০৫:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পরিবর্তিত বাংলাদেশ এবং অন্তর্বর্তী সরকার

  • প্রকাশিত ০৭:৪৮:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫
  • ১৭ বার দেখা হয়েছে

 

রাজু আলীম

বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ফ্যাসিবাদ, একনায়কোচিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন এসেছে অনেকটা নাটকীয় ভাবে। ভোটার বিহীন নির্বাচন, সীমাহীন দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতার হরণের মতো ঘটনার ঘনঘটায় আচ্ছন্ন জাতি নবজাগরণের একটিমাত্র ফুলকিতে জ্বলে উঠেছে নতুনভাবে। গুলি, বোমা, সাঁজোয়া বহরের সামনে অকাতরে নিজের জীবন ঢেলে ছাত্র থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা এনেছে মুক্তির নতুন সূর্য। কিন্তু ফ্যাসিবাদ, একনায়তন্ত্রের পতনের মাত্র সাত মাস পরেই দেশের মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কার কালোমেঘ।
পুলিশ, প্রাশাসন, রাষ্ট্র কাঠামো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে ফুটপাথ সবখানেই অবাঞ্ছিত বিশৃঙ্খলা। যেন এক অরক্ষিত জনপদ। বাইরে গিয়ে একটু ঠিক করে সাধারণ মানুষের চোখে মুখে চাইলেই দেখা যায় ভীতি, অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার ছায়া। পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির আনন্দ, বিষাদের অন্ধকারে ঢাকতে খুব বেশি সময় নেয়নি।
মাত্র কিছুদিন আগের দেশে একের পর এক ছিনতাই অতঃপর ডাকাতির মহড়া। শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক শিশু হত্যা, ধর্ষণ। মব কিংবা মিরপুরের ফুটপাতে বিক্রেতার হাতে ক্রেতার উপর্যুপরি মারখাওয়ার ও হেনস্থার সংবাদ। ধর্মকে বর্ম করে রাজনীতির ঘোরটোপ। সময়ের পালাবদলে অর্থনীতির হাত বদল। ফলশ্রুতিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া বন্ধ কারখানায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিক। সব মিলে জনজীবনে কোথায় যেন নীরব এক ছন্দপতন।
বিক্ষিপ্ত রাজনীতির মাঠে স্বপ্ন দেখানো নতুন দল, এমনকি দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। তবে সেই প্রশ্নে মুখোমুখি হয়ে, বর্তমানের হাল হকিকত, রাষ্ট্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জ আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথাও শোনাচ্ছেন সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজন, সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী। দেশকে কোন স্থান থেকে নিয়ে কোন স্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিভাবে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন তারা, কিভাবে হবে রাষ্ট্র সংস্কার, কোন পথে চলবে বিপ্লোবোত্তর বাংলাদেশ এবং দেশের রাজনীতি; বর্তমান সময় এবং রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন সরকারের উপদেষ্টা আইন বিচার এবং সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর আসিফ নজরুল। দেশের জনপ্রিয় টকশো, তৃতীয় মাত্রায় জিল্লুর রহমানের সরাসরি প্রশ্নের মুখে তিনি খোলামেলা ভাবে বলেন তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকার ও রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির কথা।
