১১:৪৪ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই ২০২৫, ১৬ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সোমেশ্বরী মণিময় স্নিগ্ধ প্রবাহ… জামিল জাহাঙ্গীর

  • প্রকাশিত ০৯:০৬:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫
  • ৭৯ বার দেখা হয়েছে

নেত্রকোণা বাংলার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। দৃষ্টিনন্দন রূপময়তার পাশাপাশি সম্পদে সমৃদ্ধ এক বিভাময় জনপদ। এই অপরূপ স্বর্ণখণ্ডের সাথে এক মনোলোভা নদীর যোগসূত্র। রূপকথার গল্পের চেয়েও এই নদীর ইতিহাস মনোহর।
অনেক অনেক আগের কথা। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক নদীর নাম ছিল ‘সমসাঙ্গ’। ওই নদীর তীরে ধীবররা বসবাস করত। তাদের বলা হতো ‘পাটুনি’। তখন ওই অঞ্চল শাসন করত গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যার নাম বাইশা গারো। বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু শক্তি সাহস কম বলে তাকে মেনে নিতে বাধ্য ছিল।

১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। ওই সময় গারো পাহাড় ও তার আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা। নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ মুখর থাকত।
এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে। তার মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য এ স্থানটিই উত্তম। সোমেশ্বর তার অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন। ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে।

সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর [বর্তমান নেত্রকোণা জেলায়] গ্রাম। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। সোমেশ্বর তার আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুসং রাজ্য’।

এরপর তিনি নজর দেন রাজ্যের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে। ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ‘ভৃঙ্গার’ থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী।

তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা ‘সমসাং’ বয়ে যেত ওই এলাকার ভেতর দিয়ে। সে ঝর্ণাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী। সেদিনের সেই সোমেশ্বরী নদীই বর্তমান নেত্রকোণা জেলার ভেতর দিয়ে অবিরাম বয়ে চলেছে।

সোমেশ্বরী নদীর উৎপত্তিস্থল আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে ভারতে হলেও নেত্রকোণার দূর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর (বাংলাদেশের একমাত্রসাদা মাটির পাহাড় নামে খ্যাত) ও ভবানীপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে এই সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বছরের বেশিরভাগ সময় সোমেশ্বরীর একপাশ জুড়ে থাকে ধু ধু বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল।যে জলের মায়াময় ছোঁয়া স্নিগ্ধ সুষমায় ভরিয়ে দেয় তৃষ্ণিত হৃদয়। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ পানি এক জাদুকরী সালসা। সুশীতল আবেশে ভুলিয়ে দেয় বিগত যন্ত্রণা। এ জলে নামার লোভ সংবরণ করা বড়ই কঠিন। এ পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে গেলে মোটা বালু পায়ের পাতায় শিরশির অনুভূতির জন্ম দেয়।

শুকনো মৌসুমে সোমেশ্বরী যৌবন হারিয়ে প্রায় মরা নদীতে রূপ নিলেও তার বুক জুড়ে থাকে বিস্তীর্ণ সোনালী-লাল বালু- যা দেখলেই মনে হবে সোনার বাংলার বুকে এক সোনালী বৈচিত্র্যময় পর্যটন স্পট। সোমেশ্বরী নদীর দৃশ্য এবং দুর্গাপুর অঞ্চলের প্রকৃতিক পরিবেশ শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বের এক অনন্য প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। ঢালু ভূখণ্ডের বুক চিরে এক মণিময় স্বর্ণপ্রবাহ সোমেশ্বরী। এ নদী আমাদের একান্ত নিজস্ব নন্দন। এ নদীতে গা ভেজেনি যার তার চেয়ে অভাগা আর কে!
♥️
নদী পর্ব ৭৭।। সোমেশ্বরী মণিময় স্বর্ণপ্রবাহ
©️
জামিল জাহাঙ্গীর

Tag :
জনপ্রিয়

গৌরীপুর সরকারি মার্কেটের জায়গা অবৈধভাবে দখল করে নিয়েছে

সোমেশ্বরী মণিময় স্নিগ্ধ প্রবাহ… জামিল জাহাঙ্গীর

প্রকাশিত ০৯:০৬:৩৫ অপরাহ্ন, বুধবার, ৩০ জুলাই ২০২৫

নেত্রকোণা বাংলার প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। দৃষ্টিনন্দন রূপময়তার পাশাপাশি সম্পদে সমৃদ্ধ এক বিভাময় জনপদ। এই অপরূপ স্বর্ণখণ্ডের সাথে এক মনোলোভা নদীর যোগসূত্র। রূপকথার গল্পের চেয়েও এই নদীর ইতিহাস মনোহর।
অনেক অনেক আগের কথা। উত্তরের গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা এক নদীর নাম ছিল ‘সমসাঙ্গ’। ওই নদীর তীরে ধীবররা বসবাস করত। তাদের বলা হতো ‘পাটুনি’। তখন ওই অঞ্চল শাসন করত গারো সম্প্রদায়ের এক দলপতি, যার নাম বাইশা গারো। বিভিন্ন কারণে বাইশা গারোর ওপর ধীবররা সন্তুষ্ট ছিল না। কিন্তু শক্তি সাহস কম বলে তাকে মেনে নিতে বাধ্য ছিল।

১২৮০ খ্রিস্টাব্দে সোমেশ্বর পাঠক কামরূপ কামাখ্যা তীর্থ দর্শন শেষে গারো পাহাড়ে আসেন। ওই সময় গারো পাহাড় ও তার আশপাশের এলাকা ছিল বনজঙ্গলে ঢাকা। নানা প্রজাতির পশুপাখির কলকাকলিতে সারাক্ষণ মুখর থাকত।
এখানকার সৌন্দর্য আর সুমসাং নদী তীরের নীরবতা সোমেশ্বর পাঠককে মুগ্ধ করে। তার মনে বিশ্বাস জন্মে, সিদ্ধিলাভের জন্য এ স্থানটিই উত্তম। সোমেশ্বর তার অনুচরদের নিয়ে সেখানেই আস্তানা গাড়েন। ক্রমে যোগাযোগ গড়ে ওঠে ওই এলাকার জেলেদের সঙ্গে।

সোমেশ্বর ছিলেন অসামান্য বিদ্বান, বুদ্ধিমান ও বলিষ্ঠ। ধীবররা তাকে দেবতা এবং ত্রাতা মনে করতে থাকে। তাকে ঘিরেই গড়ে ওঠে দুর্গাপুর [বর্তমান নেত্রকোণা জেলায়] গ্রাম। সোমেশ্বর পাঠক সেখানে প্রতিষ্ঠা করেন সঙ্গে করে নিয়ে আসা লক্ষ্মীনারায়ণের বিগ্রহ। সোমেশ্বর তার আগের বাসস্থান কান্যকুব্জ থেকে স্বজনদের নিয়ে এসে বসতি গড়েন সেখানে। এতে তার শক্তি আরও কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়। এক সময় সুযোগ বুঝে ওই এলাকার অত্যাচারী শাসনকর্তা বাইশা গারোকে পরাজিত করে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সুসং রাজ্য’।

এরপর তিনি নজর দেন রাজ্যের সমৃদ্ধি ও উন্নয়নে। ওই এলাকার ধীবররা সোমেশ্বর পাঠককে সাক্ষাৎ দেবতা মনে করত। তারা ভাবত, জেলেদের উন্নতির জন্যই সোমেশ্বর ঠাকুর নিজ হাতে সুসং রাজ্য গড়েছেন। তারা এও মনে করত, সুসংয়ের মানুষের পানিকষ্ট দূর করতেই প্রভু সোমেশ্বর নিজ হাতের ‘ভৃঙ্গার’ থেকে পানি ঢেলে দেওয়ায় সেখান থেকে সৃষ্টি হয় সোমেশ্বরী নদী।

তবে অনেকেরই ধারণা, উত্তর পাহাড়ের ঝর্ণাধারা ‘সমসাং’ বয়ে যেত ওই এলাকার ভেতর দিয়ে। সে ঝর্ণাধারার গতিপথ পরিবর্তন করে সোমেশ্বর পাঠক তা নিয়ে এসেছিলেন সুসংয়ের রাজধানী দুর্গাপুরের কাছে। এ কারণেই ওই নদীর নাম হয় সোমেশ্বরী নদী। সেদিনের সেই সোমেশ্বরী নদীই বর্তমান নেত্রকোণা জেলার ভেতর দিয়ে অবিরাম বয়ে চলেছে।

সোমেশ্বরী নদীর উৎপত্তিস্থল আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে। তবে ভারতে হলেও নেত্রকোণার দূর্গাপুর উপজেলার বিজয়পুর (বাংলাদেশের একমাত্রসাদা মাটির পাহাড় নামে খ্যাত) ও ভবানীপুর গ্রামের ভিতর দিয়ে এই সোমেশ্বরী নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
বছরের বেশিরভাগ সময় সোমেশ্বরীর একপাশ জুড়ে থাকে ধু ধু বালুচর, অন্য পাশেই হালকা নীলাভ জল।যে জলের মায়াময় ছোঁয়া স্নিগ্ধ সুষমায় ভরিয়ে দেয় তৃষ্ণিত হৃদয়। পাহাড়ি নদী সোমেশ্বরীর স্বচ্ছ পানি এক জাদুকরী সালসা। সুশীতল আবেশে ভুলিয়ে দেয় বিগত যন্ত্রণা। এ জলে নামার লোভ সংবরণ করা বড়ই কঠিন। এ পানিতে পা ডুবিয়ে হাঁটতে গেলে মোটা বালু পায়ের পাতায় শিরশির অনুভূতির জন্ম দেয়।

শুকনো মৌসুমে সোমেশ্বরী যৌবন হারিয়ে প্রায় মরা নদীতে রূপ নিলেও তার বুক জুড়ে থাকে বিস্তীর্ণ সোনালী-লাল বালু- যা দেখলেই মনে হবে সোনার বাংলার বুকে এক সোনালী বৈচিত্র্যময় পর্যটন স্পট। সোমেশ্বরী নদীর দৃশ্য এবং দুর্গাপুর অঞ্চলের প্রকৃতিক পরিবেশ শুধু বাংলাদেশ নয় সারাবিশ্বের এক অনন্য প্রাকৃতিক ঐশ্বর্য। ঢালু ভূখণ্ডের বুক চিরে এক মণিময় স্বর্ণপ্রবাহ সোমেশ্বরী। এ নদী আমাদের একান্ত নিজস্ব নন্দন। এ নদীতে গা ভেজেনি যার তার চেয়ে অভাগা আর কে!
♥️
নদী পর্ব ৭৭।। সোমেশ্বরী মণিময় স্বর্ণপ্রবাহ
©️
জামিল জাহাঙ্গীর