◻ জসিম উদ্দীন মাহমুদ তালুকদার, চট্টগ্রাম
ন্যাশনাল ইউনিয়ন অব স্টুডেন্টসের এক জরিপ থেকে তথ্য উঠে এসেছে যে স্কুল, কলেজ, ইউনিভার্সিটির ছাত্রছাত্রীর মধ্যে শতকরা ৬০ জন যৌনতা সম্পর্কে পর্নো ভিডিও দেখছে। বাংলাদেশে ২০১৭ সালে অষ্টম শ্রেণির কিছু ছাত্রছাত্রীর ওপর চালানো একটি জরিপে দেখা যায়, শতকরা ৭৬ শিক্ষার্থীর ফোন আছে। বাকিরা বাবা-মার ফোন ব্যবহার করে ৮২ শতাংশ সুযোগ পেলে মোবাইলে পর্নো দেখে। ক্লাসে বসে পর্নো দেখে ৬২ শতাংশ। এটা ছিল ২০১৭ সালের কথা আর এখন ২০২৫ সাল। বিগত করোনার প্রকোপে সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জনস্বার্থে বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল সরকার। শিক্ষার্থীরা যেন ঝরে না পড়ে তার জন্য শুরু হয় অনলাইন ক্লাস। ফলে শিক্ষার্থীদের প্রয়োজন পড়ে ইন্টারনেট, ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন। অনেক সচেতন অভিভাবকও এসব ডিভাইস কিনে দিতে বাধ্য হন। এজন্য বলা যায়, বাংলাদেশের এখন শতভাগ শিক্ষার্থী মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে। শিক্ষার্থীদের এসব ডিভাইস শিক্ষা ক্ষেত্রেই ব্যবহার সীমাবদ্ধ থাকার কথা ছিল। কিন্তু তারা এই সুবর্ণ সুযোগের অপব্যবহার করছে। বাসায় রাতের অন্ধকারে, স্কুলের টিফিনের বিরতিতে, পাড়ার অলিগলিতে নিরাপদে ইন্টারনেট, এসব অশ্লীল ভিডিও দেখছে।
এই অজানা ভুল তার পুরো জীবনকে ধ্বংস করে দেয়। এ ভুলগুলো আবার মানুষকে চরমভাবে আকর্ষিত করে, সৃষ্টি করে কৌতূহল আর লালসার। ম্যাজিকের মতো নিমিষেই লন্ডভন্ড করে দেয় সাজানো-গুছানো মা- বাবার স্বপ্নের একেকটি সুন্দর জীবন। এমনই এক নীরব গতিশীল ব্যাধি হচ্ছে পর্নোগ্রাফি। নীরব এই ঘাতকের খপ্পরে পড়ছে সব ধর্মের, সব বয়সের মানুষ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে সুস্থ ও সুন্দর জীবন ধারণের জন্য পর্নোগ্রাফি বিরাট বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত ব্যক্তির পরিবর্তন হয় স্বাভাবিক জীবনধারা। পাল্টে দেয় শারীরিক ও মানসিক চাহিদা। সামাজিক সর্বজনীন অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে এসব অশ্লীল বিষয়বস্তু। এতে আসক্ত ব্যক্তি শুধু নিজের ক্ষতির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। ক্ষতি করে পরিবারের, সমাজের, দেশের তথা পৃথিবীর। একজন পর্নোভিডিও আসক্ত ব্যক্তির চরিত্রের মধ্যে লোপ পেতে থাকে মৃল্যবোধ, নৈতিকতা, হিতাহিত জ্ঞান। ফলে জড়িয়ে পড়ে হত্যা, শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, মানব পাচার, অজাচার, আত্মহত্যা এবং মাদকে। এই মারাত্মক কনটেন্ট বন্ধের জন্য গৃহীত সব অস্ত্রই ব্যর্থ হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে।