বর্তমানে দেশের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে ঢালাও দোষারোপ এবং ভারতপন্থী অথবা পাকিস্তানপন্থী তকমা দিয়ে রাজনীতির মাঠে বিশেষ সুবিধা নেবার বিষয় বিষয়টি বর্ননা করেন এই উপদেষ্টা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমাকে পাকিস্তান প্রেমী পাকিস্তানের এজেন্ট বলে আমার রুমে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমার রুমে তালা হয়েছে। আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কতবার আপনি টকশোতে বিভিন্ন লোককে বলতে শুনেছেন এসব কথা। অথচ, রাতারাতি মানে আমি হয়ে গেলাম ভারতের দালাল। আমার কাছে ফানি লাগে। এটা খুবই ফানি একটা সোসাইটিতে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা যাবার পর মিথ্যাভাবে পাকিস্তানপন্থি হিসেবে অভিহিত একটা লোক ১৫ দিনের মধ্যে ভারতের দালাল হয়ে গেল! আমি আপনাকে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, জামিল সাহেব যখন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেন, সেদিন ২৪ ঘন্টা প্রচারণা ছিল আমি ভারতের দালাল। তারপরে তাজুল যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চিফ প্রসিকিউর হিসেবে নিয়োগ পেল ২৪ ঘন্টা প্রচারণা ছিল আমি পাকিস্তানের দালাল। আমি কি বলবো! ভেরি ক্লিয়ারলি বলি, আমি বাংলাদেশের দালাল। বাংলাদেশের স্বার্থের ঊর্ধে পৃথিবীর কোন দেশ আমার কাছে কখনোই স্থান পায় নাই।
মিথ্যাচার চরিত্রহনের মধ্যেও একটা সীমার ব্যাপার আছে। জবাবদিহিটা তো অন্য জিনিস। এই গালাগালি মিথ্যাচার এসব অশ্লীল অশ্রাব্য জিনিসের উত্তর তো দেওয়া যায় না।
জিল্লুর রহমানের সাথে আলাপচারিতায় বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন ড. আসিফ নজরুল। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেশের চলমান সময়ে সামাজিকভাবে একটা ভয় তৈরি হয়েছে মব জাস্টিসের ব্যাপারটা নিয়ে। আপনি যদি বলেন সরকার এটার পিছনে কোন প্রণোদনা বা উৎস আছে নাকি? নাই জিরো। আপনি যদি বলেন এটাকে দমন করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা আছে নাকি? হ্যাঁ থাকতে পারে। এটাকে দমন করার জন্য সরকারের যতটুকু কঠোরতা দেখানো দরকার ছিল, সেটা নিয়ে আপনি সমালোচনা করতে পারেন। সমালোচনার অবকাশ আছে, কেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা গেল না আট মাসে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কার্ভ আছে। একটা সময় খুব খারাপ থাকে। আবার একটু খারাপ হয়ে যায়।
আমি জানি এটা শুনলে হয়তো মনে হবে আমি ট্রেডিশনাল মন্ত্রীর মত কথা বলছি। তবে আপনি যদি অপরাধের স্ট্যাটিস্টিক দেখেন, তাহলে আমাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ে নাই কিছু ক্ষেত্রে বরং কমেছে।
এত রক্ত দিয়ে এত আত্মত্যাগ করে এরকম একটা সোসাইটিতে কেন এখন এমন হবে, এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রাজনীতিকরণ করা হয়েছে পুলিশের।
সেনাবাহিনী নিয়ে বিতর্ক এবং তার অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা জিনিস প্রাসস্পেক্টিভ অনুযায়ী দেখতে হবে। আমাদের যে সেনাপ্রধান আছেন উনার একটা ঐতিহাসিক রোল ছিল এই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে। এটা কারো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা উচিত না। আমার কাছে মনে হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের প্রতি উনার প্রচন্ড শ্রদ্ধাবোধ আছে।
আমি এটা উইথ রিস্পেক্ট বলি, এই যে ইনক্লুসিভ ইলেকশন এই ধরনের কথা যদি উনি না বলেন তবে এটা ভালো। এজ এ স্টেকহোল্ডার তিনি যদি বলেন, উনি যেহেতু লিড করছেন বলতেই পারেন।
