০৯:৪৫ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
রাজু আলীম :

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও বাংলাদেশের বানিজ্যিক ভবিষ্যৎ

  • প্রকাশিত ০৫:৩৪:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫
  • ১৪ বার দেখা হয়েছে

১৯৭১ সাল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ব অঙ্গনে এ সময় বাংলাদেশ ছিলো আত্মপরিচয়ে গর্বিত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে। এ সময়টাতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিলো চা, পাট এবং চামড়া। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অসৎ, মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদের কারণে ১৯৭৪ সালে দেশে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এ সময় দেশের অর্থনীতি হয়ে ওঠে নাজুক ভঙ্গুর। বিশ্ব অর্থনীতির ধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করার বদলে, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪ বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং অস্থিরতার চিত্র উঠে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ আর বিদ্ধস্ত অর্থনীতির বাংলাদেশকে নতুন করে নতুন পরিচয়ে তুলে ধরেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
দেশের অর্থনীতির গতি বাড়িয়ে নতুন স্বপ্ন আর উদ্দীপনায় বলীয়ান বাংলাদেশকে তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের নুয়ে পরা অর্থনীতি এগিয়ে যায় নতুন পথে। কেবলমাত্র চা, পাট এবং চামড়া রপ্তানির বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে অর্থনীতিতে সৃষ্টি করে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এ সময় তৈরি হয় দেশের রেডিমেট গার্মেন্টস খাতের ভিত। কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, এ সময় ইউরোপ, আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোও দৃষ্টি দেয় বাংলাদেশের প্রতি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার সর্বাধিক করার প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করেন।
বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং রপ্তানি শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য তৈরি করা হয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) নামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ফলে বাড়তে থাকে দেশের অর্থনীতির কলেবর। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সৃষ্টি করা এই অর্থনৈতিক ভিত্তির হাত ধরেই ৮০ থেকে পরবর্তী তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে রপ্তানি পণ্য হিসেবে বাড়ে রেডিমেড গার্মেন্টেন্সের অবস্থান। দেশের গার্মেন্টস খাতে রপ্তানির প্রধান বাজার হয়ে ওঠে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বাড়াতে ১৯৯৫ সালে ডাব্লুএইচও’তে সংযুক্তি ছিলো একটি মাইলফলক। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে ৫.৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছিল, যা ছিল মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫.৬৭ শতাংশ। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ছিলো মোট রপ্তানির ৩৮ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে ২০ শতাংশের বেশি। এ সময় দেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় সংযুক্ত হয় চিংড়ি এবং চামড়া এবং সফটওয়ারের মতো পণ্যও। যদিও সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও হিমায়িত খাদ্য এবং চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাংলাদেশ খুব বেশি বাড়াতে পারেনি।
সম্প্রতি ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোষাক রপ্তানি ২৯.৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.৯৮ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু সবকিছুকে শঙ্কার কালো মেঘ ঢেকে দেয় হঠাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ট্রাম্পের ৩৫% শুল্ক আরোপের বিষয়টি। ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর যে ৩৫% আমদানি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, তা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি বড় রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক পটভূমি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতি। যেখানে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের উপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপের কথা বলেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যে হারে শুল্ক দেয়, সেই হারে আমদানিকৃত পণ্যেও শুল্ক বসানো হবে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ৩৫% শুল্কের আওতায় আনা হয়, যদিও কিছু বিশ্লেষকের এখনও বলছেন, এটি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল। যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়ে আসছে। বর্তমানে এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কে প্রবেশ করত। কিন্তু ৩৫% শুল্ক আরোপের ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য পণ্যের দাম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে। ক্রেতারা সস্তা ও সহজলভ্য বিকল্প খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে অন্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, কিংবা মেক্সিকোর দিকে ঝুঁকতে পারেন। ফলে বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং কয়েক লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ ইতোমধ্যেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই শুল্ক শুধু পোশাক শিল্পে নয়, বরং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং, পরিবহন, প্যাকেজিং এবং রফতানি লজিস্টিক খাতেও ধস নামাবে। ফলে জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এই শুল্ক রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী এবং দাতা দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপ অনেকের দৃষ্টিতে ব্যবসার মোড়কে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল। যদিও হোয়াইট হাউস থেকে বলা হচ্ছে এটি বাণিজ্যনীতি সংশোধনের অংশ, তবুও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের চোখে এটি একটি কূটনৈতিক বার্তা।
আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এই শুল্ক কাঠামোর বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ঢাকার পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে লাভজনক শুল্কচুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং আগামী ৯ জুলাই আরেক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
১৪ দেশের শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আগামী আগস্টের মধ্যে চুক্তিতে পৌঁছাতে যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি নমনীয় হতে পারে।
বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পণ্যের ওপর নতুন করে ২৫ শতাংশ, মিয়ানমার ও লাওসের পণ্যের ওপর ৪০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ, বসনিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ, সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। অন্যদিকে মাত্র ২৬% শুল্ক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করবে ভারত। বিশ্ব বানিজ্যের এই জটিল খেলায় বাংলাদেশের দৃষ্টি এখন প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে। সামনের দিনে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অস্তিত্ব এবং অবস্থান তৈরি এই সন্ধিক্ষণে ড. ইউনূসের যোগ্য নেতৃত্বের দিকেই চেয়ে আছে দেশের মানুষ।

Tag :
জনপ্রিয়

চট্টগ্রাম গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী হাসান ইবনে কামালের খুঁটির জোর কোথায় – ১০ বছরের অধিক সময় একই স্থানে পদায়িত

রাজু আলীম :

যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কনীতি ও বাংলাদেশের বানিজ্যিক ভবিষ্যৎ

প্রকাশিত ০৫:৩৪:৩৪ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০২৫

১৯৭১ সাল। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের অভ্যুদয়। বিশ্ব অঙ্গনে এ সময় বাংলাদেশ ছিলো আত্মপরিচয়ে গর্বিত সদ্য স্বাধীন একটি দেশ হিসেবে। এ সময়টাতে বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য ছিলো চা, পাট এবং চামড়া। যুদ্ধ বিদ্ধস্ত কৃষি নির্ভর বাংলাদেশের নাজুক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অসৎ, মুনাফালোভী ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদের কারণে ১৯৭৪ সালে দেশে নেমে আসে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। এ সময় দেশের অর্থনীতি হয়ে ওঠে নাজুক ভঙ্গুর। বিশ্ব অর্থনীতির ধারায় নিজেদের সম্পৃক্ত করার বদলে, স্বাধীনতা পরবর্তী ৪ বছর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং অস্থিরতার চিত্র উঠে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। ৭৫ পরবর্তী সময়ে যুদ্ধ বিদ্ধস্ত দেশ আর বিদ্ধস্ত অর্থনীতির বাংলাদেশকে নতুন করে নতুন পরিচয়ে তুলে ধরেন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান।
দেশের অর্থনীতির গতি বাড়িয়ে নতুন স্বপ্ন আর উদ্দীপনায় বলীয়ান বাংলাদেশকে তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। বাংলাদেশের নুয়ে পরা অর্থনীতি এগিয়ে যায় নতুন পথে। কেবলমাত্র চা, পাট এবং চামড়া রপ্তানির বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জনশক্তি রপ্তানি করে অর্থনীতিতে সৃষ্টি করে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এ সময় তৈরি হয় দেশের রেডিমেট গার্মেন্টস খাতের ভিত। কেবল মধ্যপ্রাচ্য নয়, এ সময় ইউরোপ, আমেরিকা সহ পশ্চিমা দেশগুলোও দৃষ্টি দেয় বাংলাদেশের প্রতি।
প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর, দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার সর্বাধিক করার প্রাথমিক লক্ষ্য নিয়ে বেসরকারি উদ্যোগকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন কৌশল গ্রহণ করেন।
বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে এবং রপ্তানি শিল্পকে উৎসাহিত করার জন্য তৈরি করা হয় রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) নামে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল। ফলে বাড়তে থাকে দেশের অর্থনীতির কলেবর। প্রেসিডেন্ট জিয়ার সৃষ্টি করা এই অর্থনৈতিক ভিত্তির হাত ধরেই ৮০ থেকে পরবর্তী তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে অর্থনীতিতে রপ্তানি পণ্য হিসেবে বাড়ে রেডিমেড গার্মেন্টেন্সের অবস্থান। দেশের গার্মেন্টস খাতে রপ্তানির প্রধান বাজার হয়ে ওঠে ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্য। এ ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি বাড়াতে ১৯৯৫ সালে ডাব্লুএইচও’তে সংযুক্তি ছিলো একটি মাইলফলক। ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প থেকে ৫.৫১ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি আয় হয়েছিল, যা ছিল মোট রপ্তানি আয়ের ৭৫.৬৭ শতাংশ। যার মধ্যে বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি ছিলো মোট রপ্তানির ৩৮ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে ২০ শতাংশের বেশি। এ সময় দেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায় সংযুক্ত হয় চিংড়ি এবং চামড়া এবং সফটওয়ারের মতো পণ্যও। যদিও সম্ভাবনা থাকা স্বত্ত্বেও হিমায়িত খাদ্য এবং চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি বাংলাদেশ খুব বেশি বাড়াতে পারেনি।
সম্প্রতি ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি পোষাক রপ্তানি ২৯.৩৩ শতাংশ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ২.৯৮ বিলিয়ন ডলারে। কিন্তু সবকিছুকে শঙ্কার কালো মেঘ ঢেকে দেয় হঠাৎ বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে ট্রাম্পের ৩৫% শুল্ক আরোপের বিষয়টি। ৮ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সরকার বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের উপর যে ৩৫% আমদানি শুল্ক আরোপের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে, তা বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি অভিঘাত তৈরি করবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদেরা। এই সিদ্ধান্তের পেছনে একটি বড় রাজনৈতিক এবং বাণিজ্যিক পটভূমি প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতি। যেখানে তিনি উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে আমদানি হওয়া পণ্যের উপর পারস্পরিক শুল্ক আরোপের কথা বলেন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্র যে হারে শুল্ক দেয়, সেই হারে আমদানিকৃত পণ্যেও শুল্ক বসানো হবে। এরই অংশ হিসেবে বাংলাদেশকে ৩৫% শুল্কের আওতায় আনা হয়, যদিও কিছু বিশ্লেষকের এখনও বলছেন, এটি রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের একটি কৌশল। যার মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনায় সুবিধাজনক অবস্থান তৈরি করা সম্ভব।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাজার, যেখানে বছরে প্রায় ৯ বিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়ে আসছে। বর্তমানে এসব পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় শুল্কমুক্ত বা স্বল্প শুল্কে প্রবেশ করত। কিন্তু ৩৫% শুল্ক আরোপের ফলে রপ্তানিকারকদের জন্য পণ্যের দাম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে যাবে। ক্রেতারা সস্তা ও সহজলভ্য বিকল্প খুঁজতে গিয়ে বাংলাদেশকে বাদ দিয়ে অন্য দেশ যেমন ভিয়েতনাম, ভারত, কিংবা মেক্সিকোর দিকে ঝুঁকতে পারেন। ফলে বাংলাদেশের অনেক পোশাক কারখানা বন্ধ হয়ে যেতে পারে এবং কয়েক লাখ শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
বাংলাদেশের গার্মেন্ট শিল্প সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ ইতোমধ্যেই গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। তাদের মতে, এই শুল্ক শুধু পোশাক শিল্পে নয়, বরং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকিং, পরিবহন, প্যাকেজিং এবং রফতানি লজিস্টিক খাতেও ধস নামাবে। ফলে জাতীয় অর্থনীতির সামগ্রিক প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অর্থনৈতিক সংকটের পাশাপাশি এই শুল্ক রাজনৈতিক এবং কূটনৈতিক সম্পর্কেও প্রভাব ফেলবে। যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে অন্যতম বৃহত্তম বিনিয়োগকারী এবং দাতা দেশ। যুক্তরাষ্ট্রের এই শুল্ক আরোপ অনেকের দৃষ্টিতে ব্যবসার মোড়কে রাজনৈতিক চাপ প্রয়োগের কৌশল। যদিও হোয়াইট হাউস থেকে বলা হচ্ছে এটি বাণিজ্যনীতি সংশোধনের অংশ, তবুও বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের চোখে এটি একটি কূটনৈতিক বার্তা।
আগামী ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হতে যাওয়া এই শুল্ক কাঠামোর বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা শফিকুল আলম জানিয়েছেন, ঢাকার পক্ষ থেকে ওয়াশিংটনের সঙ্গে লাভজনক শুল্কচুক্তির বিষয়ে আলোচনা চলছে এবং আগামী ৯ জুলাই আরেক দফা আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে।
১৪ দেশের শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, আগামী আগস্টের মধ্যে চুক্তিতে পৌঁছাতে যে সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে, সেটি নমনীয় হতে পারে।
বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ কোরিয়া ও জাপানের পণ্যের ওপর নতুন করে ২৫ শতাংশ, মিয়ানমার ও লাওসের পণ্যের ওপর ৪০ শতাংশ, দক্ষিণ আফ্রিকার ওপর ৩০ শতাংশ, মালয়েশিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, তিউনিসিয়ার ওপর ২৫ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার ওপর ৩২ শতাংশ, বসনিয়ার ওপর ৩০ শতাংশ, সার্বিয়ার ওপর ৩৫ শতাংশ, কম্বোডিয়া ও থাইল্যান্ডের ওপর ৩৬ শতাংশ শুল্ক নির্ধারণ করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। অন্যদিকে মাত্র ২৬% শুল্ক থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বড় অর্থনৈতিক সুবিধা লাভ করবে ভারত। বিশ্ব বানিজ্যের এই জটিল খেলায় বাংলাদেশের দৃষ্টি এখন প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের দিকে। সামনের দিনে দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অস্তিত্ব এবং অবস্থান তৈরি এই সন্ধিক্ষণে ড. ইউনূসের যোগ্য নেতৃত্বের দিকেই চেয়ে আছে দেশের মানুষ।