যদি আমরা পর্নোগ্রাফির মূল উৎস অনুসন্ধান করি তাহলে পাবো নোংরা নাটক, সিনেমা, অশ্লীল ফেসবুক ভিডিও, চটিগল্প, উপন্যাস ইত্যাদি। এগুলো যুব জীবনকে চরমভাবে প্রভাবিত করে। তারা তার পছন্দের অভিনেতা অভিনেত্রীদের মতো পোশাক, হেয়ারকাট, খাদ্যাভ্যাস ব্যক্তি জীবনে অন্ধ অনুকরণ করে। তাই এসব ভিডিওতে আসক্ত বিবাহিত দম্পতিদের মধ্যে পর্নোদের অনুকরণ করার প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। তাদের জীবনে স্বাভাবিক যৌন চাহিদা থাকে না। বিভিন্ন গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে, পর্নো আসক্তির কারণে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যকার ভালোবাসার মধ্যে ফাটল ধরে। যৌন জীবন নিয়ে তারা অসন্তুষ্টি, অতৃপ্তিতে ভোগে। কারণ তাদের চাহিদা হয়ে যায় পাশবিক, লালিত হয় বিকৃত যৌন চাহিদা। এসব ব্যক্তি ভ্রান্ত ধারণা নিয়ে যখন তার সঙ্গীর সঙ্গে সময় কাটাতে যায়, তখনই অঘটনটা ঘটে।
কারণ নীল পর্দার অভিনেতা অভিনেত্রীদের মতো তারা শরীর খোঁজে কিন্তু বাস্তবটা হয় ভিন্ন। পর্নো আসক্ত পুরুষদের চাহিদা থাকে পর্নো অভিনেত্রীদের মতো আকর্ষণীয় সুন্দর হবে তাদের স্ত্রীদের শরীর। নারীরাও ছেলেদের দেহ সম্পর্কে অতিরঞ্জিত ধারণা করে বসে। ফলে তৃপ্ত হতে পারে না, শুরু হয় দাম্পত্য জীবনে কলহ ও অশান্তি। ধীরে ধীরে রূপ নেয় পরকীয়া, বিবাহবিচ্ছেদের। ধীরে ধীরে একাকিত্ব, হতাশায় নিমজ্জিত হতে থাকে। অনেকে আবেগপ্রবণ হয়ে আত্মহত্যার মতো ভয়ংকর পথ বেছে নেয়।
অনেকেই পর্নোকে বাস্তব মনে করে। বোঝে না এগুলো কল্পকাহিনি থেকে কম নয়। এসব নোংরা মুভির অভিনেতার শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ এডিটিংয়ের মাধ্যমে বাস্তবের চেয়ে বড় আকারে আকর্ষণীয়ভাবে দেখানো হয়। তারা দীর্ঘদিন শুটিং করে কয়েক মিনিটের একটা ভিডিও বানায়। কিন্তু দর্শকরা এটা বুঝতে চায় না। ফলে নষ্ট হয়ে যায় একটা ফুলের মতো সংসার। আমেরিকান সোসিওলজিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের গবেষণাপত্র অনুযায়ী, বিবাহিতদের মধ্যে যারা পর্নো আসক্ত, তাদের বিবাহবিচ্ছেদের আশঙ্কা স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি। আমেরিকায় শতকরা ৫৬টি বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম কারণ সঙ্গীর পর্নো আসক্তি। এটা এমন একটি ভয়াবহ ঘাতক, যা ঘুণ পোকার মতো ভেতরে ভেতরে সমাজের সবকিছু নষ্ট করে দেয়। একটা তরতাজা সদ্য প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি থেকে বের হওয়া কিশোর-কিশোরীরা পর্নোর মতো জঘন্যতম ফাঁদের শিকারে পরিণত হয়। মোবাইলের মেমোরি কার্ডে ভর্তি থাকে অশ্লীলতা। সারারাত এসবে মগ্ন থাকে, যা সরাসরি প্রভাবিত করে ছাত্রজীবনকে।
২০০৮ সালে জার্মানির একদল গবেষক জানান, পর্নো আসক্তি ছাত্রছাত্রীদের অ্যাকাডেমিক পারফরম্যান্সের উন্নয়নে বড় একটা বাধা। পর্নো ভিডিও দেখে ছাত্রছাত্রীরা পড়াশোনায় ফাঁকিবাজি শুরু করে। ক্লাস পালায়, ঠিকমতো স্কুল- কলেজে, মাদ্রাসায় যায়না না। কারণ তার ভেতরে সব সময় একটা যৌন-উদ্দীপনা কাজ করে। তার আর অন্য কোনো কাজ করতে ভালো লাগে না। ফলে রেজাল্ট খুব খারাপ হয়। ফলে দেখা যায় তার সঙ্গে বন্ধুবান্ধব মিশতে চায় না, বাবা-মা, আত্মীয়স্বজনরা চাপ সৃষ্টি করেন। শুরু হয় হতাশা, একাকিত্ব ও অস্থিরতা। জীবনে ভর করে জটিলতা, তৈরি হয় মন খারাপের সু-উচ্চ প্রাসাদ। একাকিত্ব দৃর করতে হাতে তুলে নেয় সিগারেট, মদণ্ডগাঁজা, ইয়াবা ও হিরোইন- বাদ যায় না কিছুই। আবার এসব নেশাদ্রব্যের অর্থের জোগান দিতে জড়িয়ে পড়ে অপরাধ জগতে। তাই বলা যায়, অসামাজিক সব কার্যকলাপের সঙ্গে জড়িত সব অপরাধের প্রভাবক হলো পর্নোগ্রাফি।
শুধু অপরাধ সৃষ্টির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পর্নো অনুকরণীয় ব্যক্তি আক্রান্ত হয় মারাত্মক যৌন রোগে। যেমন : প্রস্রাব ও মলত্যাগের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছে, গলায় ক্যানসার, আক্রান্ত হচ্ছে এইডস রোগে। তরুণ-তরুণীরা ভুগেছে অস্থিরতা, উদ্বেগ আর বিষন্নতায়। সমাজের এই জটিল অসুখের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে। নিজের ছেলে-মেয়ে, বন্ধু, স্বামী-স্ত্রী ও আত্মীয়স্বজনের ওপর নজর রাখতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, যারা পর্নো ভিডিওতে আসক্ত তাদের কিছু চলন-চরিত্র উপস্থিতি চিহ্নিত করেছেন। যেমন : মাত্রাতিরিক্ত ইন্টারনেটের আসক্তি হবে, তাদের ঘুমের প্যাটার্ন বদলে যাবে, ব্রাউযারের সার্চ হিস্ট্রি মুছে দেবে, মাত্রাতিরিক্ত আইটেম সং ও মিউজিক ভিডিওর প্রতি আকর্ষণ জন্মাবে, একাকী থাকার চেষ্টা করবে এবং লজ্জাহীন ও অসামাজিক হয়ে উঠবে। যদি এগুলোর উপস্থিতি দেখতে পাওয়া যায় তাহলে বুঝে নিতে হবে সে পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত। সে ক্ষেত্রে করণীয় হলো তাৎক্ষণিক তাদের কাউন্সিলিং ও মনিটরিং করতে হবে। তাদের পর্নোভিডিওর ভয়ংকর ক্ষতিকর প্রভাবগুলো সম্পর্কে জানাতে ও বোঝাতে হবে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে, তাদের মনের কথাগুলো শুনতে হবে। এই পর্নোভিডিওর বিরুদ্ধে সমাজের সচেতন, সুশীল, শিক্ষিত এবং জ্ঞানী ব্যক্তিদের অগ্রণী ভূমিকায় এগিয়ে আসতে হবে। আর যদি এসবের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো না যায় তাহলে অচিরেই দেশের সমাজিক ব্যবস্থা ধসে পড়বে, পারিবারিক কাঠামো ভেঙে পড়বে। প্রচলিত মৃল্যবোধ, রীতিনীতি, সম্মান, শ্রদ্ধা, ভালোবাসা- সবকিছুই বিলীন হয়ে যাবে। সবখানে হবে নষ্টের জয় জয়কার।
লেখক পরিচিত : লেখক ও সংবাদকর্মী।