বর্তমান সরকারের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডার আছে। সবাই মিলেই সরকার গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ আছে। তবে তারা এক উদ্যেশ্যেই কাজ করছেন। আর তা হলো, বাংলাদেশকে একটি স্টেবল অবস্থানে নিয়ে আসা।
শেখ হাসিনার আমলে দুইটা জিনিস খুব ঘৃণা করতাম। একটা হচ্ছে মালিকানার রাজনীতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি হয়ে গিয়ে ছিলো। এটা ছিল জনযুদ্ধ। যেহেতু শেখ পরিবার কেউ যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে নাকি মানে শেখ কামালও সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে নাকি এটা প্রশ্ন থাকতে পারে। আরেকটা হচ্ছে ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি। এখন ধরেন এই মালিকানার রাজনীতি, ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি, এটা ছাত্র সংগঠনের কারো কারো মধ্যে আছে নাকি প্রশ্ন আপনি তুলতে পারেন। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কারো আছে নাকি আপনি তুলতে পারেন। বিএনপি জামাতের মধ্যে ওই প্রবণতা আছে নাকি এটা আপনি তুলতে পারেন। এখন ধরেন আমরা ছাত্রদেরকে বেশি ভালোবাসি। বেশি স্নেহ করি। আমরা ওদের থেকে খুব পারফেক্ট আচরণ আশা করি। কিন্তু জিল্লুর একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেন, আমার আপনার যখন ২৫-২৬ বছর ছিল কত ভুল আমরা করতাম। আরো বেশি ভুল করতাম। সো ওরা তো একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসছে। শিখছে জানার চেষ্টা করছে। আজকে আপনি দেখেন সার্জিস যে ১০০টা গাড়ি নিয়ে মিছিল প্রোগ্রামটা করেছে, তাসনিন যারা প্রশ্ন তুলেছে ফেসবুকে। এটা নিয়ে সার্জিস তুমি ব্যাখ্যা করো। এই চর্চা কি আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক দলে ছিল? দিল্লির ছিল না। আমাদের অনেক এক্সপেক্টেশন অনেক ভালোবাসা দেখে আমরা খুব কষ্ট পাই। কিন্তু আপনি পজিটিভ জিনিসটাও দেখেন।
আবার এটাও লক্ষ্য করেন। আজকে মাহফুজ যেভাবে মবের বিরুদ্ধে, এই আপনার উন্মত্ততা মানে তৌহিদী জনতার নামে উন্মত্ততা এসবের বিরুদ্ধে মাহফুজ যে স্ট্যান্ডটা নিয়েছেন, যেভাবে নিন্দিত হয়েছেন স্ট্যান্ডটা নিয়ে, যেভাবে নিজেকে ভালনারেবল করেছেন, এই পজিটিভ সাইডগুলো দেখে আপনি কি বলবেন?
বাংলাদেশের গায়ে যদি মৌলবাদ বা উগ্রবাদের তকবা লাগে সবচেয়ে বেশি রেপুটেশন ক্ষতি কার হবে? ডক্টর ইউনূসের হবে। আমরা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। কিন্তু আমরা তো উগ্রবাদ পক্ষে কথা বলি নাই।
দেশে নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি আরেক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমাদের আসিফ মাহমুদ কিন্তু একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে খুব স্ট্রংলি। সে বলেছে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে ইলেকশন হবে। জোর দিয়ে বলেছে। এই কথা বলার অধিকারই আমার নাই কবে ইলেকশন হবে। কারণ এটা উপদেষ্টা পরিষদের মিটিং এ আলোচিত হবে। বাট আমরা একটা ফ্যামিলির মধ্যে থাকলে আপনি ভাইবটা ধরতে পারেন। তো আসিফ ওই ভাইবটা ধরতে পেরে যে কথাটা বলেছে আমারও তাই মনে হয়। যে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে খুব সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক :
কবি সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব।

Tag :
জনপ্রিয়

ফেসবুক প্রোফাইল হ্যাক হলে করণীয়

পরিবর্তিত বাংলাদেশ এবং অন্তর্বর্তী সরকার

প্রকাশিত ০৭:৪৮:০৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫

 

রাজু আলীম

বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে চলে আসা ফ্যাসিবাদ, একনায়কোচিত শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তন এসেছে অনেকটা নাটকীয় ভাবে। ভোটার বিহীন নির্বাচন, সীমাহীন দুর্নীতি, বাকস্বাধীনতার হরণের মতো ঘটনার ঘনঘটায় আচ্ছন্ন জাতি নবজাগরণের একটিমাত্র ফুলকিতে জ্বলে উঠেছে নতুনভাবে। গুলি, বোমা, সাঁজোয়া বহরের সামনে অকাতরে নিজের জীবন ঢেলে ছাত্র থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা এনেছে মুক্তির নতুন সূর্য। কিন্তু ফ্যাসিবাদ, একনায়তন্ত্রের পতনের মাত্র সাত মাস পরেই দেশের মানুষের মাঝে সৃষ্টি হয়েছে শঙ্কার কালোমেঘ।
পুলিশ, প্রাশাসন, রাষ্ট্র কাঠামো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে ফুটপাথ সবখানেই অবাঞ্ছিত বিশৃঙ্খলা। যেন এক অরক্ষিত জনপদ। বাইরে গিয়ে একটু ঠিক করে সাধারণ মানুষের চোখে মুখে চাইলেই দেখা যায় ভীতি, অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার ছায়া। পরিস্থিতি দৃষ্টে মনে হয় বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির আনন্দ, বিষাদের অন্ধকারে ঢাকতে খুব বেশি সময় নেয়নি।
মাত্র কিছুদিন আগের দেশে একের পর এক ছিনতাই অতঃপর ডাকাতির মহড়া। শেষ পর্যন্ত ধারাবাহিক শিশু হত্যা, ধর্ষণ। মব কিংবা মিরপুরের ফুটপাতে বিক্রেতার হাতে ক্রেতার উপর্যুপরি মারখাওয়ার ও হেনস্থার সংবাদ। ধর্মকে বর্ম করে রাজনীতির ঘোরটোপ। সময়ের পালাবদলে অর্থনীতির হাত বদল। ফলশ্রুতিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া বন্ধ কারখানায় বিক্ষুব্ধ শ্রমিক। সব মিলে জনজীবনে কোথায় যেন নীরব এক ছন্দপতন।
বিক্ষিপ্ত রাজনীতির মাঠে স্বপ্ন দেখানো নতুন দল, এমনকি দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম নিয়েও ওঠে প্রশ্ন। তবে সেই প্রশ্নে মুখোমুখি হয়ে, বর্তমানের হাল হকিকত, রাষ্ট্র পরিচালনার চ্যালেঞ্জ আর ভবিষ্যতের সম্ভাবনার কথাও শোনাচ্ছেন সরকারের অন্যতম প্রধান অংশীজন, সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলী। দেশকে কোন স্থান থেকে নিয়ে কোন স্থানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে সরকার। কিভাবে নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছেন তারা, কিভাবে হবে রাষ্ট্র সংস্কার, কোন পথে চলবে বিপ্লোবোত্তর বাংলাদেশ এবং দেশের রাজনীতি; বর্তমান সময় এবং রাষ্ট্রীয় পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন সরকারের উপদেষ্টা আইন বিচার এবং সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা প্রফেসর ডক্টর আসিফ নজরুল। দেশের জনপ্রিয় টকশো, তৃতীয় মাত্রায় জিল্লুর রহমানের সরাসরি প্রশ্নের মুখে তিনি খোলামেলা ভাবে বলেন তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং সরকার ও রাষ্ট্রের আভ্যন্তরীন পরিস্থিতির কথা।
