বাংলাদেশের প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মে ২০২৫,মাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ এ বিতর্কের জন্ম দেয় ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’। এই অধ্যাদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ব্যাপক প্রতিক্রিয়ায় উত্তাল হয়ে ওঠেন এবং লাগাতার কর্মবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানান। তারা দাবি করেন, এই আইন তাদের মৌলিক অধিকার, বিশেষত মতপ্রকাশ ও সংগঠনের স্বাধীনতার উপর আঘাত হানে।
অধ্যাদেশটির মূল বিষয়বস্তু ছিল সরকারি কর্মচারীদের শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। এতে চারটি আচরণ—যেমন কর্মবিরতি, সহকর্মীকে উসকানি দেওয়া, অনুপস্থিতি এবং কর্তব্য পালনে বাধা সৃষ্টি করাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। শাস্তির বিধান হিসেবে রাখা হয়েছে চাকরি থেকে অপসারণ, বরখাস্ত অথবা নিম্নপদে অবনমন। সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী, এই আইন একটি প্রশাসনিক সংস্কার এবং নাগরিক সেবায় শৃঙ্খলা ও গতি আনয়নের লক্ষ্যে প্রণীত। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের মাধ্যমে আন্দোলন ও প্রতিবাদের অধিকার সীমিত করে ফেলা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
এই প্রেক্ষাপটে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর নেতা হাসনাত আবদুল্লাহর কিছু বক্তব্য বিতর্কের জন্ম দেয়। তিনি একদিকে সচিবালয়ের কর্মচারীদের দুর্নীতির সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে বলেন, “আমরা রক্ত দিচ্ছি আর ওরা সচিবালয়ে বসে টাকা ভাগ করছে।” আবার অন্যদিকে তিনি সচিবালয় ঘেরাও ও আন্দোলনকে স্বৈরাচারী ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করেন। এই ধরনের পরস্পরবিরোধী মন্তব্য তার রাজনৈতিক অবস্থান ও গণতান্ত্রিক চেতনা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। একদিকে তিনি নিজে ক্ষমতার কাঠামোতে স্বচ্ছতা দাবি করছেন, অন্যদিকে প্রশাসনের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদকে দমনযোগ্য বলে অভিহিত করছেন—এই দ্বৈততা তাকে জনগণের চোখে সন্দেহজনক করে তোলে।
সচিবালয়ের আন্দোলন নতুন এক বাস্তবতার জন্ম দিয়েছে। এতে দেখা গেছে, রাষ্ট্রীয় কর্মচারীরা নিজেদের পেশাগত মর্যাদা রক্ষায় কতটা৭ সংবেদনশীল ও সক্রিয়। একইসঙ্গে এটা একটি বড় প্রশ্নের জন্ম দেয়—গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রশাসনিক শৃঙ্খলার নামে নাগরিক অধিকার সীমিত করা কি আদৌ গ্রহণযোগ্য?
আইন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই অধ্যাদেশ রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্বকে অবারিত ক্ষমতা দিচ্ছে এবং কর্মকর্তাদের স্বাধীন মতপ্রকাশ ও সংগঠনের অধিকার খর্ব করছে। গণমাধ্যমগুলো—যেমন প্রথম আলো, বিবিসি বাংলা ও একাত্তর টিভি—এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরেছে এবং জনমত গঠনে ভূমিকা রাখছে।
এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো সংলাপ। সরকার ও আন্দোলনকারীদের মধ্যে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না হলে প্রশাসন ও রাজনীতির মাঝে এক দীর্ঘস্থায়ী আস্থার সংকট সৃষ্টি হতে পারে। একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদের উচিত নিজের বক্তব্য ও অবস্থানকে পরস্পরবিরোধী না রেখে জনগণের অধিকার ও ন্যায়ের পক্ষে সুস্পষ্ট ভূমিকা রাখা।
সরকারি চাকরি সংশোধন অধ্যাদেশ ২০২৫ কেবল একটি আইন নয়, এটি প্রশাসনিক সংস্কার, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং রাজনৈতিক সততার পরীক্ষায় এক সন্ধিক্ষণ হয়ে উঠেছে। এই মুহূর্তে প্রয়োজন দায়িত্বশীল নেতৃত্ব, ন্যায্য নীতি এবং সংবেদনশীল রাষ্ট্রচিন্তা—যা জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে এবং গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করতে সহায়ক হতে পারে।