১১:০৪ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫, ১১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শ্বেতাঙ্গ ‘গণহত্যা’ ও দক্ষিণ আফ্রিকা : ট্রাম্পের মিথ্যাচার, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ এবং গণতন্ত্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ

  • প্রকাশিত ০৫:২৭:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫
  • ৬৬ বার দেখা হয়েছে

২১ মে ২০২৫, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার মধ্যে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বৈঠকে ট্রাম্প একটি ভিডিও উপস্থাপন করেন যা দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের গণকবর দেখানোর দাবি করছিল। যদিও পরে এটি প্রমাণিত হয় যে ভিডিওটি ২০২০ সালের একটি প্রতিবাদ স্মারক অনুষ্ঠানের ছিল, তবুও ট্রাম্প এ ঘটনাকে ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অভিযুক্ত করেন।

এই ঘটনার পেছনে শুধুমাত্র তথ্য বিকৃতি নয়, বরং একটি গভীর রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করছে, যা তিনটি স্তরে বিশ্লেষণ করা জরুরি—দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, এবং ট্রাম্প প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক আচরণ।

১. দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা: বর্ণবাদ-উত্তর রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব

১৯৯৪ সালে বর্ণবাদের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকা একটি গণতান্ত্রিক, বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হলেও, বর্ণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আজও প্রকট। দেশের অধিকাংশ সম্পদ, বিশেষ করে কৃষিজমি, এখনো শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের দখলে। দীর্ঘদিন ধরে ANC সরকার কৃষিজমি সংস্কারের কথা বললেও, বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর।

এ প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের “শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা” অভিযোগ দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা সম্পর্কে একটি চরম বিকৃত উপস্থাপনা। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, কৃষক হত্যার ঘটনা কিছু আছে, কিন্তু তা বর্ণবাদ-প্রসূত নয় বরং সামগ্রিকভাবে অপরাধ প্রবণতার অংশ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যা গণহত্যার উপাদান পূরণ করে।

২. মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কৌশল: শ্বেতাঙ্গ শরণার্থীর মুখোশে আধিপত্যবাদ

‘Mission South Africa’ নামে ট্রাম্প প্রশাসনের শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের জন্য শরণার্থী কর্মসূচি চালু করা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী কৌশলেরই একটি রূপ। ইতিহাসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবসময়ই ‘মানবাধিকার রক্ষার’ নামে নির্দিষ্ট অঞ্চলকে টার্গেট করে সামরিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে। এবার সেই লক্ষ্যবস্তু হলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

এই কর্মসূচি কেবল বৈষম্যমূলক নয়, বরং এতে মার্কিন রাষ্ট্র একটি নিপীড়ক জাতিগোষ্ঠীকে ‘নির্যাতিত’ হিসেবে তুলে ধরে, আফ্রিকার কৃষক-শ্রমজীবী গরিব জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ঢেকে ফেলছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে—একটি নব্য উপনিবেশবাদী কৌশল।

৩. ট্রাম্প প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক আচরণ: ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতিফলন

ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশল বরাবরই ছিল নাটকীয়, তথ্য বিকৃতিমূলক এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী। রামাফোসার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বৈঠকে বিভ্রান্তিকর ভিডিও উপস্থাপন এবং ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ শব্দের ব্যবহার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এটি ছিল গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে একপ্রকার কূটনৈতিক অপমান, যা বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। ট্রাম্পের এই অগণতান্ত্রিক আচরণ বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদী ঢেউয়েরই অংশ, যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে মিথ্যা ও তথ্য-হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হয়।

উপসংহার: ইতিহাসের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে ঐক্য

দক্ষিণ আফ্রিকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন নেতৃত্বের এই মিথ্যাচার শুধু আফ্রিকার জন্য নয়, বিশ্বজনীন গণতন্ত্রের জন্যও এক বিপদসংকেত। এটি প্রমাণ করে যে, তথাকথিত ‘গ্লোবাল নর্থ’-এর শাসকেরা এখনো দক্ষিণ গোলার্ধের সংগ্রামী জাতিগুলোর ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চায়।

এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন—আন্তর্জাতিক সংহতি, তথ্যনিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের সংগ্রাম কেবল তাদের একক লড়াই নয়—এটি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া সব মানুষের সংগ্রাম।

লেখক: আহাদ মিনার
প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠক

Tag :
জনপ্রিয়

কুমিল্লায় জাতীয় পর্যায়ে তিন দিনব্যাপী কবি নজরুলের ১২৬তম জন্মবার্ষিকীর উদ্বোধন

শ্বেতাঙ্গ ‘গণহত্যা’ ও দক্ষিণ আফ্রিকা : ট্রাম্পের মিথ্যাচার, সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ এবং গণতন্ত্রের প্রতি চ্যালেঞ্জ

প্রকাশিত ০৫:২৭:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৫ মে ২০২৫

২১ মে ২০২৫, যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার মধ্যে হোয়াইট হাউসে অনুষ্ঠিত বৈঠক আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে নতুন করে উত্তেজনা সৃষ্টি করেছে। বৈঠকে ট্রাম্প একটি ভিডিও উপস্থাপন করেন যা দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের গণকবর দেখানোর দাবি করছিল। যদিও পরে এটি প্রমাণিত হয় যে ভিডিওটি ২০২০ সালের একটি প্রতিবাদ স্মারক অনুষ্ঠানের ছিল, তবুও ট্রাম্প এ ঘটনাকে ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ হিসেবে চিহ্নিত করে দক্ষিণ আফ্রিকাকে অভিযুক্ত করেন।

