০৬:২৬ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৫ জুন ২০২৫, ২২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
এম এইচ মেনান/ নীলফামারী প্রতিনিধি :

হাতুড়ি আর লোহার টুংটাং শব্দে মুখরিত কামার পাড়া

  • প্রকাশিত ০৫:১৯:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫
  • ২৫ বার দেখা হয়েছে

আর মাত্র তিন দিন বাকি পবিত্র ঈদুল আযহার। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে এদিন পশু কোরবানি করবেন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এসব পশুর মাংস কাটতে দা, বটি, ছুরি, চাপাতি ইত্যাদি ধাতব হাতিয়ার অপরিহার্য। আর এসব হাতিয়ার তৈরিতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন নীলফামারী কামার শিল্পীরা। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা। দম ফেলার যেন ফুরসত নেই তাদের।পশু জবাইয়ের জন্য ছুরি-চাকু-বটি, চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কিনতে শুরু করেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ একটু আগেভাগে দা, বটি, ছুরিসহ মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম শান দিয়ে নিচ্ছেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও কৃষি যন্ত্রপাতি আধুনিক হওয়ায় আমাদের পণ্যের চাহিদা কমেছে। এবার কোরবানির ঈদকে ঘিরে লোহা ও কয়লার দাম বেড়েছে। খরচ বাড়লেও আমাদের আয় বাড়েনি বলে জানান তাঁরা।

এভাবেই ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছে কামারপাড়া। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পেছনে পড়ে গেলেও কোরবানির ঈদ এখনো এই প্রাচীন পেশায় খানিকটা প্রাণ ফেরায়।

সরেজমিন নীলফামারী সদরের বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, হাতুড়ি আর লোহার টুংটাং শব্দে মুখরিত কামার পাড়া। কেউ হাঁপর টানছেন, সেই হাঁপরে পুড়ছে কয়লা, জ্বলছে লোহা। কেউ কেউ হাতুড়ি পিটিয়ে তৈরি করছেন দা, বটি, ছুরিসহ মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম। ঈদের দিন পর্যন্ত চলবে তাদের এমন ব্যস্ততা।তাই খাওয়া-দাওয়া ভুলে কাজ করছেন তারা। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে কাজ। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কয়েকগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় কামারদের। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে তাদের জিনিসপত্রের কেনা-বেচা বেড়ে যায়। এ থেকে অর্জিত টাকায় সারা বছর চলে সংসার। বছরের বেশিরভাগ সময় কামার শিল্পীদের কাজ কম থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই তারা এ সময়টাকে কাজে লাগান।

নীলফামারী বড়বাজারের আমতলিতে বাপ-বেটা মিলে কামারের দোকান পরিচালনা করেন সুব্রত কর্মকার। বাপ লোহা ধরে আছেন, ছেলে হাতুড়ি নিয়ে পেটাচ্ছেন। তাতেই তৈরি হচ্ছে চকচকে দা, ছুরি, চাপাতি, বটি, চাকু।

সুব্রত কর্মকার বলেন, কোরবানির ঈদে কাজ বেশি হয়। যে কারণে ঈদের একমাস আগে থেকেই আমাদের কাজ বাড়তে থাকে। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও ঈদে বিশ্রামের সময়ও পাই না। ঈদের অনেক আগে থেকেই নতুন সরঞ্জাম তৈরি করে রাখি। অনেকে বানানোর সময় না পেয়ে নতুন জিনিস কিনেন।

কামার শিল্পী সঞ্জয় কর্মকার বলেন, আমার দাদাও এ কাজ করতেন। বাবা ৩০ বছর ধরে করছেন। সবমিলিয়ে ৬০ বছরের পুরোনো ব্যবসা আমাদের। বছরের এই ঈদ মৌসুমটাই আমাদের মূল টার্গেট থাকে। তাই ভালো উপার্জনের আশায় দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তবে বেচাকেনা এখনো জমে উঠেনি। আর মাত্র চারদিন পর ঈদ। এ সময়ে জমে ওঠার কথা দা-বটির বাজার, অথচ এবার বিক্রিই নেই। পুরোনো সরঞ্জামে অনেকেই শান দিয়ে নিচ্ছেন।

সদরের ভবানীগঞ্জ এলাকার কামার শিল্পী মো. হেলাল উদ্দিন জানান, পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা, দা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, বটি ৩০০ থেকে ৫০০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও চাপাতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে কয়লার দাম ও শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে গেছে। তবে এখন হাতে কাজ অনেক। কাজের চাপে কখন খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে আমরা টেরও পাই না। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে বিক্রি তত বাড়ছে। স্থানীয় কসাইদের চাহিদা মিটিয়ে বাইরের এলাকা থেকেও অর্ডার নেওয়া হচ্ছে। সারা বছর কাজের চাপ থাকে না। যা লাভ এই ঈদে, তাই ঈদে সামান্য একটু বেশি নিয়ে থাকি।

চিলাহাটি বাজারের আরেক বিক্রেতা কমল কর্মকার বলেন, একটা দা-বটি বানাতে অনেক খরচ হয়, কিন্তু সেই তুলনায় দাম ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখন বিদেশি দা-বটিও বাজারে ঢুকেছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের বিক্রিতে। তারপরও ঈদের জন্য কিছুটা বিক্রি বেড়েছে।

মাংস কাটার সরঞ্জাম কিনতে আসা পুলিশ লাইন্স এলাকার আব্দুল হান্নান বলেন,বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছুরি পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো টেকসই না। কামারদের তৈরি লোহার দা-বটি অনেক মজবুত এবং কাজেও ভালো হয়। তবে এবার দাম কিছুটা বেশি চাওয়া হচ্ছে।

রামনগর হতে আসা আরেক ক্রেতা এবিএম হিমেল বলেন, কোরবানির আর বেশি দিন নেই। তাই আগে থেকেই দা, চাপাতিসহ দরকারি জিনিস কিনে নিচ্ছি। ঈদের সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়, তাই সময় বাঁচাতে আগেভাগে নিতে এসেছি।

অপরদিকে ক্রেতা ফিরোজ ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ঈদ উপলক্ষে দা, চাপাতি ও ছুরির দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। ছুরি শান দেওয়ার জন্য ১০০ টাকা থেকে শুরু করে কাজের গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।

Tag :
জনপ্রিয়

অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারকে সহায়তা

এম এইচ মেনান/ নীলফামারী প্রতিনিধি :

হাতুড়ি আর লোহার টুংটাং শব্দে মুখরিত কামার পাড়া

প্রকাশিত ০৫:১৯:৪৭ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩ জুন ২০২৫

আর মাত্র তিন দিন বাকি পবিত্র ঈদুল আযহার। ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে এদিন পশু কোরবানি করবেন দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা। এসব পশুর মাংস কাটতে দা, বটি, ছুরি, চাপাতি ইত্যাদি ধাতব হাতিয়ার অপরিহার্য। আর এসব হাতিয়ার তৈরিতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন নীলফামারী কামার শিল্পীরা। দিন যতই ঘনিয়ে আসছে, ততই বাড়ছে তাদের ব্যস্ততা। দম ফেলার যেন ফুরসত নেই তাদের।পশু জবাইয়ের জন্য ছুরি-চাকু-বটি, চাপাতিসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি কিনতে শুরু করেছেন অনেকেই। আবার কেউ কেউ একটু আগেভাগে দা, বটি, ছুরিসহ মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম শান দিয়ে নিচ্ছেন।

নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ও কৃষি যন্ত্রপাতি আধুনিক হওয়ায় আমাদের পণ্যের চাহিদা কমেছে। এবার কোরবানির ঈদকে ঘিরে লোহা ও কয়লার দাম বেড়েছে। খরচ বাড়লেও আমাদের আয় বাড়েনি বলে জানান তাঁরা।

এভাবেই ঈদ ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে জমে উঠেছে কামারপাড়া। আধুনিকতার ছোঁয়ায় পেছনে পড়ে গেলেও কোরবানির ঈদ এখনো এই প্রাচীন পেশায় খানিকটা প্রাণ ফেরায়।

সরেজমিন নীলফামারী সদরের বিভিন্ন হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, হাতুড়ি আর লোহার টুংটাং শব্দে মুখরিত কামার পাড়া। কেউ হাঁপর টানছেন, সেই হাঁপরে পুড়ছে কয়লা, জ্বলছে লোহা। কেউ কেউ হাতুড়ি পিটিয়ে তৈরি করছেন দা, বটি, ছুরিসহ মাংস কাটার বিভিন্ন সরঞ্জাম। ঈদের দিন পর্যন্ত চলবে তাদের এমন ব্যস্ততা।তাই খাওয়া-দাওয়া ভুলে কাজ করছেন তারা। ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত চলছে কাজ। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কয়েকগুণ ব্যস্ততা বেড়ে যায় কামারদের। প্রতিবছর কোরবানির ঈদে তাদের জিনিসপত্রের কেনা-বেচা বেড়ে যায়। এ থেকে অর্জিত টাকায় সারা বছর চলে সংসার। বছরের বেশিরভাগ সময় কামার শিল্পীদের কাজ কম থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই তারা এ সময়টাকে কাজে লাগান।