বর্তমানে দেশের রাজনীতি এবং সংস্কৃতিতে ঢালাও দোষারোপ এবং ভারতপন্থী অথবা পাকিস্তানপন্থী তকমা দিয়ে রাজনীতির মাঠে বিশেষ সুবিধা নেবার বিষয় বিষয়টি বর্ননা করেন এই উপদেষ্টা। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞার বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, আমাকে পাকিস্তান প্রেমী পাকিস্তানের এজেন্ট বলে আমার রুমে আগুন দেওয়া হয়েছে। আমার রুমে তালা হয়েছে। আমাকে হত্যার হুমকি দেওয়া হয়েছে। কতবার আপনি টকশোতে বিভিন্ন লোককে বলতে শুনেছেন এসব কথা। অথচ, রাতারাতি মানে আমি হয়ে গেলাম ভারতের দালাল। আমার কাছে ফানি লাগে। এটা খুবই ফানি একটা সোসাইটিতে পরিণত হয়েছে। শেখ হাসিনা যাবার পর মিথ্যাভাবে পাকিস্তানপন্থি হিসেবে অভিহিত একটা লোক ১৫ দিনের মধ্যে ভারতের দালাল হয়ে গেল! আমি আপনাকে একটা ছোট্ট ঘটনা বলি, জামিল সাহেব যখন শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক হিসেবে নিয়োগ পেলেন, সেদিন ২৪ ঘন্টা প্রচারণা ছিল আমি ভারতের দালাল। তারপরে তাজুল যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে চিফ প্রসিকিউর হিসেবে নিয়োগ পেল ২৪ ঘন্টা প্রচারণা ছিল আমি পাকিস্তানের দালাল। আমি কি বলবো! ভেরি ক্লিয়ারলি বলি, আমি বাংলাদেশের দালাল। বাংলাদেশের স্বার্থের ঊর্ধে পৃথিবীর কোন দেশ আমার কাছে কখনোই স্থান পায় নাই।
মিথ্যাচার চরিত্রহনের মধ্যেও একটা সীমার ব্যাপার আছে। জবাবদিহিটা তো অন্য জিনিস। এই গালাগালি মিথ্যাচার এসব অশ্লীল অশ্রাব্য জিনিসের উত্তর তো দেওয়া যায় না।
জিল্লুর রহমানের সাথে আলাপচারিতায় বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়েও কথা বলেন ড. আসিফ নজরুল। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেশের চলমান সময়ে সামাজিকভাবে একটা ভয় তৈরি হয়েছে মব জাস্টিসের ব্যাপারটা নিয়ে। আপনি যদি বলেন সরকার এটার পিছনে কোন প্রণোদনা বা উৎস আছে নাকি? নাই জিরো। আপনি যদি বলেন এটাকে দমন করার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা আছে নাকি? হ্যাঁ থাকতে পারে। এটাকে দমন করার জন্য সরকারের যতটুকু কঠোরতা দেখানো দরকার ছিল, সেটা নিয়ে আপনি সমালোচনা করতে পারেন। সমালোচনার অবকাশ আছে, কেন আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করা গেল না আট মাসে। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির কার্ভ আছে। একটা সময় খুব খারাপ থাকে। আবার একটু খারাপ হয়ে যায়।
আমি জানি এটা শুনলে হয়তো মনে হবে আমি ট্রেডিশনাল মন্ত্রীর মত কথা বলছি। তবে আপনি যদি অপরাধের স্ট্যাটিস্টিক দেখেন, তাহলে আমাদের অপরাধ প্রবণতা বাড়ে নাই কিছু ক্ষেত্রে বরং কমেছে।
এত রক্ত দিয়ে এত আত্মত্যাগ করে এরকম একটা সোসাইটিতে কেন এখন এমন হবে, এই প্রশ্নটা স্বাভাবিক। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি রাজনীতিকরণ করা হয়েছে পুলিশের।
সেনাবাহিনী নিয়ে বিতর্ক এবং তার অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রত্যেকটা জিনিস প্রাসস্পেক্টিভ অনুযায়ী দেখতে হবে। আমাদের যে সেনাপ্রধান আছেন উনার একটা ঐতিহাসিক রোল ছিল এই গণঅভ্যুত্থানের পক্ষে। এটা কারো তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা উচিত না। আমার কাছে মনে হয়েছে গণঅভ্যুত্থানের প্রতি উনার প্রচন্ড শ্রদ্ধাবোধ আছে।
আমি এটা উইথ রিস্পেক্ট বলি, এই যে ইনক্লুসিভ ইলেকশন এই ধরনের কথা যদি উনি না বলেন তবে এটা ভালো। এজ এ স্টেকহোল্ডার তিনি যদি বলেন, উনি যেহেতু লিড করছেন বলতেই পারেন।
বর্তমান সরকারের অবস্থান সম্পর্কে তিনি বলেন, সরকারে বিভিন্ন স্টেক হোল্ডার আছে। সবাই মিলেই সরকার গঠন করা হয়েছে। বিভিন্ন মত ও পথের মানুষ আছে। তবে তারা এক উদ্যেশ্যেই কাজ করছেন। আর তা হলো, বাংলাদেশকে একটি স্টেবল অবস্থানে নিয়ে আসা।
শেখ হাসিনার আমলে দুইটা জিনিস খুব ঘৃণা করতাম। একটা হচ্ছে মালিকানার রাজনীতি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি হয়ে গিয়ে ছিলো। এটা ছিল জনযুদ্ধ। যেহেতু শেখ পরিবার কেউ যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে নাকি মানে শেখ কামালও সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিচ্ছে নাকি এটা প্রশ্ন থাকতে পারে। আরেকটা হচ্ছে ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি। এখন ধরেন এই মালিকানার রাজনীতি, ট্যাগ দেওয়ার রাজনীতি, এটা ছাত্র সংগঠনের কারো কারো মধ্যে আছে নাকি প্রশ্ন আপনি তুলতে পারেন। একই সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও কারো আছে নাকি আপনি তুলতে পারেন। বিএনপি জামাতের মধ্যে ওই প্রবণতা আছে নাকি এটা আপনি তুলতে পারেন। এখন ধরেন আমরা ছাত্রদেরকে বেশি ভালোবাসি। বেশি স্নেহ করি। আমরা ওদের থেকে খুব পারফেক্ট আচরণ আশা করি। কিন্তু জিল্লুর একটা জিনিস খেয়াল করে দেখেন, আমার আপনার যখন ২৫-২৬ বছর ছিল কত ভুল আমরা করতাম। আরো বেশি ভুল করতাম। সো ওরা তো একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে আসছে। শিখছে জানার চেষ্টা করছে। আজকে আপনি দেখেন সার্জিস যে ১০০টা গাড়ি নিয়ে মিছিল প্রোগ্রামটা করেছে, তাসনিন যারা প্রশ্ন তুলেছে ফেসবুকে। এটা নিয়ে সার্জিস তুমি ব্যাখ্যা করো। এই চর্চা কি আমাদের প্রচলিত রাজনৈতিক দলে ছিল? দিল্লির ছিল না। আমাদের অনেক এক্সপেক্টেশন অনেক ভালোবাসা দেখে আমরা খুব কষ্ট পাই। কিন্তু আপনি পজিটিভ জিনিসটাও দেখেন।
আবার এটাও লক্ষ্য করেন। আজকে মাহফুজ যেভাবে মবের বিরুদ্ধে, এই আপনার উন্মত্ততা মানে তৌহিদী জনতার নামে উন্মত্ততা এসবের বিরুদ্ধে মাহফুজ যে স্ট্যান্ডটা নিয়েছেন, যেভাবে নিন্দিত হয়েছেন স্ট্যান্ডটা নিয়ে, যেভাবে নিজেকে ভালনারেবল করেছেন, এই পজিটিভ সাইডগুলো দেখে আপনি কি বলবেন?
বাংলাদেশের গায়ে যদি মৌলবাদ বা উগ্রবাদের তকবা লাগে সবচেয়ে বেশি রেপুটেশন ক্ষতি কার হবে? ডক্টর ইউনূসের হবে। আমরা দুঃশাসনের বিরুদ্ধে ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে কথা বলেছি। কিন্তু আমরা তো উগ্রবাদ পক্ষে কথা বলি নাই।
দেশে নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি আরেক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমাদের আসিফ মাহমুদ কিন্তু একটা স্ট্যাটাস দিয়েছে খুব স্ট্রংলি। সে বলেছে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝির মধ্যে ইলেকশন হবে। জোর দিয়ে বলেছে। এই কথা বলার অধিকারই আমার নাই কবে ইলেকশন হবে। কারণ এটা উপদেষ্টা পরিষদের মিটিং এ আলোচিত হবে। বাট আমরা একটা ফ্যামিলির মধ্যে থাকলে আপনি ভাইবটা ধরতে পারেন। তো আসিফ ওই ভাইবটা ধরতে পেরে যে কথাটা বলেছে আমারও তাই মনে হয়। যে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ের মধ্যে খুব সম্ভাবনা রয়েছে।

লেখক :
কবি সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব।