার দ্বারা দূর হয় না; কেবল ভালোবাসা দ্বারা ঘৃণা দূর করা সম্ভব।”
দালাই লামা
“আমাদের ভিন্ন ধর্ম থাকতে পারে, কিন্তু সব ধর্মই শেখায় – করুণা, ভালোবাসা এবং মানবসেবা।”
খ্রিস্টান ধর্মের মনীষীদের উক্তি
যিশু খ্রিস্ট
“তুমি তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসো।” (বাইবেল)
পোপ জন পল দ্বিতীয়
“আন্তধর্মীয় সংলাপ কোনো বিকল্প নয়, এটি শান্তি প্রতিষ্ঠার অপরিহার্য শর্ত।”
ইহুদি ধর্মের মনীষীদের উক্তি
রব্বি জনাথন স্যাকস (প্রখ্যাত ইহুদি পণ্ডিত)
“ভিন্নতা কোনো হুমকি নয়, বরং সৃষ্টিকর্তার বহুবর্ণের সৌন্দর্যের প্রকাশ।”
সার্বজনীন চিন্তাবিদদের উক্তি
নেলসন ম্যান্ডেলা
“কেউ জন্মগতভাবে অন্য ধর্ম বা বর্ণের প্রতি ঘৃণা নিয়ে জন্মায় না। তাকে ভালোবাসতে শেখানো যায়, কারণ ভালোবাসাই মানুষের স্বাভাবিক গুণ।”
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
“আমরা সবাই হয়তো ভিন্ন জাহাজে এসেছি, কিন্তু এখন আমরা একই নৌকায়।”
এভাবে দেখা যায়, ভিন্ন ধর্মীয় ও মানবতাবাদী মনীষীরা আন্তধর্মীয় সংলাপকে শান্তি, ভ্রাতৃত্ব ও সহাবস্থানের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে দেখেছেন।
পরিশেষে বলতে চাই প্রত্যেক ধর্মের ভেতরেই এমন মূল্যবোধ আছে যা মানুষকে বিভেদ নয়, বরং সম্প্রীতি, শান্তি ও মানবপ্রেমে একত্রিত করে। এই সাধারণ ও অভিন্ন শিক্ষাগুলোকে আলোচনায় সামনে আনা হলে আন্তধর্মীয় সংলাপ সফল হয়। বাংলাদেশে আন্তধর্মীয় সংলাপ কেবল একটি প্রয়োজনীয় কাজ নয়; এটি জাতীয় স্থিতিশীলতা, শান্তি এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। ভিন্ন ধর্মের মানুষের মধ্যে সৌহার্দ্য, সহমর্মিতা ও সহযোগিতা গড়ে তোলার মাধ্যমে একটি অগ্রসর, শান্তিপূর্ণ ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব।