মোঃ এনায়েত হোসাইন পলাশ
হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের অপূর্ব লীলাভূমি,পর্যটনের অপার সম্ভাবনার অগ্রণী কটেজ দ্বীপ, দেশের মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন প্রাচীন জনপদের নাম সন্দ্বীপ।
সন্দ্বীপ দ্বীপের নামকরণের সুনির্দিষ্ট সময় জানা না গেলে ও এই নামের উৎপত্তির বেশ কয়েকটি প্রচলিত ব্যাখ্যা রয়েছেঃ-
*সেন্ড হিপ (Send-heap)- ইউরোপীয় নাবিকেরা প্রথম দ্বীপটিকে দূর থেকে বালির স্তুপ ভেবে এই নামে ডাকতেন।পরবর্তীতে সন্দ্বীপ নামে পরিবর্তিত হয়েছে।
*সোম দ্বীপঃ- ইতিহাসবিদ ব্যাভারিজের মতে চন্দ্র-দেবতা সোম এর নামানুসারে সোম দীপ হয়েছিল যা পরবর্তীতে সন্দ্বীপ রুপ নেয়।
*স্বর্ণদ্বীপঃ- কিছু তথ্য অনুযায়ী উর্বরতা ও প্রাচুর্য্যের কারণে স্বর্ণদ্বীপ বলা হত যা থেকে পরবর্তীতে সন্দ্বীপ নামটি এসেছে।
*শূন্যদ্বীপঃ- কোন কোন সূত্র মতে আউলিয়ারা জনমানবহীন এই দ্বীপটি আবিষ্কার করে এর নাম রেখেছিলেন শূন্যদ্বীপ। যা পরবর্তীতে সন্দ্বীপ নামেই পরিণত হয়।
বর্তমানে সন্দ্বীপে প্রায় ৪ লক্ষ ৫০ হাজার লোকের বসবাস। আয়তন প্রায় ৭৬৩ বর্গ কিলোমিটার। গত ৩৬ বছরে সন্দ্বীপের আয়তন বেড়েছে প্রায় ৪৭৫ বর্গ কিলো মিটার।জেগে ওঠা জমির পরিমাণ ৩৯৮ বর্গ কিলোমিটার এবং পলল ভূমি প্রায় ৭৭ বর্গ কিলোমিটার। সাগর গর্ভে এই ভূমি একসময় বিলীন হয়েছিল। প্রকৃতি এখন তা আবার ফিরিয়ে দিচ্ছে।
সন্দ্বীপ একটি প্রাচীন দ্বীপ যার ইতিহাস প্রায় ৩০০০ বছরের পুরনো বলে মনে করা হয়। এ দ্বীপটি হাজার বছরের পুরনো সমৃদ্ধশালী এবং ঐতিহ্যবাহী জনপদ যা বন্দর নগরী হিসেবে খ্যাত। এখানে পর্তুগিজ ও ফরাসীদের উপনিবেশ স্থাপন, বাংলা ভাষা সাহিত্যের বিকাশে ভূমিকা, চর্যাপদের সাথে সংযোগ এবং বহু ক্ষণজন্মা ব্যক্তির জন্মস্থান হিসেবে এর একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে।
দেলোয়ার খাঁ (দিলাল রাজা নামে ও পরিচিত) সন্দ্বীপের শেষ স্বাধীন শাসক ছিলেন। শক্তিশালী এবং দানশীল শাসক হিসেবে তার খ্যাতি ছিল অনন্য। যার কারণে তাকে রবিনহুড নামে ডাকা হতো।
ঐতিহাসিক পটভূমি ও ঐতিহ্যঃ
প্রাচীন বন্দর ও বাণিজ্যঃ সন্দ্বীপ একটি প্রাচীন বন্দর ছিল এবং ষোড়শ শতাব্দীতে পর্তুগিজ এবং ফরাসিরা এখানে স্থাপন করে লবন জাহাজ ব্যবসা। এখানকার শষ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে এখানেই বসতি গড়ে তোলে।
সংস্কৃত ভাষা চর্চাঃ সন্দ্বীপে রয়েছে বাংলা ভাষা চর্চার অসামান্য ভূমিকা। চর্যাপদ রচয়িতাদের মধ্যে মমিনাথ এর মতব্যক্তিরা ও এখানে স্থান নিয়েছিল।
খাবার ও মাছঃ সন্দ্বীপ শিবের হাটের বিনয় সাহার মিষ্টি খুবই সুস্বাদু ও বিখ্যাত। সন্দ্বীপ শিবের হাটের এই মিষ্টি প্রতিনিয়ত উন্নত বিশ্বের আমেরিকা এবং লন্ডনে যাচ্ছে।সন্দ্বীপের মহিষের দধিও খুবই সুস্বাদু। সন্দ্বীপে সাগরের সব ধরনের মাছ পাওয়া যায়। সাগর থেকে ধরে এনে মাছ রান্না করে খাওয়ার অনুভূতিটাই অন্যরকম।
আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দের ২৮ শে জানুয়ারি উপমহাদেশের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব সন্দ্বীপের কমরেড মুজাফফর আহমেদের সাথে সন্দ্বীপ আসেন। সন্দ্বীপ ভ্রমণের সময়কার স্মৃতির পটভূমিকাতেই কাজী নজরুল ইসলাম তার মধুমালা গীতিনাট্য রচনা করেন। সন্দ্বীপে বৃক্ষের ছায়াতলে বসে নজরুল তার চক্রবাক কাব্যগ্রন্থের অনেক গুলো কবিতা রচনা করেন।
বৈদেশিক রেমিটেন্সঃ বৈদেশিক রেমিটেন্সে সন্দ্বীপ উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে আসছে। যেখানে উপজেলার প্রতি ০৪ জন বাসিন্দাদের মধ্যে ০১ জন প্রবাসি।সন্দ্বীপের প্রবাসীরা দেশের বার্ষিক রেমিটেন্স আয়ের একটি উল্লেখ যোগ্য অংশ প্রায় ১১ শতাংশ সরবরাহ করেন।
হৃদয়ের ক্যানভাসে সন্দ্বীপ একটি নদীমাতৃক মায়ার বন্ধনের আলপনায় আঁকা সমৃদ্ধ জনপদ যা নদীবন্দর এবং শিল্পাঞ্চল হিসেবে রাষ্ট্রীয় তালিকায় বিদ্যমান। পুরোপুরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে সন্দ্বীপে পর্যটনের অপার সম্ভবনার সুযোগ উন্মোচিত হবে এবং একটি সমৃদ্ধ বাণিজ্য নগরীতে পরিণত হবে।