এই ঘটনার পেছনে শুধুমাত্র তথ্য বিকৃতি নয়, বরং একটি গভীর রাজনৈতিক এজেন্ডা কাজ করছে, যা তিনটি স্তরে বিশ্লেষণ করা জরুরি—দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, এবং ট্রাম্প প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক আচরণ।

১. দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা: বর্ণবাদ-উত্তর রাষ্ট্রের অন্তর্দ্বন্দ্ব

১৯৯৪ সালে বর্ণবাদের অবসানের পর দক্ষিণ আফ্রিকা একটি গণতান্ত্রিক, বহুজাতিক রাষ্ট্র হিসেবে গঠিত হলেও, বর্ণভিত্তিক আর্থ-সামাজিক বৈষম্য আজও প্রকট। দেশের অধিকাংশ সম্পদ, বিশেষ করে কৃষিজমি, এখনো শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের দখলে। দীর্ঘদিন ধরে ANC সরকার কৃষিজমি সংস্কারের কথা বললেও, বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত ধীর।

এ প্রেক্ষাপটে ট্রাম্পের “শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা” অভিযোগ দক্ষিণ আফ্রিকার বাস্তবতা সম্পর্কে একটি চরম বিকৃত উপস্থাপনা। বাস্তব পরিস্থিতি হলো, কৃষক হত্যার ঘটনা কিছু আছে, কিন্তু তা বর্ণবাদ-প্রসূত নয় বরং সামগ্রিকভাবে অপরাধ প্রবণতার অংশ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যা গণহত্যার উপাদান পূরণ করে।

২. মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী কৌশল: শ্বেতাঙ্গ শরণার্থীর মুখোশে আধিপত্যবাদ

‘Mission South Africa’ নামে ট্রাম্প প্রশাসনের শ্বেতাঙ্গ আফ্রিকানারদের জন্য শরণার্থী কর্মসূচি চালু করা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো সাম্রাজ্যবাদী কৌশলেরই একটি রূপ। ইতিহাসে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ সবসময়ই ‘মানবাধিকার রক্ষার’ নামে নির্দিষ্ট অঞ্চলকে টার্গেট করে সামরিক, কূটনৈতিক বা অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ চালিয়েছে। এবার সেই লক্ষ্যবস্তু হলো দক্ষিণ আফ্রিকা।

এই কর্মসূচি কেবল বৈষম্যমূলক নয়, বরং এতে মার্কিন রাষ্ট্র একটি নিপীড়ক জাতিগোষ্ঠীকে ‘নির্যাতিত’ হিসেবে তুলে ধরে, আফ্রিকার কৃষক-শ্রমজীবী গরিব জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা ঢেকে ফেলছে। এর মাধ্যমে ট্রাম্প প্রশাসন শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে—একটি নব্য উপনিবেশবাদী কৌশল।

৩. ট্রাম্প প্রশাসনের অগণতান্ত্রিক আচরণ: ফ্যাসিবাদী রাজনীতির প্রতিফলন

ট্রাম্পের রাজনৈতিক কৌশল বরাবরই ছিল নাটকীয়, তথ্য বিকৃতিমূলক এবং উগ্রজাতীয়তাবাদী। রামাফোসার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় বৈঠকে বিভ্রান্তিকর ভিডিও উপস্থাপন এবং ‘হোয়াইট জেনোসাইড’ শব্দের ব্যবহার আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক নীতিমালার সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

এটি ছিল গণতান্ত্রিক শিষ্টাচার ভঙ্গ করে একপ্রকার কূটনৈতিক অপমান, যা বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চলের একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে। ট্রাম্পের এই অগণতান্ত্রিক আচরণ বৈশ্বিক ফ্যাসিবাদী ঢেউয়েরই অংশ, যেখানে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে মিথ্যা ও তথ্য-হস্তক্ষেপকে বৈধতা দেওয়া হয়।

উপসংহার: ইতিহাসের অপব্যাখ্যার বিরুদ্ধে ঐক্য

দক্ষিণ আফ্রিকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মার্কিন নেতৃত্বের এই মিথ্যাচার শুধু আফ্রিকার জন্য নয়, বিশ্বজনীন গণতন্ত্রের জন্যও এক বিপদসংকেত। এটি প্রমাণ করে যে, তথাকথিত ‘গ্লোবাল নর্থ’-এর শাসকেরা এখনো দক্ষিণ গোলার্ধের সংগ্রামী জাতিগুলোর ওপর আধিপত্য কায়েম করতে চায়।

এ পরিস্থিতিতে প্রয়োজন—আন্তর্জাতিক সংহতি, তথ্যনিষ্ঠ প্রতিবাদ এবং শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি স্পষ্ট রাজনৈতিক অবস্থান। দক্ষিণ আফ্রিকার জনগণের সংগ্রাম কেবল তাদের একক লড়াই নয়—এটি বিশ্বজুড়ে গণতন্ত্র ও সাম্যবাদের পক্ষে অবস্থান নেওয়া সব মানুষের সংগ্রাম।

লেখক: আহাদ মিনার
প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংগঠক