০৮:৪৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ০২ অগাস্ট ২০২৫, ১৮ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
দেবাশিস সাহা :

হিন্দু সমাজ হোক টাইটেল ব্যাধি মুক্ত

  • প্রকাশিত ১২:২২:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫
  • ৮৪ বার দেখা হয়েছে

শতসহস্র বছর দ্রষ্টা ঋষিদের ধ্যানলব্ধ নির্যাসিত জ্ঞান সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিফলনের মাধ্যমেই সনাতন ধর্ম তথা বৈদিক ধর্মের বিস্তার। তবে দ্রষ্টা ঋষিদের এই বিশুদ্ধ জ্ঞান বা বেদশাস্ত্রকে হৃদয়ঙ্গম ও যুগতর করার উদ্দেশ্যেকে কেন্দ্র করে কালের বিবর্তনে উৎপত্তি পৌরাণিক ব্যবস্থা কিংবা কখনো শাসক শ্রেণীর স্বার্থবাদমূলক মতবাদ গোটা সনাতনী সমাজ ও শাস্ত্রব্যবস্থাকে সূর্যগ্রহণের বলয়ের ন্যায় গ্রাস করেছে। যার অনন্য উদাহরণ শাস্ত্রীয় বর্ণাশ্রম, যা বর্তমানে টাইটেল প্রথায় পরিণত!

বর্তমান সনাতনী সমাজের অন্যতম বিষবৃক্ষ ও ৪০০ বছরের পুরনো ব্যাধি নামক প্রচলিত টাইটেল প্রথা হলো ব্যক্তির মূল নামের শেষে ব্যবহৃত শব্দ বা শব্দ সমষ্টি, যা বর্তমানে পদবীতে রূপান্তরিত। যেমন: চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য, রায়, সরকার, দাস, সাহা, আচার্য, শিকদার, দে প্রভৃতি অসংখ্য টাইটেল তথা মূল নাম পরবর্তী অংশ হিন্দু সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এই টাইটেল প্রথার আলোকেই এখন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় বর্ণভেদ নির্ণয় তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
তবে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় টাইটেল প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ইতিহাসটা খুব একটা সুখকর নয়! যা ১৫১০ সালে আনন্দ ভট্ট রচিত ও ১৯০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে উল্লেখিত রয়েছে। উক্ত গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় অবাঙালি রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ সাল) নিজ সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্নী এক সুন্দরী নর্তকীকে বিবাহ করেন। এতে রাজ্যজুড়ে রাজার সুনাম বিনষ্ট হয় এবং এ বিষয় প্রজারা নানারকম সমালোচনা করতে থাকেন। রাজা এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল প্রজাদের উদ্দেশ্য একটি ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। রাজার এই কুকীর্তির বিষয়টি অনেকেই সহজভাবে গ্রহণের অস্বীকৃতির কারণে উক্ত অনুষ্ঠানে অনেকেই উপস্থিত হলেন না, এতে রাজা বল্লাল সেন মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন।
রাজার এই মনস্তাত্ত্বিক অসন্তুষ্টি হেতু যারা রাজার আনুগত্য হয়ে ভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে বিভিন্ন নামে কৌলীন্য বা টাইটেল দান আর অনুপস্থিত প্রজাদের চন্ডাল, চামারসুলভ কু-বিশেষনে আখ্যায়িত করলেন। (তথ্যসূত্রঃ সমাজদর্পণ ১৫ বর্ষ, সংখ্যা ১২;জুন ১৯৯৯)।
এছাড়াও যেহেতু সেন বংশের রাজারা বাঙালি ছিল না কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালীদের শাসন করতে হবে, তাই প্রজাদের মধ্যে একটা বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি ও রাজ্য ক্ষমতায়নকে সহজতর করার পরিকল্পনাও ছক আঁকা হয়, যা এই টাইটেল প্রথার বিস্তারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক টাইটেল প্রথার প্রবর্তনে টাইটেলগুলোর তাত্ত্বিকতা বিশ্লেষণে দেখা যায়-
* রাজদরবারে রাজা এবং গন্যমান্য সভাসদগনের উপস্থিতিতে বেদ ও শাস্ত্রধর্মের ব‍্যাখ‍্যা বিশ্লেষণ করে আয়োজিত সভা বা চক্রে কাজটি করতেন বলে তাকে চক্রবর্তী বলা হতো। রাজা বল্লাল সেন তার প্রজাদের মধ্যে যারা এই চক্রবর্তী টাইটেলধারী তাদেরকে ব্রাহ্মণ উপাধি দিয়েছেন। যদিও প্রাচীনকালে চক্রবর্তী শব্দটি সার্বভৌম রাজা বা সম্রাটদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। যিনি রথের চাকা (চক্র) ঘুরিয়ে রাজ্য জয় করেন, তিনিই চক্রবর্তী।

* সরকার, যারা জমিজমার মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারীও সরকার । প্রধান কর্মচারী এবং সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ব্যাক্তিকেও সরকার বলা হতো। তাই এই সরকার টাইটেলধারীদের মধ্যে বৈশ্য এবং শুদ্র উভয়ের উপাধি দেওয়া হয়।

* মজুমদার, যাদের কাজ ছিল হিসাবপত্র রক্ষা করা, অনেকটা ট্রেজারার কিংবা অডিট সুপারের মতো। এদেরকে মজুমদার টাইটেল দিয়ে বৈশ্য এবং শুদ্র উভয়ের উপাধি দেওয়া হয়, তবে এদের মধ্যেও কিছু লোক তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পূজা অর্চনাদিতে প্রাধান্য পাওয়ায় তাদেরকে ব্রাহ্মণের উপাধিও দিয়েছেন।

* আরবি ‘শিক’ হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ এর সঙ্গে ফারসী ‘দার’ যুক্ত হয়ে শিকদার শব্দের উদ্ভব । যাদের কাজ ছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তাদের শিকদার টাইটেল প্রদান করে তৎকালীন ক্ষত্রিয় হিসেবে উপাধি দিয়েছেন, যদিও পরবর্তীতে তাঁরা আর ওই পর্যায়ে থাকেনি।

* ধর্মের উপদেষ্টা, বৈষ্ণব ও ভক্তশ্রেষ্ঠ ছিলেন তাদেরকে গোস্বামী টাইটেল দিয়ে তাদেরকেও ব্রাহ্মণের উপাধি দিয়েছেন।

* বাংলার বণিকজাতি তথা ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ পরিচয়জ্ঞাপকদের উপাধি দেয়া হলো সাহা।

* মাঝি বা জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে উপাধি দেয়া হলো হালদার।

* তাঁত শিল্পী কিংবা তাঁতের কাপড় তাঁতরের কাপড় তৈরি ও ব‍্যবসা ইত‍্যাদি যাদের পেশা তারা তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। ভিন্নতা ভেদে তন্তবায়দের মধ্যে কয়েক শ্রেণী করে বসাক, শেঠ, মল্লিক, হালদার ইত্যাদি। তাদেরকে বৈশ্য উপাধি দিয়েছেন।

* বিশ্বাস, নবাবি আমলের পেশাগত পদবী । বিশ্বস্ত প্ৰতিনিধি, মোক্তার বা উকিল হিসেবে তিনি নবাব দরবারে রাজা বা জমিদারের পক্ষে বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করতেন বিধায় তাদেরকে বিশ্বাস টাইটেল ও শুদ্র উপাধি দিয়েছেন।

* দত্ত শব্দের অর্থ দেওয়া। দান-দক্ষিণায় উদার, ব্যবসা-বাণিজ্যে দক্ষতা হেতু তাদেরকে দত্ত টাইটেল ও বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়।

* মোদক খুব প্রাচীন পদবী নয়, যারা মোয়া বা চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, মিষ্টি তৈরি করত তাদের মোদক বলা হতো। এই টাইটেলধারীদের বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়।

* হিন্দু রাজা, জমিদার, রাজপুত্র, রাজপুরুষ ও জমিদারদের সাধারণ উপাধি হিসেবে রায় শব্দ ব্যবহৃত হতো বিধায় তাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

* যে ব্যক্তি বাজারে বা আড়তে ধানচাল ইত্যাদি ওজন করে মূলত তাদের পদবী কয়াল। শস্য সংগ্রহকারী ও শস্য রক্ষণকারী হিসেবেও কয়াল পরিচিতি দিয়ে তাদেরকেও বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়।

* প্রামানিক, যারা রাজু দরবারের প্রমাণপত্র উপস্থিত করতো অর্থাৎ সাক্ষী। বিবাহ থেকে শুরু করে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সামাজিক সাক্ষ্য রাখা হতো, কারণ লেখালেখির ব্যাপারটা ছিল সীমিত। তাদেরকে প্রামানিক টাইটেল ও কখনো বৈশ্য কখনো শুদ্র হিসাবে উপাধি দিয়েছেন।

* ভৌমিক, এটি ভূমি সংশ্লিষ্ট পদবী। এরা অতীতে সামন্তরাজ, জমিদার, জোতদার, ভূস্বামী হিসাবে কাজ করতো। তাদেরকে ভৌমিক টাইটেল দিয়ে বৈশ্য হিসাবে উপাধি দিয়েছেন।
উল্লেখিত টাইটেলগুলোর মত আরো অসংখ্য টাইটেল সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলন রয়েছে, যাদেরকে রাজা বল্লাল সেন নিজ দায়িত্বে বিভিন্ন উপাধি দিয়ে নিজে কলঙ্কমুক্ত হয়েছিলেন এবং সেই চাপিয়ে দেওয়া অপসংস্কৃতিমূলক উপাধিগুলোকে আমরা এখনও সগৌরবে লালন করে যাচ্ছি। (তথ্য সূত্র-১.আমাদের পদবীর ইতিহাস- লোকেশ্বর বসু। ২.পদবীর উৎসসন্ধান- সমর পাল)।

তবে উল্লেখ থাকে যে বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় দ্রষ্টা ঋষিগণ, অবতার, মহামানব, মহাপুরুষ প্রভৃতি মহামনীষীগণ কারোরই নামের পরে কোন টাইটেল ছিলনা, যেমন- শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম, ঋষি বশিষ্ট, ঋষি মরীচি, ঋষি পুলস্ত্য, ঋষি পুলহ, ঋষি অত্রি, ঋষি অঙ্গিরা, ঋষি বিশ্বামিত্র, ঋষি ব্যাস, ঋষি ভরদ্বাজ, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ব্যক্তির মূল নামের সঙ্গে সংযুক্ত যে শব্দটি বৈদিক সমাজে সর্বমহলে সমাদৃত ছিল সেই ‘শ্রী’ শব্দটি এখন আর খুব একটা ব্যবহার হয় না। তবে রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক প্রচলিত সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী টাইটেল প্রথা খুব ভালোভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়াও বৈদিক যুগ হতে মহাভারতের যুগ, এমনকি শংকরাচার্য যুগেও ব্যক্তির নামের সাথে তাঁর পিতা/মাতার নামের অংশ সংযোগের প্রচলন ছিল, সেটাও এখন আর সনাতনী সমাজে প্রচলন নেই , যেমন: বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডপুত্র অর্জুন, পাণ্ডপুত্র যুধিষ্ঠির, দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র, সুবলপুত্র শকুনি, শান্তনুপুত্র ভীষ্ম, ধ্রুপদকন্যা দ্রৌপদী ইত্যাদি। তাই যদি বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী সনাতনীদের নামকরন করা হতো তাহলে সনাতনীদের নামগুলো এইরকম হতো যেমন: দেবাশিসপুত্র শ্রী পৃথ্বিরাজ, কিংবা রনদাপুত্র শ্রী দেবাশিস প্রভৃতি।
কিন্তু এই গুরুত্ববহ শাস্ত্রীয় তত্ত্বটি হিন্দু সমাজে ব্যবহৃত না হলেও আরব্য সমাজ ব্যবস্থায় তথা মুসলিম সম্প্রদায় বিষয়টিকে খুব ভালোভাবে নিজেদের মধ্যে রপ্ত করেছে, আরব্য সমাজে সন্তানের নামকরণে পিতা/মাতার নামের অংশ সংযোগ রেখে সন্তানের নামকরণ করা হয়, যেমন: মোহাম্মদ রাশেদ বিন ইউসুফ অর্থাৎ রাশেদের পুত্র ইউসুফ (ছেলেদের ক্ষেত্রে), মোসাম্মৎ রাশেদ বিনতে নাজমা অর্থাৎ রাশেদের কন্যা নাজমা (মেয়েদের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি। এভাবেই বৈদিক শাস্ত্রের উত্তম দিকগুলোকে বর্জন করে অধঃগামী দিকগুলোকে সনাতনীরা সহজেই আপন করে নিয়েছে, তারই একটা উদাহরণ টাইটেল প্রথা। যদিও টাইটেল প্রথা বা বর্ণপ্রথা বা বর্ণবাদ বলতে শাস্ত্রে কোনকিছু নেই, যা আছে তা হলো বর্ণাশ্রম।
শাস্ত্রর নিরুক্ত ২।৩ বলা হয়েছে, “বর্ণো বৃণোতেঃ”-
পাণিনীয় ধাতুপাঠের স্বাদিগণে ‘বৃ’ ধাতুর অর্থ দেওয়া সংবরণ (বৃ সংবরণে)। অর্থাৎ ‘বৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বর্ণ শব্দটির ধাত্বার্থক ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকেই বোঝা যায় ‘বর্ণ’ শব্দটি বরণ করে নেওয়া অর্থাৎ নিজে বেছে নেওয়া অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছায় যে ব্রত বা কর্ম পছন্দ করে বেছে নেয়া হয় তাহাই ‘বর্ণ’।

নিরুক্ত ২/১৩ এ বলা হয়েছে,
“ব্রতমিতি কর্ম্মনাম বৃণোতীতি সতঃ”।
ব্রতম শব্দটি কর্মের নাম, যেহেতু ‘বৃ’ ধাতু দ্বারা আবৃত করা অর্থ প্রকাশ করে, আর তা বেছে নেওয়ায় বর্ণ। তাই শাস্ত্রক্তো বর্ণ শব্দের শাব্দিক অর্থ বরণ করে নেওয়া বা পছন্দ করা, অর্থাৎ নিজ যোগ্যতা বা গুণ ও স্বাধীনতা অনুযায়ী কর্মকে পছন্দ করে নেয়াই হলো ‘বর্ণ’। এই কারণেই বৈদিক ধর্মকে অন্যভাবে ‘বর্ণাশ্রম ধর্ম’ও বলা হয়ে থাকে।

পবিত্র ঋগ্বেদ এর ৯.১১২.১ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“নানানাং বা উ ন ধিয়ো বি ব্রতানি জনানাম্।”
অর্থাৎ নানা জনের চিন্তা, মেধা ও বুদ্ধি নানারকম। আর সেই যোগ্যতা অনুসারেই তাদের ব্রত বা কর্ম নির্ধারিত হয়।

পবিত্র ঋগ্বেদ গ্রন্থের ১.১১৩.৬ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে (ব্রাহ্মন) অপরজন বীরত্বের গৌরবে (ক্ষত্রিয়), একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে (পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে (শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছা মাফিক পেশায়, সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত”।

পবিত্র ঋগ্বেদ গ্রন্থের ৯.১১২.১ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“একেক জনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বেশ্য, কেউ শূদ্র”।

অনেকের কাছে নাকি বেদশাস্ত্র কঠিন, বোধগম্যহীন, দুরুহ, তদুপরি বেদশাস্ত্রে না ঢুকেও বেদশাস্ত্রের সারসংক্ষেপ তথা সনাতনীদের প্রতিটি গৃহে বিদ্যমান শ্রীমদ্ভাগবতগীতাতেও বর্ণাশ্রম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।

চাতুর্বর্ণ্যম্, ময়া, সৃষ্টম্, গুণ-কর্ম-বিভাগশঃ,
তস্য, কর্তারম্, অপি, মাম্, বিদ্ধি, অকর্তারম্, অব্যয়ম্ ।। (শ্রীমদ্ভগবতগীতা ৪/১৩।।)
অনুবাদঃ- প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি । আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশং শূদ্রাণাঞ্চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণেঃ।।
(শ্রীমদ্ভগবতগীতা, ১৮/৪১)
অনুবাদঃ— হে পরন্তপ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তথা শূদ্রদের কর্ম স্বভাবজাত গুণ অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে।
এছাড়াও বৈদিক মৌলিক শাস্ত্রগ্রন্থের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ বা মনীষীদের জীবনবৃত্তান্তে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে, যেমন:
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৪.৪-৪.৯ এ বর্ণিত রয়েছে,
* পিতৃপরিচয়হীন পতিতার পুত্র সত্যকাম জাবাল নিজ গুণে কঠোর তপস্যা ও সাধনা শেষে ব্রহ্মত্ব অর্জন করেছিলেন, পরবর্তীতে ঋষি গৌতম্যের নিকট থেকে উপনয়ন নিয়ে বিখ্যাত ঋষি হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন।

* ঐতরেয় উপনিষদ ২.১৯ এ বর্ণিত রয়েছে,
একজন দাসের গর্ভে জন্ম নেওয়া একজন নিচু স্বভাব চরিত্রের অধিকারী হিসাবে পরিচিত কবশ ঔলূষ যিনি পরবর্তীতে কঠোর তপস্যা ও সাধনার ধারা ব্রহ্মত্ব অর্জন’সহ একজন স্বাত্ত্বিক ঋষিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি শুধু একজন ঋষি হিসেবেই সমাদৃত হননি বরং তাঁকে ঋষিদেরও আচার্য বলা হতো।

* মহর্ষি বিশ্বামিত্র, যিনি বিখ্যাত ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত, তিনি প্রথম জীবনে ক্ষত্রিয় গুণে গুণান্বিত ছিলেন এবং কান্যকুব্জের চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। পরবর্তীতে কঠোর তপস্যা ও সাধনা বলে ব্রহ্মত্ব অর্জন করে ঋষিতুল্য হয়েছেন। কিন্তু মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্রগণ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় শূদ্র হয়েছিল।
এছাড়াও মহর্ষি বাল্মিকী যিনি দস্যুবৃত্তি ও ডাকাতিকে তাঁর কর্ম হিসাবে বেছে নেন, পরবর্তীতে কঠোর তপস্যায় তিনি ঋষিতুল্য হয়ে উঠেন এবং বিখ্যাত গ্রন্থ রামায়ণ তাঁরই রচিত।
এরকম অসংখ্য প্রামাণিক দলিল শাস্ত্রগ্রন্থে রয়েছে যারা নিম্ন পর্যায়ের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েও কঠোর তপস্যা ও সাধনা দ্বারা উচ্চগুণে গুণান্বিত হয়ে সমাজের সমাদৃত করেছেন। আবার অনেকেই উচ্চগুণ থেকে নিজ কর্মদ্বারা নিম্নগুনে অধঃপতিত হয়েছিলেন, এছাড়াও ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষিতুল্য অনেকের পুত্রগণও তাদের নিম্নপর্যায়ের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় সমাজে নিন্দনীয় হয়েছিলেন।
সুতরাং বৈদিক শাস্ত্র মতে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় কে ব্রাহ্মণ, কে ক্ষত্রিয়, কে বৈশ্য বা কে শূদ্র হবে, তা কারোর জন্ম বা পরিবার দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং পবিত্র বেদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা মতে বর্ণাশ্রম নির্ধারিত হবে ব্যক্তির নিজের গুণ, যোগ্যতা ও স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী। (উল্লেখ্য যে, যেহেতু শাস্ত্র গ্রন্থের কোন বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বেদের সিদ্ধান্তই সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ও দলিল মর্মে প্রতীয়মান সেহেতু মুঘল আমল বা তার আগে পরে লেখা পৌরাণিক গ্রন্থগুলোর বিষয়ে কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন)
তবে কালের বিবর্তনে শাস্ত্রক্তো নিজ যোগ্যতাগুণে নির্ধারিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা জন্মভিত্তিক টাইটেল প্রথায় পরিগণিত হয়েছে, যদিও শাস্ত্রে জন্মভিত্তিক কোন বংশ বা কূল গৌরব প্রদর্শন প্রসঙ্গে বলা হয়নি, বরং বংশ বা কূল গৌরব সম্পর্কে শাস্ত্রক্তো প্রবাদ রয়েছে, “উপাধিঃ ব্যধিরেবচ” অর্থাৎ উপাধির অহং ব্যাধির ন্যায়।
তবে বংশ বা কূল সম্পর্কিত পূর্বতর বা পরবর্তী পিতৃপরুষ বা বংশধর সম্পর্কে ধারণায় বেদশাস্ত্রের কিছু কিছু অংশে গোত্রের ধারণা পাওয়া যায়। গোত্রের ধারণা মূলত বৈদিক ঋষি এবং তাঁদের বংশধরদের সাথে সম্পর্কিত। ঋগ্বেদীয় পরিভাষায়, গোত্র শব্দটির অর্থ হলো “সামনে এগিয়ে চলা বংশধর”। ছান্দোগ্য উপনিষদ অনুসারে গোত্র শব্দটির অর্থ পরিবার, বংশ, বা আত্মীয়গোষ্ঠী”।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে সাতজন প্রধান ঋষির কথা বর্ণিত আছে, যাদের বংশধররা বিভিন্ন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বলেই বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সাতজন ঋষি হলেন অত্রি, ভরদ্বাজ, গৌতম, জমদগ্নি, কশ্যপ, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র। বর্ণিত এই সাত জন ঋষি থেকে আরো ঋষি বংশের আবির্ভাব ও এই ঋষিদের নাম অনুসারেই গোত্রের নামকরণ করা হয়,যেমন কাশ্যপ গোত্র, বৈশিষ্ট্য গোত্র ইত্যাদি। এভাবেই ঋষি সন্তান হিসেবে ক্রমান্বয়ে মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে ও আমাদের সকলেই ঋষির সন্তান হিসেবে অমৃতের পুত্র হিসেবে শাস্ত্রে বর্ণিত রয়েছে। আর এই জন্যই বৈদিক শাস্ত্রের সমস্ত যাগ-যজ্ঞাদিতে “গোত্র” উল্লেখের মাধ্যমে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

বৈদিক শাস্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের মানব সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থাকে দৃঢ় করতে দ্রষ্টা ঋষিগন বিভিন্ন মন্ত্রের আত্মউপলব্ধি করেছেন, যেমন-
পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ১০.১৩.১ মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ” শোন হে বিশ্ববাসী, তোমরা সকলে অমৃতের সন্তান। অর্থাৎ পবিত্র বেদ বলছে সকলেই অমৃতের সন্তান।

পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ৫.৬০.৫ মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন
“অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতরো বাবৃন্ধুঃ” অর্থাৎ তোমরা সকলে ভাই ভাই, কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়।

পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ৯.১১২.১-৩ মন্ত্রে পরমাত্মা স্পষ্ট করে বলেছেন, বর্ণ হয় নিজের ইচ্ছায় ও কর্ম অনুসারে।

পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ১.১১৩.৬ মন্ত্রে পরমাত্মা বলছেন-
ক্ষত্রায় ত্বং শ্রবসে ত্বং মহীয়া ইষ্টয়ে ত্বমর্থমিব তুমিত্যৈ। বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ উষা অজিগর্ভুবনানি বিশ্বা।।
অর্থাৎ কেউ ক্ষাত্রবল, প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, কেউ মহাযজ্ঞাদি, ইষ্টকর্ম, কেউ অর্থ ব্যবস্থাপনা এভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবে গুণী জীবদের নিজ নিজ গুণ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের জন্য হে উষা, প্রতিনিয়ত জগতকে তুমি অন্ধকার হতে আলো দ্বারা জাগরিত করো।
এই মন্ত্রটির ‘বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ’ দ্বারা বলা হচ্ছে নিজ নিজ ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবগুণে কেউ ক্ষত্রিয় হয়ে প্রশাসক হয়, কেউ ব্রাহ্মণ হয়ে মহাযজ্ঞাদি পরিচালনা করে, কেউ অর্থব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত থেকে বৈশ্য হয়, ভিন্ন ভিন্ন গুণের মানুষ এভাবে প্রতিদিন উষাকালে অন্ধকার দূর হলে নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে কর্মে লিপ্ত হয়। এখানে বলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গুণ বা স্বভাব অনুসারে, বলা হয়নি জন্ম অনুসারে।

সুতরাং বেদশাস্ত্রের বর্ণাশ্রম ও প্রচলিত টাইটেল প্রথা এক অর্থবহ নয়, বরং বর্ণাশ্রম ও টাইটেল প্রথার মধ্যে শাস্ত্রীয় নিয়মনীতির বিরাট ব্যবধান বা অসামঞ্জস্য ও অশাস্ত্রীয়। কেননা বেদশাস্ত্রের আলোকে বর্ণাশ্রম হলো ব্যক্তির গুণ ও কর্মের সমন্বিত রূপ। বেদশাস্ত্রের চারটি খন্ড বা তত্ত্ব যেমন কোনটি থেকে কোনটি উচু বা নিচু নয় বা অসম-মর্যাদার নয়, ঠিক তেমনি বৈদিক সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মব্যবস্থা ও গুণের সমন্বিতরুপে চারটি বর্ণাশ্রম তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামক বিভাজিত বর্ণ কোনটি থেকে কোনটি উচু বা নিচু নয় বা অসম-মর্যাদার নয়। কর্মভেদের ভিন্নতা সমাজ ব্যবস্থায় আবশ্যিকভাবে থাকতেই হবে, কারন সবাই যদি একই শ্রেণীর কিংবা একই পেশাদার হয় তাহলে সমাজ ব্যবস্থা পূর্ণতা পাবেনা। তাই সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন’সহ সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নে একে অপরের সাথে বিনিময় ও সংযোগ স্থাপনে বর্ণাশ্রম ভিন্ন অন্য কিছুর সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে একে অপরের মধ্যে উঁচু-নিচু শ্রেণী নামক কোন তাত্ত্বিকতা নেই, বরং নিজেদের প্রয়োজনে একে অপরের পরিপূরক হওয়ার মাধ্যমে বৈদিক সমাজ তথা বৈদিক অর্থনীতি গড়ে ওঠে (কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র)।

পবিত্র ঋক্বেদে দেখা যায়, তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় একই পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের গুণ ও কর্মের অধিকারী হওয়ায় কারণে তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণাশ্রমের অধিকারী হতো। তাহলে এখানে স্পষ্ট তো বোঝা যায় শাস্ত্রে নির্দেশিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ও সমাজে প্রচলিত বর্ণপ্রথা এক বিষয় নয়। এই সহজ সত্যটি আজকের একবিংশো শতাব্দীতেও সনাতনী হিন্দুরা বুঝতে পারেনি কিংবা কেউ কেউ বুঝতেও চায় না!!

বুঝবেইবা কেমন করে, বেদ শাস্ত্রের অনেক মন্ত্র, শ্লোক, ঋক্ প্রভৃতি অনেকক্ষেত্রে রূপক অর্থে, কখনোবা সাংকেতিকভাবে, কখনোবা বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে! এগুলোকে সহজভাবে রপ্ত করতে না পারা এবং একই সাথে ব্যাখ্যাকারকগণের সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞানতা হেতু নিজের মতো করে শাস্ত্র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিষয়গুলোকে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলেছেন, যেমন: শাস্ত্রের ‘ছাগ’-কে ছাগল, ‘গো’- কে গরু বলে ব্যাখ্যা করে চলছে, শাস্ত্রীয় শব্দগুলোর তাত্ত্বিকতাপূর্ণ অর্থের প্রভেদ না বুঝে আপন মনে যা ইচ্ছে তাই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বেদ দুরূহ, বোধগম্য নয়, এই অনর্থক ব্যাখ্যা দিয়ে সনাতনীরা তাঁদের প্রধান ধর্মগ্রন্থকে যুগের পর যুগ, কালের পর কাল, আড়াল করে পিছন ফেলে রেখেছেন, ফলশ্রুতিতে বর্তমানে অসংখ্য পরিমাণ সনাতনী রয়েছে যারা সত্যিকার অর্থে তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদশাস্ত্রকে কোনদিন চোখেও দেখেনি, কোনদিন স্পর্শ করেনি, আর বেদের ভিতরে কি আছে তা জানার চেষ্টা তো বহুদূরে!!

সনাতনীরা সত্য সুন্দর দর্শন ছেড়ে পিপীলিকার মত আগুনে ঝাঁপ দেওয়া ন্যায় অপসংস্কৃতিকে শ্রেয় মনে করে, বর্তমানে টাইটেল বিষয়টি এমন এক মহামারী রূপ ধারণ করেছে যে, কারো নাম জিজ্ঞেস করলে নামের পরবর্তী অংশ অর্থাৎ লেজ নামক টাইটেল না বললে নাকি নামটিই পূর্ণ থাকে না!! এই টাইটেল নামক লেজ বিশেষণটি নামের পিছনে চাপিয়ে দেওয়া শাসক ব্যক্তির কলঙ্কময় অধ্যায় জড়িয়ে আছে, অথচ আমরা সগৌরবে সেই কলঙ্কটাকে আপন করে নিয়েছি এবং বৈদিক শাস্ত্রের নির্যাসকে দূরে ঠেলে দিয়েছি। কেউ কেউ আবার টাইটেল মুক্তকরন সম্পর্কিত কোন কথা শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে!! এই বুঝি সব ব্যবসা-বাণিজ্য, ধান্দাফিকির গেল!!

উপরের শাস্ত্রের প্রমাণাদি ও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বলা যায় “আপনা আপনি বেড়ে ওঠা আগাছা যেরূপ শস্যের জন্য হানিকর”, ঠিক তেমনি সনাতনী সমাজ ব্যবস্থার উপর দুই-চারশত বছর ধরে চেপে থাকা আগাছার স্তুপ সামগ্রিক বৈদিক শাস্ত্র ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। ক্রমান্বয়ে সনাতনীরা তাঁদের মূল শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে দূর থেকে দুরান্তরের দিকে ছুটছে। তাই নিড়ানী দিয়ে শস্যক্ষেত্রের আগাছা পরিষ্কারের মত বৈদিক শাস্ত্র ব্যবস্থার ওপর চাপে থাকা আগাছার স্তুপকেও সমূলে উৎপাটন করে ফেলতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না একসময়ে সমাজের চরম পর্যায়ের কুসংস্কার তথা সতীদাহ প্রথার মতো ঘৃণ্য ব্যাধিকেও সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
তাই সমাজ ব্যবস্থায় বর্ণাশ্রম (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) থাকবে কিন্তু টাইটেল প্রথা নামক আগাছার স্তুপ থাকা উচিত নয়।

পবিত্র যজুর্বেদ শাস্ত্রের ২৬/২ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্য্যায় চ স্বায় চারণায় চ।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভূয়াসময়ং
মে কামঃ সমৃধ্যতামুপমাদো নমতু ।।
অর্থাৎ ঈশ্বর উপদেশ দিচ্ছেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য, পুরুষ, স্ত্রী, সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মানুষকেই আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করেছি, তোমরাও সেইরূপ অন্যদের উপদেশ করো।

তাই সকলের জন্য একটি আদর্শ হওয়া উচিত, তা হলো নিজ গুণে, নিজ স্বাধীনতা, নিজ কর্ম করা; অর্থাৎ
ব্রাহ্মণ হও তবে ব্রাহ্মণ সাজিও না !
ক্ষত্রিয় হও তবে ক্ষত্রিয় সাজিও না!
বৈশ্য হও তবে বৈশ্য সাজিও না!
শুদ্র হও তবে শুদ্র সাজিও না!!

পবিত্র অথর্ববেদ শাস্ত্রের ৬.৬৪.২ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং ব্রতং সহ চিত্তমেষাম্। সমানেন বো হবিষা জুহোমি সমানং চেতো অভিসংবিশধ্বম্ ॥
অর্থাৎ তোমাদের চিন্তা-চেতনা এক হোক, তোমাদের মন এক হোক, তোমাদের সম্মেলন, আধ্যাত্মিকতা এক হোক, পান, ভোজন একসাথে হোক, সকলের লক্ষ্য এক হোক।

পরিশেষে সকলের নিকট আবেদন আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে সনাতনী সমাজকে সকল অশাস্ত্রীয় ব্যাধিমুক্ত করি!!

Tag :
জনপ্রিয়

কর্মীসভা কালিয়াকৈর পৌর বিএনপি’র ৮ নং ওয়ার্ড মাজুখান,

দেবাশিস সাহা :

হিন্দু সমাজ হোক টাইটেল ব্যাধি মুক্ত

প্রকাশিত ১২:২২:০০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২ অগাস্ট ২০২৫

শতসহস্র বছর দ্রষ্টা ঋষিদের ধ্যানলব্ধ নির্যাসিত জ্ঞান সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিফলনের মাধ্যমেই সনাতন ধর্ম তথা বৈদিক ধর্মের বিস্তার। তবে দ্রষ্টা ঋষিদের এই বিশুদ্ধ জ্ঞান বা বেদশাস্ত্রকে হৃদয়ঙ্গম ও যুগতর করার উদ্দেশ্যেকে কেন্দ্র করে কালের বিবর্তনে উৎপত্তি পৌরাণিক ব্যবস্থা কিংবা কখনো শাসক শ্রেণীর স্বার্থবাদমূলক মতবাদ গোটা সনাতনী সমাজ ও শাস্ত্রব্যবস্থাকে সূর্যগ্রহণের বলয়ের ন্যায় গ্রাস করেছে। যার অনন্য উদাহরণ শাস্ত্রীয় বর্ণাশ্রম, যা বর্তমানে টাইটেল প্রথায় পরিণত!

বর্তমান সনাতনী সমাজের অন্যতম বিষবৃক্ষ ও ৪০০ বছরের পুরনো ব্যাধি নামক প্রচলিত টাইটেল প্রথা হলো ব্যক্তির মূল নামের শেষে ব্যবহৃত শব্দ বা শব্দ সমষ্টি, যা বর্তমানে পদবীতে রূপান্তরিত। যেমন: চক্রবর্তী, ভট্টাচার্য, রায়, সরকার, দাস, সাহা, আচার্য, শিকদার, দে প্রভৃতি অসংখ্য টাইটেল তথা মূল নাম পরবর্তী অংশ হিন্দু সমাজে প্রচলিত রয়েছে। এই টাইটেল প্রথার আলোকেই এখন হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় বর্ণভেদ নির্ণয় তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্রকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
তবে হিন্দু সমাজ ব্যবস্থায় টাইটেল প্রথার প্রচলন সম্পর্কে ইতিহাসটা খুব একটা সুখকর নয়! যা ১৫১০ সালে আনন্দ ভট্ট রচিত ও ১৯০৪ সালে এশিয়াটিক সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া কর্তৃক প্রকাশিত “বল্লাল চরিত” নামক বইয়ে উল্লেখিত রয়েছে। উক্ত গ্রন্থের বর্ণনা অনুসারে, গৌড়ের বৈদ্য বংশীয় অবাঙালি রাজা বল্লাল সেন (১১৫৮-১১৭৯ সাল) নিজ সহধর্মিণী থাকা অবস্থায় অধিক বয়সে পদ্মিনী নাম্নী এক সুন্দরী নর্তকীকে বিবাহ করেন। এতে রাজ্যজুড়ে রাজার সুনাম বিনষ্ট হয় এবং এ বিষয় প্রজারা নানারকম সমালোচনা করতে থাকেন। রাজা এই কলঙ্ক থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য সকল প্রজাদের উদ্দেশ্য একটি ভোজ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। রাজার এই কুকীর্তির বিষয়টি অনেকেই সহজভাবে গ্রহণের অস্বীকৃতির কারণে উক্ত অনুষ্ঠানে অনেকেই উপস্থিত হলেন না, এতে রাজা বল্লাল সেন মনস্তাত্ত্বিকভাবে ভীষণ অসন্তুষ্ট হন।
রাজার এই মনস্তাত্ত্বিক অসন্তুষ্টি হেতু যারা রাজার আনুগত্য হয়ে ভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন তাদেরকে বিভিন্ন নামে কৌলীন্য বা টাইটেল দান আর অনুপস্থিত প্রজাদের চন্ডাল, চামারসুলভ কু-বিশেষনে আখ্যায়িত করলেন। (তথ্যসূত্রঃ সমাজদর্পণ ১৫ বর্ষ, সংখ্যা ১২;জুন ১৯৯৯)।
এছাড়াও যেহেতু সেন বংশের রাজারা বাঙালি ছিল না কিন্তু হিন্দু বাঙ্গালীদের শাসন করতে হবে, তাই প্রজাদের মধ্যে একটা বৈষম্য সৃষ্টির মাধ্যমে একে অপরের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি ও রাজ্য ক্ষমতায়নকে সহজতর করার পরিকল্পনাও ছক আঁকা হয়, যা এই টাইটেল প্রথার বিস্তারের মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়।
রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক টাইটেল প্রথার প্রবর্তনে টাইটেলগুলোর তাত্ত্বিকতা বিশ্লেষণে দেখা যায়-
* রাজদরবারে রাজা এবং গন্যমান্য সভাসদগনের উপস্থিতিতে বেদ ও শাস্ত্রধর্মের ব‍্যাখ‍্যা বিশ্লেষণ করে আয়োজিত সভা বা চক্রে কাজটি করতেন বলে তাকে চক্রবর্তী বলা হতো। রাজা বল্লাল সেন তার প্রজাদের মধ্যে যারা এই চক্রবর্তী টাইটেলধারী তাদেরকে ব্রাহ্মণ উপাধি দিয়েছেন। যদিও প্রাচীনকালে চক্রবর্তী শব্দটি সার্বভৌম রাজা বা সম্রাটদের বোঝাতে ব্যবহৃত হতো। যিনি রথের চাকা (চক্র) ঘুরিয়ে রাজ্য জয় করেন, তিনিই চক্রবর্তী।

* সরকার, যারা জমিজমার মালিক, ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা। অর্থ আদায় ও ব্যয় সংক্রান্ত কর্মচারীও সরকার । প্রধান কর্মচারী এবং সম্পত্তি দেখাশোনার কাজে নিয়োজিত ব্যাক্তিকেও সরকার বলা হতো। তাই এই সরকার টাইটেলধারীদের মধ্যে বৈশ্য এবং শুদ্র উভয়ের উপাধি দেওয়া হয়।

* মজুমদার, যাদের কাজ ছিল হিসাবপত্র রক্ষা করা, অনেকটা ট্রেজারার কিংবা অডিট সুপারের মতো। এদেরকে মজুমদার টাইটেল দিয়ে বৈশ্য এবং শুদ্র উভয়ের উপাধি দেওয়া হয়, তবে এদের মধ্যেও কিছু লোক তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় পূজা অর্চনাদিতে প্রাধান্য পাওয়ায় তাদেরকে ব্রাহ্মণের উপাধিও দিয়েছেন।

* আরবি ‘শিক’ হলো একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ এর সঙ্গে ফারসী ‘দার’ যুক্ত হয়ে শিকদার শব্দের উদ্ভব । যাদের কাজ ছিল আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করা। তাদের শিকদার টাইটেল প্রদান করে তৎকালীন ক্ষত্রিয় হিসেবে উপাধি দিয়েছেন, যদিও পরবর্তীতে তাঁরা আর ওই পর্যায়ে থাকেনি।

* ধর্মের উপদেষ্টা, বৈষ্ণব ও ভক্তশ্রেষ্ঠ ছিলেন তাদেরকে গোস্বামী টাইটেল দিয়ে তাদেরকেও ব্রাহ্মণের উপাধি দিয়েছেন।

* বাংলার বণিকজাতি তথা ব্যবসা বাণিজ্যে সমৃদ্ধ পরিচয়জ্ঞাপকদের উপাধি দেয়া হলো সাহা।

* মাঝি বা জেলে সম্প্রদায়ের মধ্যে উপাধি দেয়া হলো হালদার।

* তাঁত শিল্পী কিংবা তাঁতের কাপড় তাঁতরের কাপড় তৈরি ও ব‍্যবসা ইত‍্যাদি যাদের পেশা তারা তন্তুবায় বা তাঁতি নামে পরিচিত। ভিন্নতা ভেদে তন্তবায়দের মধ্যে কয়েক শ্রেণী করে বসাক, শেঠ, মল্লিক, হালদার ইত্যাদি। তাদেরকে বৈশ্য উপাধি দিয়েছেন।

* বিশ্বাস, নবাবি আমলের পেশাগত পদবী । বিশ্বস্ত প্ৰতিনিধি, মোক্তার বা উকিল হিসেবে তিনি নবাব দরবারে রাজা বা জমিদারের পক্ষে বিশ্বস্ততার সাথে দায়িত্ব পালন করতেন বিধায় তাদেরকে বিশ্বাস টাইটেল ও শুদ্র উপাধি দিয়েছেন।

* দত্ত শব্দের অর্থ দেওয়া। দান-দক্ষিণায় উদার, ব্যবসা-বাণিজ্যে দক্ষতা হেতু তাদেরকে দত্ত টাইটেল ও বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়।

* মোদক খুব প্রাচীন পদবী নয়, যারা মোয়া বা চিড়া, মুড়ি, খই, বাতাসা, মিষ্টি তৈরি করত তাদের মোদক বলা হতো। এই টাইটেলধারীদের বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়।

* হিন্দু রাজা, জমিদার, রাজপুত্র, রাজপুরুষ ও জমিদারদের সাধারণ উপাধি হিসেবে রায় শব্দ ব্যবহৃত হতো বিধায় তাদেরকে বিভিন্ন পর্যায়ে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়েছিল।

* যে ব্যক্তি বাজারে বা আড়তে ধানচাল ইত্যাদি ওজন করে মূলত তাদের পদবী কয়াল। শস্য সংগ্রহকারী ও শস্য রক্ষণকারী হিসেবেও কয়াল পরিচিতি দিয়ে তাদেরকেও বৈশ্য উপাধি দেওয়া হয়।

* প্রামানিক, যারা রাজু দরবারের প্রমাণপত্র উপস্থিত করতো অর্থাৎ সাক্ষী। বিবাহ থেকে শুরু করে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সামাজিক সাক্ষ্য রাখা হতো, কারণ লেখালেখির ব্যাপারটা ছিল সীমিত। তাদেরকে প্রামানিক টাইটেল ও কখনো বৈশ্য কখনো শুদ্র হিসাবে উপাধি দিয়েছেন।

* ভৌমিক, এটি ভূমি সংশ্লিষ্ট পদবী। এরা অতীতে সামন্তরাজ, জমিদার, জোতদার, ভূস্বামী হিসাবে কাজ করতো। তাদেরকে ভৌমিক টাইটেল দিয়ে বৈশ্য হিসাবে উপাধি দিয়েছেন।
উল্লেখিত টাইটেলগুলোর মত আরো অসংখ্য টাইটেল সমাজ ব্যবস্থায় প্রচলন রয়েছে, যাদেরকে রাজা বল্লাল সেন নিজ দায়িত্বে বিভিন্ন উপাধি দিয়ে নিজে কলঙ্কমুক্ত হয়েছিলেন এবং সেই চাপিয়ে দেওয়া অপসংস্কৃতিমূলক উপাধিগুলোকে আমরা এখনও সগৌরবে লালন করে যাচ্ছি। (তথ্য সূত্র-১.আমাদের পদবীর ইতিহাস- লোকেশ্বর বসু। ২.পদবীর উৎসসন্ধান- সমর পাল)।

তবে উল্লেখ থাকে যে বৈদিক সমাজ ব্যবস্থায় দ্রষ্টা ঋষিগণ, অবতার, মহামানব, মহাপুরুষ প্রভৃতি মহামনীষীগণ কারোরই নামের পরে কোন টাইটেল ছিলনা, যেমন- শ্রীরামচন্দ্র, শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীবলরাম, ঋষি বশিষ্ট, ঋষি মরীচি, ঋষি পুলস্ত্য, ঋষি পুলহ, ঋষি অত্রি, ঋষি অঙ্গিরা, ঋষি বিশ্বামিত্র, ঋষি ব্যাস, ঋষি ভরদ্বাজ, যুধিষ্ঠির, অর্জুন, শ্রীশঙ্করাচার্য, শ্রীচৈতন্য প্রমুখ।

আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে ব্যক্তির মূল নামের সঙ্গে সংযুক্ত যে শব্দটি বৈদিক সমাজে সর্বমহলে সমাদৃত ছিল সেই ‘শ্রী’ শব্দটি এখন আর খুব একটা ব্যবহার হয় না। তবে রাজা বল্লাল সেন কর্তৃক প্রচলিত সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী টাইটেল প্রথা খুব ভালোভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এছাড়াও বৈদিক যুগ হতে মহাভারতের যুগ, এমনকি শংকরাচার্য যুগেও ব্যক্তির নামের সাথে তাঁর পিতা/মাতার নামের অংশ সংযোগের প্রচলন ছিল, সেটাও এখন আর সনাতনী সমাজে প্রচলন নেই , যেমন: বসুদেবপুত্র শ্রীকৃষ্ণ, পাণ্ডপুত্র অর্জুন, পাণ্ডপুত্র যুধিষ্ঠির, দশরথপুত্র শ্রীরামচন্দ্র, সুবলপুত্র শকুনি, শান্তনুপুত্র ভীষ্ম, ধ্রুপদকন্যা দ্রৌপদী ইত্যাদি। তাই যদি বৈদিক শাস্ত্র অনুযায়ী সনাতনীদের নামকরন করা হতো তাহলে সনাতনীদের নামগুলো এইরকম হতো যেমন: দেবাশিসপুত্র শ্রী পৃথ্বিরাজ, কিংবা রনদাপুত্র শ্রী দেবাশিস প্রভৃতি।
কিন্তু এই গুরুত্ববহ শাস্ত্রীয় তত্ত্বটি হিন্দু সমাজে ব্যবহৃত না হলেও আরব্য সমাজ ব্যবস্থায় তথা মুসলিম সম্প্রদায় বিষয়টিকে খুব ভালোভাবে নিজেদের মধ্যে রপ্ত করেছে, আরব্য সমাজে সন্তানের নামকরণে পিতা/মাতার নামের অংশ সংযোগ রেখে সন্তানের নামকরণ করা হয়, যেমন: মোহাম্মদ রাশেদ বিন ইউসুফ অর্থাৎ রাশেদের পুত্র ইউসুফ (ছেলেদের ক্ষেত্রে), মোসাম্মৎ রাশেদ বিনতে নাজমা অর্থাৎ রাশেদের কন্যা নাজমা (মেয়েদের ক্ষেত্রে) ইত্যাদি। এভাবেই বৈদিক শাস্ত্রের উত্তম দিকগুলোকে বর্জন করে অধঃগামী দিকগুলোকে সনাতনীরা সহজেই আপন করে নিয়েছে, তারই একটা উদাহরণ টাইটেল প্রথা। যদিও টাইটেল প্রথা বা বর্ণপ্রথা বা বর্ণবাদ বলতে শাস্ত্রে কোনকিছু নেই, যা আছে তা হলো বর্ণাশ্রম।
শাস্ত্রর নিরুক্ত ২।৩ বলা হয়েছে, “বর্ণো বৃণোতেঃ”-
পাণিনীয় ধাতুপাঠের স্বাদিগণে ‘বৃ’ ধাতুর অর্থ দেওয়া সংবরণ (বৃ সংবরণে)। অর্থাৎ ‘বৃ’ ধাতু থেকে নিষ্পন্ন বর্ণ শব্দটির ধাত্বার্থক ব্যুৎপত্তিগত অর্থ থেকেই বোঝা যায় ‘বর্ণ’ শব্দটি বরণ করে নেওয়া অর্থাৎ নিজে বেছে নেওয়া অর্থ প্রকাশ করে। অর্থাৎ নিজের ইচ্ছায় যে ব্রত বা কর্ম পছন্দ করে বেছে নেয়া হয় তাহাই ‘বর্ণ’।

নিরুক্ত ২/১৩ এ বলা হয়েছে,
“ব্রতমিতি কর্ম্মনাম বৃণোতীতি সতঃ”।
ব্রতম শব্দটি কর্মের নাম, যেহেতু ‘বৃ’ ধাতু দ্বারা আবৃত করা অর্থ প্রকাশ করে, আর তা বেছে নেওয়ায় বর্ণ। তাই শাস্ত্রক্তো বর্ণ শব্দের শাব্দিক অর্থ বরণ করে নেওয়া বা পছন্দ করা, অর্থাৎ নিজ যোগ্যতা বা গুণ ও স্বাধীনতা অনুযায়ী কর্মকে পছন্দ করে নেয়াই হলো ‘বর্ণ’। এই কারণেই বৈদিক ধর্মকে অন্যভাবে ‘বর্ণাশ্রম ধর্ম’ও বলা হয়ে থাকে।

পবিত্র ঋগ্বেদ এর ৯.১১২.১ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“নানানাং বা উ ন ধিয়ো বি ব্রতানি জনানাম্।”
অর্থাৎ নানা জনের চিন্তা, মেধা ও বুদ্ধি নানারকম। আর সেই যোগ্যতা অনুসারেই তাদের ব্রত বা কর্ম নির্ধারিত হয়।

পবিত্র ঋগ্বেদ গ্রন্থের ১.১১৩.৬ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“একজন জ্ঞানের উচ্চ পথে (ব্রাহ্মন) অপরজন বীরত্বের গৌরবে (ক্ষত্রিয়), একজন তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যে (পেশাভিত্তিক), আরেকজন সেবার পরিশ্রমে (শূদ্র)। সকলেই তার ইচ্ছা মাফিক পেশায়, সকলের জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত”।

পবিত্র ঋগ্বেদ গ্রন্থের ৯.১১২.১ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“একেক জনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ ক্ষত্রিয়, কেউ বেশ্য, কেউ শূদ্র”।

অনেকের কাছে নাকি বেদশাস্ত্র কঠিন, বোধগম্যহীন, দুরুহ, তদুপরি বেদশাস্ত্রে না ঢুকেও বেদশাস্ত্রের সারসংক্ষেপ তথা সনাতনীদের প্রতিটি গৃহে বিদ্যমান শ্রীমদ্ভাগবতগীতাতেও বর্ণাশ্রম সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়া হয়েছে।

চাতুর্বর্ণ্যম্, ময়া, সৃষ্টম্, গুণ-কর্ম-বিভাগশঃ,
তস্য, কর্তারম্, অপি, মাম্, বিদ্ধি, অকর্তারম্, অব্যয়ম্ ।। (শ্রীমদ্ভগবতগীতা ৪/১৩।।)
অনুবাদঃ- প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানব-সমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি । আমি এই প্রথার স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।

ব্রাহ্মণক্ষত্রিয়বিশং শূদ্রাণাঞ্চ পরন্তপ।
কর্মাণি প্রবিভক্তানি স্বভাবপ্রভবৈর্গুণেঃ।।
(শ্রীমদ্ভগবতগীতা, ১৮/৪১)
অনুবাদঃ— হে পরন্তপ! ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য তথা শূদ্রদের কর্ম স্বভাবজাত গুণ অনুযায়ী ভাগ করা হয়েছে।
এছাড়াও বৈদিক মৌলিক শাস্ত্রগ্রন্থের বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহ বা মনীষীদের জীবনবৃত্তান্তে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান রয়েছে, যেমন:
ছান্দোগ্য উপনিষদ ৪.৪-৪.৯ এ বর্ণিত রয়েছে,
* পিতৃপরিচয়হীন পতিতার পুত্র সত্যকাম জাবাল নিজ গুণে কঠোর তপস্যা ও সাধনা শেষে ব্রহ্মত্ব অর্জন করেছিলেন, পরবর্তীতে ঋষি গৌতম্যের নিকট থেকে উপনয়ন নিয়ে বিখ্যাত ঋষি হিসেবে সমাদৃত হয়েছিলেন।

* ঐতরেয় উপনিষদ ২.১৯ এ বর্ণিত রয়েছে,
একজন দাসের গর্ভে জন্ম নেওয়া একজন নিচু স্বভাব চরিত্রের অধিকারী হিসাবে পরিচিত কবশ ঔলূষ যিনি পরবর্তীতে কঠোর তপস্যা ও সাধনার ধারা ব্রহ্মত্ব অর্জন’সহ একজন স্বাত্ত্বিক ঋষিতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি শুধু একজন ঋষি হিসেবেই সমাদৃত হননি বরং তাঁকে ঋষিদেরও আচার্য বলা হতো।

* মহর্ষি বিশ্বামিত্র, যিনি বিখ্যাত ব্রাহ্মণ হিসেবে পরিচিত, তিনি প্রথম জীবনে ক্ষত্রিয় গুণে গুণান্বিত ছিলেন এবং কান্যকুব্জের চন্দ্রবংশীয় রাজা ছিলেন। পরবর্তীতে কঠোর তপস্যা ও সাধনা বলে ব্রহ্মত্ব অর্জন করে ঋষিতুল্য হয়েছেন। কিন্তু মহর্ষি বিশ্বামিত্রের পুত্রগণ বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় শূদ্র হয়েছিল।
এছাড়াও মহর্ষি বাল্মিকী যিনি দস্যুবৃত্তি ও ডাকাতিকে তাঁর কর্ম হিসাবে বেছে নেন, পরবর্তীতে কঠোর তপস্যায় তিনি ঋষিতুল্য হয়ে উঠেন এবং বিখ্যাত গ্রন্থ রামায়ণ তাঁরই রচিত।
এরকম অসংখ্য প্রামাণিক দলিল শাস্ত্রগ্রন্থে রয়েছে যারা নিম্ন পর্যায়ের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়েও কঠোর তপস্যা ও সাধনা দ্বারা উচ্চগুণে গুণান্বিত হয়ে সমাজের সমাদৃত করেছেন। আবার অনেকেই উচ্চগুণ থেকে নিজ কর্মদ্বারা নিম্নগুনে অধঃপতিত হয়েছিলেন, এছাড়াও ব্রহ্মজ্ঞানী ঋষিতুল্য অনেকের পুত্রগণও তাদের নিম্নপর্যায়ের স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হওয়ায় সমাজে নিন্দনীয় হয়েছিলেন।
সুতরাং বৈদিক শাস্ত্র মতে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থায় কে ব্রাহ্মণ, কে ক্ষত্রিয়, কে বৈশ্য বা কে শূদ্র হবে, তা কারোর জন্ম বা পরিবার দ্বারা নির্ধারিত হয় না, বরং পবিত্র বেদের সুস্পষ্ট নির্দেশনা মতে বর্ণাশ্রম নির্ধারিত হবে ব্যক্তির নিজের গুণ, যোগ্যতা ও স্বাধীন ইচ্ছানুযায়ী। (উল্লেখ্য যে, যেহেতু শাস্ত্র গ্রন্থের কোন বিষয়ে ভিন্নতা থাকলে বেদের সিদ্ধান্তই সর্বশ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত ও দলিল মর্মে প্রতীয়মান সেহেতু মুঘল আমল বা তার আগে পরে লেখা পৌরাণিক গ্রন্থগুলোর বিষয়ে কোন মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন)
তবে কালের বিবর্তনে শাস্ত্রক্তো নিজ যোগ্যতাগুণে নির্ধারিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা জন্মভিত্তিক টাইটেল প্রথায় পরিগণিত হয়েছে, যদিও শাস্ত্রে জন্মভিত্তিক কোন বংশ বা কূল গৌরব প্রদর্শন প্রসঙ্গে বলা হয়নি, বরং বংশ বা কূল গৌরব সম্পর্কে শাস্ত্রক্তো প্রবাদ রয়েছে, “উপাধিঃ ব্যধিরেবচ” অর্থাৎ উপাধির অহং ব্যাধির ন্যায়।
তবে বংশ বা কূল সম্পর্কিত পূর্বতর বা পরবর্তী পিতৃপরুষ বা বংশধর সম্পর্কে ধারণায় বেদশাস্ত্রের কিছু কিছু অংশে গোত্রের ধারণা পাওয়া যায়। গোত্রের ধারণা মূলত বৈদিক ঋষি এবং তাঁদের বংশধরদের সাথে সম্পর্কিত। ঋগ্বেদীয় পরিভাষায়, গোত্র শব্দটির অর্থ হলো “সামনে এগিয়ে চলা বংশধর”। ছান্দোগ্য উপনিষদ অনুসারে গোত্র শব্দটির অর্থ পরিবার, বংশ, বা আত্মীয়গোষ্ঠী”।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে সাতজন প্রধান ঋষির কথা বর্ণিত আছে, যাদের বংশধররা বিভিন্ন গোত্রের অন্তর্ভুক্ত বলেই বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রমাণ পাওয়া যায়। এই সাতজন ঋষি হলেন অত্রি, ভরদ্বাজ, গৌতম, জমদগ্নি, কশ্যপ, বশিষ্ঠ ও বিশ্বামিত্র। বর্ণিত এই সাত জন ঋষি থেকে আরো ঋষি বংশের আবির্ভাব ও এই ঋষিদের নাম অনুসারেই গোত্রের নামকরণ করা হয়,যেমন কাশ্যপ গোত্র, বৈশিষ্ট্য গোত্র ইত্যাদি। এভাবেই ঋষি সন্তান হিসেবে ক্রমান্বয়ে মানব সভ্যতা গড়ে ওঠে ও আমাদের সকলেই ঋষির সন্তান হিসেবে অমৃতের পুত্র হিসেবে শাস্ত্রে বর্ণিত রয়েছে। আর এই জন্যই বৈদিক শাস্ত্রের সমস্ত যাগ-যজ্ঞাদিতে “গোত্র” উল্লেখের মাধ্যমে ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

বৈদিক শাস্ত্রের বিভিন্ন পর্যায়ের মানব সভ্যতা ও সমাজব্যবস্থাকে দৃঢ় করতে দ্রষ্টা ঋষিগন বিভিন্ন মন্ত্রের আত্মউপলব্ধি করেছেন, যেমন-
পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ১০.১৩.১ মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
“শৃন্বন্তু বিশ্বে অমৃতস্য পুত্রাঃ” শোন হে বিশ্ববাসী, তোমরা সকলে অমৃতের সন্তান। অর্থাৎ পবিত্র বেদ বলছে সকলেই অমৃতের সন্তান।

পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ৫.৬০.৫ মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন
“অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাস এতে সং ভ্রাতরো বাবৃন্ধুঃ” অর্থাৎ তোমরা সকলে ভাই ভাই, কেউ ছোট নয়, কেউ বড় নয়।

পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ৯.১১২.১-৩ মন্ত্রে পরমাত্মা স্পষ্ট করে বলেছেন, বর্ণ হয় নিজের ইচ্ছায় ও কর্ম অনুসারে।

পবিত্র গ্রন্থ ঋগ্বেদের ১.১১৩.৬ মন্ত্রে পরমাত্মা বলছেন-
ক্ষত্রায় ত্বং শ্রবসে ত্বং মহীয়া ইষ্টয়ে ত্বমর্থমিব তুমিত্যৈ। বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ উষা অজিগর্ভুবনানি বিশ্বা।।
অর্থাৎ কেউ ক্ষাত্রবল, প্রশাসন, রাষ্ট্র পরিচালনা, কেউ মহাযজ্ঞাদি, ইষ্টকর্ম, কেউ অর্থ ব্যবস্থাপনা এভাবে ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবে গুণী জীবদের নিজ নিজ গুণ অনুযায়ী কর্ম সম্পাদনের জন্য হে উষা, প্রতিনিয়ত জগতকে তুমি অন্ধকার হতে আলো দ্বারা জাগরিত করো।
এই মন্ত্রটির ‘বিসদৃশা জীবিতাভিপ্রচক্ষ’ দ্বারা বলা হচ্ছে নিজ নিজ ভিন্ন ভিন্ন স্বভাবগুণে কেউ ক্ষত্রিয় হয়ে প্রশাসক হয়, কেউ ব্রাহ্মণ হয়ে মহাযজ্ঞাদি পরিচালনা করে, কেউ অর্থব্যবস্থাপনার সাথে জড়িত থেকে বৈশ্য হয়, ভিন্ন ভিন্ন গুণের মানুষ এভাবে প্রতিদিন উষাকালে অন্ধকার দূর হলে নিজ নিজ স্বভাব অনুসারে কর্মে লিপ্ত হয়। এখানে বলা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন গুণ বা স্বভাব অনুসারে, বলা হয়নি জন্ম অনুসারে।

সুতরাং বেদশাস্ত্রের বর্ণাশ্রম ও প্রচলিত টাইটেল প্রথা এক অর্থবহ নয়, বরং বর্ণাশ্রম ও টাইটেল প্রথার মধ্যে শাস্ত্রীয় নিয়মনীতির বিরাট ব্যবধান বা অসামঞ্জস্য ও অশাস্ত্রীয়। কেননা বেদশাস্ত্রের আলোকে বর্ণাশ্রম হলো ব্যক্তির গুণ ও কর্মের সমন্বিত রূপ। বেদশাস্ত্রের চারটি খন্ড বা তত্ত্ব যেমন কোনটি থেকে কোনটি উচু বা নিচু নয় বা অসম-মর্যাদার নয়, ঠিক তেমনি বৈদিক সমাজ ব্যবস্থাকে সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালনার জন্য বিভিন্ন কর্মব্যবস্থা ও গুণের সমন্বিতরুপে চারটি বর্ণাশ্রম তথা ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র নামক বিভাজিত বর্ণ কোনটি থেকে কোনটি উচু বা নিচু নয় বা অসম-মর্যাদার নয়। কর্মভেদের ভিন্নতা সমাজ ব্যবস্থায় আবশ্যিকভাবে থাকতেই হবে, কারন সবাই যদি একই শ্রেণীর কিংবা একই পেশাদার হয় তাহলে সমাজ ব্যবস্থা পূর্ণতা পাবেনা। তাই সমাজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন’সহ সামগ্রীক জীবন ব্যবস্থার উন্নয়নে একে অপরের সাথে বিনিময় ও সংযোগ স্থাপনে বর্ণাশ্রম ভিন্ন অন্য কিছুর সুযোগ নেই। এক্ষেত্রে একে অপরের মধ্যে উঁচু-নিচু শ্রেণী নামক কোন তাত্ত্বিকতা নেই, বরং নিজেদের প্রয়োজনে একে অপরের পরিপূরক হওয়ার মাধ্যমে বৈদিক সমাজ তথা বৈদিক অর্থনীতি গড়ে ওঠে (কৌটিল্য অর্থশাস্ত্র)।

পবিত্র ঋক্বেদে দেখা যায়, তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থায় একই পরিবারের বিভিন্ন ব্যক্তি বিভিন্ন ধরনের গুণ ও কর্মের অধিকারী হওয়ায় কারণে তারা প্রত্যেকেই ভিন্ন ভিন্ন বর্ণাশ্রমের অধিকারী হতো। তাহলে এখানে স্পষ্ট তো বোঝা যায় শাস্ত্রে নির্দেশিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা ও সমাজে প্রচলিত বর্ণপ্রথা এক বিষয় নয়। এই সহজ সত্যটি আজকের একবিংশো শতাব্দীতেও সনাতনী হিন্দুরা বুঝতে পারেনি কিংবা কেউ কেউ বুঝতেও চায় না!!

বুঝবেইবা কেমন করে, বেদ শাস্ত্রের অনেক মন্ত্র, শ্লোক, ঋক্ প্রভৃতি অনেকক্ষেত্রে রূপক অর্থে, কখনোবা সাংকেতিকভাবে, কখনোবা বিভিন্ন উপমার মাধ্যমে দেখানো হয়েছে! এগুলোকে সহজভাবে রপ্ত করতে না পারা এবং একই সাথে ব্যাখ্যাকারকগণের সংস্কৃত ভাষা সম্পর্কে অজ্ঞানতা হেতু নিজের মতো করে শাস্ত্র ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বিষয়গুলোকে জটিল থেকে জটিলতর করে ফেলেছেন, যেমন: শাস্ত্রের ‘ছাগ’-কে ছাগল, ‘গো’- কে গরু বলে ব্যাখ্যা করে চলছে, শাস্ত্রীয় শব্দগুলোর তাত্ত্বিকতাপূর্ণ অর্থের প্রভেদ না বুঝে আপন মনে যা ইচ্ছে তাই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
বেদ দুরূহ, বোধগম্য নয়, এই অনর্থক ব্যাখ্যা দিয়ে সনাতনীরা তাঁদের প্রধান ধর্মগ্রন্থকে যুগের পর যুগ, কালের পর কাল, আড়াল করে পিছন ফেলে রেখেছেন, ফলশ্রুতিতে বর্তমানে অসংখ্য পরিমাণ সনাতনী রয়েছে যারা সত্যিকার অর্থে তাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদশাস্ত্রকে কোনদিন চোখেও দেখেনি, কোনদিন স্পর্শ করেনি, আর বেদের ভিতরে কি আছে তা জানার চেষ্টা তো বহুদূরে!!

সনাতনীরা সত্য সুন্দর দর্শন ছেড়ে পিপীলিকার মত আগুনে ঝাঁপ দেওয়া ন্যায় অপসংস্কৃতিকে শ্রেয় মনে করে, বর্তমানে টাইটেল বিষয়টি এমন এক মহামারী রূপ ধারণ করেছে যে, কারো নাম জিজ্ঞেস করলে নামের পরবর্তী অংশ অর্থাৎ লেজ নামক টাইটেল না বললে নাকি নামটিই পূর্ণ থাকে না!! এই টাইটেল নামক লেজ বিশেষণটি নামের পিছনে চাপিয়ে দেওয়া শাসক ব্যক্তির কলঙ্কময় অধ্যায় জড়িয়ে আছে, অথচ আমরা সগৌরবে সেই কলঙ্কটাকে আপন করে নিয়েছি এবং বৈদিক শাস্ত্রের নির্যাসকে দূরে ঠেলে দিয়েছি। কেউ কেউ আবার টাইটেল মুক্তকরন সম্পর্কিত কোন কথা শুনলেই তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে!! এই বুঝি সব ব্যবসা-বাণিজ্য, ধান্দাফিকির গেল!!

উপরের শাস্ত্রের প্রমাণাদি ও বর্তমান সামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে বলা যায় “আপনা আপনি বেড়ে ওঠা আগাছা যেরূপ শস্যের জন্য হানিকর”, ঠিক তেমনি সনাতনী সমাজ ব্যবস্থার উপর দুই-চারশত বছর ধরে চেপে থাকা আগাছার স্তুপ সামগ্রিক বৈদিক শাস্ত্র ব্যবস্থাকে ধ্বংসের দিকে ধাবিত করছে। ক্রমান্বয়ে সনাতনীরা তাঁদের মূল শাস্ত্রগ্রন্থ থেকে দূর থেকে দুরান্তরের দিকে ছুটছে। তাই নিড়ানী দিয়ে শস্যক্ষেত্রের আগাছা পরিষ্কারের মত বৈদিক শাস্ত্র ব্যবস্থার ওপর চাপে থাকা আগাছার স্তুপকেও সমূলে উৎপাটন করে ফেলতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না একসময়ে সমাজের চরম পর্যায়ের কুসংস্কার তথা সতীদাহ প্রথার মতো ঘৃণ্য ব্যাধিকেও সমাজ থেকে বিতাড়িত করা হয়েছিল।
তাই সমাজ ব্যবস্থায় বর্ণাশ্রম (ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র) থাকবে কিন্তু টাইটেল প্রথা নামক আগাছার স্তুপ থাকা উচিত নয়।

পবিত্র যজুর্বেদ শাস্ত্রের ২৬/২ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
যথেমাং বাচং কল্যাণীমাবদানি জনেভ্যঃ।
ব্রহ্ম রাজন্যাভ্যাং শূদ্রায়চার্য্যায় চ স্বায় চারণায় চ।।
প্রিয়ো দেবানাং দক্ষিণায়ৈ দাতুরিহ ভূয়াসময়ং
মে কামঃ সমৃধ্যতামুপমাদো নমতু ।।
অর্থাৎ ঈশ্বর উপদেশ দিচ্ছেন ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, শূদ্র, বৈশ্য, পুরুষ, স্ত্রী, সেবকাদি এবং অন্যান্য সকল মানুষকেই আমি এই মঙ্গলদায়িনী বেদবাণীর উপদেশ দান করেছি, তোমরাও সেইরূপ অন্যদের উপদেশ করো।

তাই সকলের জন্য একটি আদর্শ হওয়া উচিত, তা হলো নিজ গুণে, নিজ স্বাধীনতা, নিজ কর্ম করা; অর্থাৎ
ব্রাহ্মণ হও তবে ব্রাহ্মণ সাজিও না !
ক্ষত্রিয় হও তবে ক্ষত্রিয় সাজিও না!
বৈশ্য হও তবে বৈশ্য সাজিও না!
শুদ্র হও তবে শুদ্র সাজিও না!!

পবিত্র অথর্ববেদ শাস্ত্রের ৬.৬৪.২ নং মন্ত্রে পরমাত্মা বলেছেন,
সমানো মন্ত্রঃ সমিতিঃ সমানী সমানং ব্রতং সহ চিত্তমেষাম্। সমানেন বো হবিষা জুহোমি সমানং চেতো অভিসংবিশধ্বম্ ॥
অর্থাৎ তোমাদের চিন্তা-চেতনা এক হোক, তোমাদের মন এক হোক, তোমাদের সম্মেলন, আধ্যাত্মিকতা এক হোক, পান, ভোজন একসাথে হোক, সকলের লক্ষ্য এক হোক।

পরিশেষে সকলের নিকট আবেদন আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে সনাতনী সমাজকে সকল অশাস্ত্রীয় ব্যাধিমুক্ত করি!!