নীলফামারী বড়বাজারের আমতলিতে বাপ-বেটা মিলে কামারের দোকান পরিচালনা করেন সুব্রত কর্মকার। বাপ লোহা ধরে আছেন, ছেলে হাতুড়ি নিয়ে পেটাচ্ছেন। তাতেই তৈরি হচ্ছে চকচকে দা, ছুরি, চাপাতি, বটি, চাকু।

সুব্রত কর্মকার বলেন, কোরবানির ঈদে কাজ বেশি হয়। যে কারণে ঈদের একমাস আগে থেকেই আমাদের কাজ বাড়তে থাকে। সারা বছর তেমন কাজ না থাকলেও ঈদে বিশ্রামের সময়ও পাই না। ঈদের অনেক আগে থেকেই নতুন সরঞ্জাম তৈরি করে রাখি। অনেকে বানানোর সময় না পেয়ে নতুন জিনিস কিনেন।

কামার শিল্পী সঞ্জয় কর্মকার বলেন, আমার দাদাও এ কাজ করতেন। বাবা ৩০ বছর ধরে করছেন। সবমিলিয়ে ৬০ বছরের পুরোনো ব্যবসা আমাদের। বছরের এই ঈদ মৌসুমটাই আমাদের মূল টার্গেট থাকে। তাই ভালো উপার্জনের আশায় দিন-রাত পরিশ্রম করে যাচ্ছি। তবে বেচাকেনা এখনো জমে উঠেনি। আর মাত্র চারদিন পর ঈদ। এ সময়ে জমে ওঠার কথা দা-বটির বাজার, অথচ এবার বিক্রিই নেই। পুরোনো সরঞ্জামে অনেকেই শান দিয়ে নিচ্ছেন।

সদরের ভবানীগঞ্জ এলাকার কামার শিল্পী মো. হেলাল উদ্দিন জানান, পশুর চামড়া ছাড়ানো ছুরি ১৮০ থেকে ২৫০ টাকা, দা ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, বটি ৩০০ থেকে ৫০০, পশু জবাইয়ের ছুরি ৪০০ থেকে ১ হাজার টাকা ও চাপাতি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, কোরবানির ঈদ উপলক্ষে কয়লার দাম ও শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে গেছে। তবে এখন হাতে কাজ অনেক। কাজের চাপে কখন খাওয়ার সময় চলে যাচ্ছে আমরা টেরও পাই না। ঈদ যত ঘনিয়ে আসছে বিক্রি তত বাড়ছে। স্থানীয় কসাইদের চাহিদা মিটিয়ে বাইরের এলাকা থেকেও অর্ডার নেওয়া হচ্ছে। সারা বছর কাজের চাপ থাকে না। যা লাভ এই ঈদে, তাই ঈদে সামান্য একটু বেশি নিয়ে থাকি।

চিলাহাটি বাজারের আরেক বিক্রেতা কমল কর্মকার বলেন, একটা দা-বটি বানাতে অনেক খরচ হয়, কিন্তু সেই তুলনায় দাম ঠিকমতো পাওয়া যায় না। তাছাড়া এখন বিদেশি দা-বটিও বাজারে ঢুকেছে, যার প্রভাব পড়েছে আমাদের বিক্রিতে। তারপরও ঈদের জন্য কিছুটা বিক্রি বেড়েছে।

মাংস কাটার সরঞ্জাম কিনতে আসা পুলিশ লাইন্স এলাকার আব্দুল হান্নান বলেন,বাজারে বিভিন্ন ধরনের ছুরি পাওয়া যায়, কিন্তু সেগুলো টেকসই না। কামারদের তৈরি লোহার দা-বটি অনেক মজবুত এবং কাজেও ভালো হয়। তবে এবার দাম কিছুটা বেশি চাওয়া হচ্ছে।

রামনগর হতে আসা আরেক ক্রেতা এবিএম হিমেল বলেন, কোরবানির আর বেশি দিন নেই। তাই আগে থেকেই দা, চাপাতিসহ দরকারি জিনিস কিনে নিচ্ছি। ঈদের সময় প্রচণ্ড ভিড় হয়, তাই সময় বাঁচাতে আগেভাগে নিতে এসেছি।

অপরদিকে ক্রেতা ফিরোজ ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ঈদ উপলক্ষে দা, চাপাতি ও ছুরির দাম বেশি নেওয়া হচ্ছে। ছুরি শান দেওয়ার জন্য ১০০ টাকা থেকে শুরু করে কাজের গুণাগুণের ওপর ভিত্তি করে ৩০০ টাকা পর্যন্ত নেওয়া হচ্ছে।