বাংলাদেশে সাংবাদিকরা প্রতিনিয়ত নানান ঝুঁকি ও হুমকির মুখোমুখি হন—মাঠপর্যায়ের অনুসন্ধানী রিপোর্ট থেকে শুরু করে সামাজিক মাধ্যমেও তারা হয়ে উঠেছেন নানা পক্ষের টার্গেট। এমন বাস্তবতায় “সাংবাদিক সুরক্ষা আইন” প্রণয়ন একটি সময়োপযোগী দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
রাষ্ট্রের দায়িত্ব:
রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সাংবাদিকরা শুধু পেশাজীবী নন, তারা জাতির বিবেক—তথ্য সংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং প্রচারের মাধ্যমে একটি সচেতন সমাজ গড়ে তোলার কাজ করেন। অথচ বহু ক্ষেত্রেই তাদের ওপর হয়রানি, মামলা, হামলা কিংবা হত্যাকাণ্ড ঘটছে—কোনো প্রতিকার নেই।
রাষ্ট্র কী করতে পারে?
একটি সুনির্দিষ্ট সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করতে পারে। সাংবাদিকদের ওপর হামলার ঘটনায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। সাংবাদিকদের তথ্য-অধিকারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশের সাথে সাংবাদিকদের আচরণে স্বচ্ছতা আনতে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।
গণমাধ্যমের ভূমিকা:
গণমাধ্যম শুধু সংবাদ প্রকাশেই সীমাবদ্ধ নয়—নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রেও তাদের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। নিজেদের পেশাগত সুরক্ষার প্রশ্নে সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যমগুলোকে ঐক্যবদ্ধ অবস্থান নিতে হবে।
গণমাধ্যম কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
সম্পাদকীয়, টকশো, সংবাদভিত্তিক প্রতিবেদন এবং সামাজিক প্রচারমাধ্যমে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন নিয়ে আলোচনার বিস্তার। সংবাদপত্র পরিষদ, ইলেকট্রনিক মিডিয়া কাউন্সিল ও অন্যান্য সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংলাপ। মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিয়ে নিয়মিত ডেটা সংগ্রহ ও প্রতিবেদন প্রকাশ।
বাস্তবচিত্র:
২০২৪ সালে বাংলাদেশে অন্তত ৯৭টি সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত হয়েছে (সূত্র: রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডার্স)। ২০২১-২০২৫ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় সংস্থা সাংবাদিক সুরক্ষা আইন দাবি করে আসছে, তবে আইনি অগ্রগতি ধীরগতি।
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে প্রকৃত মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আশা করা যায় না। রাষ্ট্রকে যেমন দায়িত্ব নিতে হবে একটি কার্যকর ও প্রগতিশীল আইন প্রণয়নের, তেমনি গণমাধ্যমকে নিতে হবে সোচ্চার, তথ্যনির্ভর ও ঐক্যবদ্ধ ভূমিকা।
“কলম যখন ভয়ে কাঁপে, তখন গণতন্ত্রও দুর্বল হয়ে পড়ে।”
সুরক্ষা আইন প্রণয়নে বিভিন্ন সাংবাদিক ও মানবাধিকার সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এই সংগঠনগুলোর ভূমিকা নীচে ধাপে ধাপে তুলে ধরা হলো:
১. চাপ সৃষ্টি ও জনমত গঠন
সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি। গণমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও জনসমাবেশের মাধ্যমে আইন প্রণয়নের জন্য জনমত তৈরি করা। রাজনৈতিক ও নীতিনির্ধারকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যাতে তারা দ্রুত আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেন।
২. গবেষণা ও নীতিগত প্রস্তাবনা প্রদান
সাংবাদিক নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ। দেশে ও বিদেশে বিদ্যমান সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের তুলনামূলক বিশ্লেষণ। আইন প্রণয়নের জন্য একটি খসড়া বা কাঠামোগত প্রস্তাব প্রস্তুত করে সরকারকে প্রদান।
৩. আইনি সহায়তা ও পরামর্শ
আইন বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতায় একটি কার্যকর, সাংবাদিকবান্ধব এবং সাংবিধানিকভাবে টেকসই আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ায় সহায়তা। মানবাধিকার ও গণমাধ্যম আইন সম্পর্কিত তথ্য ও পরামর্শ প্রদান।
৪. সরকারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যম হওয়া
নীতি-নির্ধারক, মন্ত্রণালয় ও সংসদীয় কমিটির সঙ্গে নিয়মিত সংলাপ ও পরামর্শ চালিয়ে যাওয়া। অংশগ্রহণমূলক আইন প্রণয়নে অংশ নেওয়া।
৫. জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংযোগ স্থাপন
আন্তর্জাতিক সংগঠন (যেমন: Reporters Without Borders, CPJ, IFJ)-এর সহায়তায় আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি করা। জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কাউন্সিলের মাধ্যমে কূটনৈতিক সমর্থন সংগ্রহ করা।
৬. প্রশিক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
সাংবাদিকদের অধিকার, নিরাপত্তা ও আইনগত প্রক্রিয়া সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
আইন পাস হলে তার বাস্তবায়নে ও সচেতনতা বৃদ্ধিতে প্রচারণা চালানো।
৭. দুর্নীতির নজরদারি ও আইন বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ
আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কোনো অনিয়ম বা অবহেলা হলে তা তুলে ধরা। বিচারবহির্ভূত নির্যাতনের অভিযোগে আইনি সহায়তা ও প্রতিবাদ সংগঠিত করা।
সাংবাদিক সুরক্ষা আইন বাস্তবায়নে সংগঠনগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তাই তাদের কৌশলগত, তথ্যভিত্তিক ও নিরবচ্ছিন্ন কাজ চালিয়ে যাওয়াই ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত জরুরি।
সাংবাদিক সুরক্ষা আইন প্রণয়নে বেশ কিছু বাধা রয়েছে, যা রাজনৈতিক, প্রশাসনিক, সামাজিক ও কাঠামোগত বিভিন্ন স্তরে বিস্তৃত। নিচে মূল বাঁধাগুলো তুলে ধরা হলো:
১. রাজনৈতিক অনিচ্ছা ও স্বার্থসংঘাত
অনেক সময় ক্ষমতাসীন মহল সাংবাদিকদের স্বাধীনতা সীমিত করতে চায়, যাতে দুর্নীতি বা অপশাসনের খবর চাপা থাকে। সাংবাদিক সুরক্ষা আইন কার্যকর হলে সরকারের কর্মকাণ্ডের জবাবদিহিতা বাড়বে—এটি অনেক রাজনীতিবিদের কাছে অস্বস্তিকর।
২. নিরাপত্তা সংস্থার আপত্তি
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর একটি অংশ সাংবাদিকদের “নিরাপত্তার জন্য হুমকি” হিসেবে দেখতে পারে, বিশেষ করে যারা অনুসন্ধানী রিপোর্ট করেন। এই বাহিনীগুলো মনে করে সাংবাদিকদের অতিরিক্ত সুরক্ষা দিলে তথ্য ফাঁস ও গোপনীয়তা রক্ষা কঠিন হবে।
৩. বিদ্যমান আইনের জটিলতা ও দ্বন্দ্ব
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, মানহানির মামলা ইত্যাদির কারণে সাংবাদিকদের ইতিমধ্যে বিভিন্ন আইনি চাপে রাখা হয়েছে। নতুন সুরক্ষা আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিদ্যমান আইনের সঙ্গে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হতে পারে—যা সরকার বা আইন প্রণেতারা এড়াতে চান।
৪. সংগঠনের মধ্যে ঐক্যের অভাব
সাংবাদিক সংগঠনগুলো অনেক সময় ভিন্নমত ও বিভক্তিতে জর্জরিত থাকে। সমন্বিত দাবি বা একমত হয়ে চাপ সৃষ্টি না করতে পারলে সরকার সহজেই এই দাবিকে এড়িয়ে যেতে পারে।
৫. জনসচেতনতার ঘাটতি
সাধারণ জনগণের একটি বড় অংশ সাংবাদিক নির্যাতন বা হয়রানির ঘটনা সম্পর্কে সচেতন নয় বা গুরুত্বও দেয় না। ফলে সমাজের তরফ থেকে বৃহৎ কোনো জনচাপ তৈরি হয় না।
৬. সংবাদপত্র মালিকপক্ষের নীরবতা
অনেক মিডিয়া হাউজের মালিক সরাসরি ব্যবসায়িক স্বার্থে সরকারঘনিষ্ঠ হন, ফলে তারা সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় সরব হন না। এদের একাংশ চায় না সাংবাদিকরা আইনি সুরক্ষায় স্বাধীনভাবে কাজ করুক।
৭. আন্তর্জাতিক চাপের অভাব
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বা দাতাগোষ্ঠীর তরফ থেকে এই ইস্যুতে পরিপূর্ণ চাপ প্রয়োগ হচ্ছে না। অন্য অনেক মানবাধিকার ইস্যুর মতো এটি আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে না।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য আলাদা আইন বা বিশেষ নীতিমালা রয়েছে। যদিও এগুলোর রূপ, কার্যকারিতা এবং প্রয়োগ ক্ষমতা ভিন্ন ভিন্ন। নিচে কিছু উল্লেখযোগ্য দেশের নাম ও তাদের সাংবাদিক সুরক্ষা আইনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হলো:
মেক্সিকো
Law for the Protection of Human Rights Defenders and Journalists (2012), এই আইন অনুযায়ী সাংবাদিকরা হুমকির সম্মুখীন হলে তাদের দ্রুত সুরক্ষা দেওয়ার জন্য একটি বিশেষ “প্রতিরক্ষা প্রক্রিয়া” (Protection Mechanism) চালু করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, স্থানান্তর, পুলিশি সহায়তা ও মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা করে।
কলম্বিয়া
সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীদের জন্য ২০০০ সাল থেকে একটি “Protection Program” চালু আছে।
এই প্রোগ্রামে হুমকির মুখে থাকা সাংবাদিকদের জন্য বুলেটপ্রুফ গাড়ি, দেহরক্ষী, বাসস্থান পরিবর্তন ও অন্যান্য সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
গুয়াতেমালা
“Program for the Protection of Journalists” চালু রয়েছে। সাংবাদিকদের প্রতি সহিংসতা বা হুমকি মোকাবেলায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়েছে।
ব্রাজিল
ব্রাজিল সরকার একটি জাতীয় পর্যবেক্ষণ প্রক্রিয়া (National Protection Mechanism) চালু করেছে যেটি সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতার ক্ষেত্রে দ্রুত তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা আছে।
ফ্রান্স
ফ্রান্সে সরাসরি “সাংবাদিক সুরক্ষা আইন” না থাকলেও, সাংবাদিকদের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বিশেষ আইন আছে যেমন: Press Freedom Law of 1881, সাংবাদিকদের তথ্যসূত্র গোপন রাখার অধিকার ও হুমকির মুখে রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা।
নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক (স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো) সাংবাদিক স্বাধীনতা এবং নিরাপত্তা এসব দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোর গুরুত্বপূর্ণ অংশ।নির্দিষ্ট “সাংবাদিক সুরক্ষা আইন” না থাকলেও গণমাধ্যমকর্মীদের জন্য শক্তিশালী আইনি সুরক্ষা ও দ্রুত বিচার ব্যবস্থা বিদ্যমান।
ফিলিপাইন
সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা একটি বড় সমস্যা হওয়ায় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সুরক্ষা নিয়ে আইন প্রণয়নের চেষ্টা চলছে।”Media Workers Welfare Bill” নামে একটি খসড়া আইন ২০২১ সালে গৃহীত হয়েছে, যা এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি।
দক্ষিণ আফ্রিকা
সংবিধানেই মতপ্রকাশ ও সাংবাদিকদের স্বাধীনতার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিভিন্ন মানবাধিকার আইনের মাধ্যমে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়।
জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক উদ্যোগ
জাতিসংঘের UN Plan of Action on the Safety of Journalists and the Issue of Impunity (2012) এটি একটি নীতিমালা, যেটি বিভিন্ন রাষ্ট্রকে সাংবাদিকদের সুরক্ষার জন্য আইন প্রণয়নের আহ্বান জানায়।
উপসংহার:
মেক্সিকো, কলম্বিয়া ও ব্রাজিলের মতো দেশে হুমকির মাত্রা বেশি হওয়ায় সাংবাদিক সুরক্ষায় বিশেষ আইন কার্যকর হয়েছে। আবার নরওয়ে বা সুইডেনের মতো দেশে শক্তিশালী গণতন্ত্র ও আইন ব্যবস্থার মাধ্যমে কার্যকর সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।
বাংলাদেশের মতো দেশে সাংবাদিক সুরক্ষা আইন এখনো প্রণয়নের পর্যায়ে আছে—এখানে আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা অনুসরণ করে একটি কার্যকর ও টেকসই আইন তৈরি করা যেতে পারে।
লেখক : আহমেদ আবু জাফর, চেয়ারম্যান, ট্রাস্টি বোর্ড