০৯:৫৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫, ১৫ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

বিলুপ্তির পথে শতাব্দী প্রাচীন তামা-কাঁসা শিল্প

  • প্রকাশিত ০৬:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
  • ৯ বার দেখা হয়েছে

ডেইলি স্বদেশবিচিত্রা প্রতিহবেদক : বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক গৌরবময় অনুষঙ্গ ছিল তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র। রান্নাবান্না, পরিবেশন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কিংবা পানীয় সংরক্ষণসহ প্রতিটি ঘরোয়া প্রয়োজনে এসব ধাতব পণ্যের ব্যবহার ছিল অবিচ্ছেদ্য। দেশের অন্যান্য জেলার মতো লালমনিরহাটেও এসব তৈজসপত্র এক সময় ছিল প্রতিটি পরিবারের নিত্যসঙ্গী। তবে আধুনিকতা ও সস্তা বিকল্প পণ্যের দাপটে আজ বিলুপ্তির পথে এই ঐতিহ্যবাহী তামা ও কাঁসা শিল্প।

বাঙালির নিত্যদিনের তৈজসপত্র হিসেবে তামা-কাঁসার ব্যবহার কমলেও অভিজাত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কাসার থালায় খাবার পরিবেশনকে আতিথেয়তার অপরিহার্য অংশ হিসেবে মানেন। তাদের ব্যবহৃত তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্রের রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ নাম ও নকশা। যেমন; থালায় কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী; জগে কৃষ্ণচূড়া, ময়ুর আঁধার; বাটিতে রামভোগী, গোলবাটি; আর চামচে বোয়াল মুখী, চাপিলামুখী ইত্যাদি। এছাড়াও পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গলঘট ও কাসার বাদ্যযন্ত্র এক সময় অনেক জনপ্রিয় ছিল।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, এ উপমহাদেশে তামা-কাঁসা শিল্পের শুরু মোগল আমলের বহু আগেই। মোগল শাসনামলে এ অঞ্চলের কারুশিল্পে ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং অস্ত্র থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যে এর ব্যবহার বাড়ে। ব্রিটিশ শাসনামলে কারুকার্যখচিত থালা-বাটি, সুরাই, প্রদীপ ঘরে ঘরে রুচির প্রতীক হয়ে ওঠে। আর এ দেশে এই শিল্পের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র ছিল ঢাকার ধামরাই।

তবে এখন এই ঐতিহ্য রক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সস্তা বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা, দক্ষ কারিগরের অভাব, নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি, কাঁচামালের সংকট এবং দুর্বল বিপণন ব্যবস্থাই এই শিল্পের অবনতির প্রধান কারণ।

লালমনিরহাট জেলা শহর ও উপজেলা পর্যায়ের বড় বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে কাঁসা-পিতলের পণ্য বিক্রি হলেও সেগুলো বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। খোলা দোকানগুলোতেও আগের মতো ক্রেতার ভিড় নেই।

দোকানিদের কাছ থেকে দেব-দেবীর মূর্তি ও অন্যান্য পণ্যের দাম জানতে চাইলে তারা বলেন, বড় আকারের দেবদেবীর মূর্তির দাম ১ থেকে ৩ লাখ টাকা, রাধাকৃষ্ণ মূর্তির দাম ২০ থেকে ৮০ হাজার এবং ছোট তৈজসপত্র ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত। অনেক সময় ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ীও এসব পণ্য সরবরাহ করা হয়।

জেলা সদরের বড়বাড়ী হাটের ব্যবসায়ী জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘আগে অনুষ্ঠান কিংবা বিয়েতে উপহার হিসেবে এসব জিনিসের কদর ছিল। হিন্দু-মুসলমান সবাই কিনতেন। এখন বিক্রি নেই বললেই চলে।’

একজন প্রবীণ ক্রেতা চন্দ্র ঠাকুর বলেন, ‘পারিবারিক রীতির কারণে কিছু কিছু কিনতে হয়। কিন্তু দাম এত বেশি যে কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাসায় রাখলেও চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।’

গৌর নিতাই ভাণ্ডার-এর তত্ত্বাবধায়ক বিপ্লব রায় বলেন, ‘গত ১৫ বছরে কাঁসা-পিতলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তামা-কাসার ব্যবসায়ী তাপস রঞ্জন বণিক বলেন, ‘একসময় এটি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। এখন মানুষ শুধু সস্তা পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। অথচ তামা-কাসার পাত্রে পানাহার করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এই বিশ্বাস একসময় খুবই প্রচলিত ছিল।’

রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। মূল্যবৃদ্ধি ও সস্তা বিকল্পের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন আধুনিকায়ন, সুলভ মূল্য ও কার্যকর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।’

ব্যবসায়ীদের মতে, কাঁসা-পিতলের ঐতিহ্য রক্ষায় এসব পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজন সরকারি নীতিগত সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও আধুনিক বিপণন ব্যবস্থা। অন্যথায় সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে বাঙালির শতাব্দী প্রাচীন এই ঐতিহ্য।
ডেইলি স্বদেশবিচিত্রা/এআর

Tag :
জনপ্রিয়

শ্রমিক দল নেতা শেখ আহমদ আলী রানার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা: উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির অভিযোগ

বিলুপ্তির পথে শতাব্দী প্রাচীন তামা-কাঁসা শিল্প

প্রকাশিত ০৬:৪৮:৫১ অপরাহ্ন, রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫

ডেইলি স্বদেশবিচিত্রা প্রতিহবেদক : বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক গৌরবময় অনুষঙ্গ ছিল তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্র। রান্নাবান্না, পরিবেশন, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান কিংবা পানীয় সংরক্ষণসহ প্রতিটি ঘরোয়া প্রয়োজনে এসব ধাতব পণ্যের ব্যবহার ছিল অবিচ্ছেদ্য। দেশের অন্যান্য জেলার মতো লালমনিরহাটেও এসব তৈজসপত্র এক সময় ছিল প্রতিটি পরিবারের নিত্যসঙ্গী। তবে আধুনিকতা ও সস্তা বিকল্প পণ্যের দাপটে আজ বিলুপ্তির পথে এই ঐতিহ্যবাহী তামা ও কাঁসা শিল্প।

বাঙালির নিত্যদিনের তৈজসপত্র হিসেবে তামা-কাঁসার ব্যবহার কমলেও অভিজাত সনাতন ধর্মাবলম্বীরা কাসার থালায় খাবার পরিবেশনকে আতিথেয়তার অপরিহার্য অংশ হিসেবে মানেন। তাদের ব্যবহৃত তামা, কাঁসা ও পিতলের তৈজসপত্রের রয়েছে বৈচিত্র্যপূর্ণ নাম ও নকশা। যেমন; থালায় কাস্তেশ্বরী, রাজভোগী; জগে কৃষ্ণচূড়া, ময়ুর আঁধার; বাটিতে রামভোগী, গোলবাটি; আর চামচে বোয়াল মুখী, চাপিলামুখী ইত্যাদি। এছাড়াও পূজা-অর্চনায় ব্যবহৃত মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গলঘট ও কাসার বাদ্যযন্ত্র এক সময় অনেক জনপ্রিয় ছিল।

ইতিহাস পাঠে জানা যায়, এ উপমহাদেশে তামা-কাঁসা শিল্পের শুরু মোগল আমলের বহু আগেই। মোগল শাসনামলে এ অঞ্চলের কারুশিল্পে ব্যাপক উন্নতি ঘটে এবং অস্ত্র থেকে শুরু করে নিত্যপণ্যে এর ব্যবহার বাড়ে। ব্রিটিশ শাসনামলে কারুকার্যখচিত থালা-বাটি, সুরাই, প্রদীপ ঘরে ঘরে রুচির প্রতীক হয়ে ওঠে। আর এ দেশে এই শিল্পের প্রধান উৎপাদন কেন্দ্র ছিল ঢাকার ধামরাই।

তবে এখন এই ঐতিহ্য রক্ষা করা বেশ কঠিন হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, সস্তা বিকল্প পণ্যের সহজলভ্যতা, দক্ষ কারিগরের অভাব, নতুন প্রজন্মের অনাগ্রহ, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ঘাটতি, কাঁচামালের সংকট এবং দুর্বল বিপণন ব্যবস্থাই এই শিল্পের অবনতির প্রধান কারণ।

লালমনিরহাট জেলা শহর ও উপজেলা পর্যায়ের বড় বাজারগুলো ঘুরে দেখা যায়, হাতে গোনা কয়েকটি দোকানে কাঁসা-পিতলের পণ্য বিক্রি হলেও সেগুলো বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে। খোলা দোকানগুলোতেও আগের মতো ক্রেতার ভিড় নেই।

দোকানিদের কাছ থেকে দেব-দেবীর মূর্তি ও অন্যান্য পণ্যের দাম জানতে চাইলে তারা বলেন, বড় আকারের দেবদেবীর মূর্তির দাম ১ থেকে ৩ লাখ টাকা, রাধাকৃষ্ণ মূর্তির দাম ২০ থেকে ৮০ হাজার এবং ছোট তৈজসপত্র ১৫০ টাকা থেকে শুরু করে লাখ টাকা পর্যন্ত। অনেক সময় ক্রেতার চাহিদা অনুযায়ীও এসব পণ্য সরবরাহ করা হয়।

জেলা সদরের বড়বাড়ী হাটের ব্যবসায়ী জ্ঞানেন্দ্র নাথ রায় বলেন, ‘আগে অনুষ্ঠান কিংবা বিয়েতে উপহার হিসেবে এসব জিনিসের কদর ছিল। হিন্দু-মুসলমান সবাই কিনতেন। এখন বিক্রি নেই বললেই চলে।’

একজন প্রবীণ ক্রেতা চন্দ্র ঠাকুর বলেন, ‘পারিবারিক রীতির কারণে কিছু কিছু কিনতে হয়। কিন্তু দাম এত বেশি যে কেনা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। বাসায় রাখলেও চুরি হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে।’

গৌর নিতাই ভাণ্ডার-এর তত্ত্বাবধায়ক বিপ্লব রায় বলেন, ‘গত ১৫ বছরে কাঁসা-পিতলের দাম বেড়েছে প্রায় ১৪ গুণ। বাজার প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে।’

তামা-কাসার ব্যবসায়ী তাপস রঞ্জন বণিক বলেন, ‘একসময় এটি আমাদের পারিবারিক ঐতিহ্য ছিল। এখন মানুষ শুধু সস্তা পণ্যের দিকে ঝুঁকছে। অথচ তামা-কাসার পাত্রে পানাহার করা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এই বিশ্বাস একসময় খুবই প্রচলিত ছিল।’

রংপুর পুলিশ লাইন স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক ও সংস্কৃতি গবেষক জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘বাঙালির সংস্কৃতি ও জীবনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত এই শিল্প আজ বিলুপ্তির পথে। মূল্যবৃদ্ধি ও সস্তা বিকল্পের কারণে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে গেছে। এই ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে হলে প্রয়োজন আধুনিকায়ন, সুলভ মূল্য ও কার্যকর সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা।’

ব্যবসায়ীদের মতে, কাঁসা-পিতলের ঐতিহ্য রক্ষায় এসব পণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রয়োজন সরকারি নীতিগত সহায়তা, স্বল্প সুদে ঋণ, কারিগরি প্রশিক্ষণ ও আধুনিক বিপণন ব্যবস্থা। অন্যথায় সময়ের সঙ্গে হারিয়ে যেতে পারে বাঙালির শতাব্দী প্রাচীন এই ঐতিহ্য।
ডেইলি স্বদেশবিচিত্রা/এআর