১ সেপ্টেম্বর। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’কে ভিত্তি করে ১৯৭৮ সালের এই দিনে ঢাকার রমনা বটমূল চত্ত্বরে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সৃষ্টি করেন নতুন এক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
আজ দলটির ৪৭তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী।
যার নাম বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)।
চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে দেশে একদলীয় শাসন ও বাকশাল প্রতিষ্ঠা এবং শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর দেশে যে শুন্যতা সৃষ্টি হয়, তা পূরণে বিএনপির অভ্যুদয়। যার পুরোধা ছিলেন শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ।
এই দলে তিনি বাম, ডান ও মধ্যপন্থীসহ এক ঝাঁক নতুন মেধাবী মুখের সমন্বয় করেন। যার মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশ সদস্য ছিলেন তরুন। ১ সেপ্টেম্বর বিকাল ৫টায় রমনা রেস্তোরাঁয় এক সংবাদ সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র পাঠের মাধ্যমে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের যাত্রা শুরু।
এ সময় ১৯৭৮ সালের ২৭ অক্টোবর যুবদল ও ১৯৭৯ সালের ১ জানুয়ারি ছাত্রদল গঠিত হয়।
জিয়াউর রহমানের শাসনামলে দলটি সাংগঠনিক ভাবে দলটি সাধারণ মানুষের কাছে ব্যপক গ্রহণযোগ্যতা লাভ করে। একজন সৎ, সাহসী এবং আধুনিক নেতা হিসেবে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ধারা সৃষ্টি করেন।
সারা দেশকে শোকস্তব্ধ করে ১৯৮১ সালের ৩০ মে চট্টগ্রামে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। রেখে যান দুই সন্তান, তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো এবং তার স্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে।
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড শুধু একজন রাষ্ট্রপতির মৃত্যু নয় ছিলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের জটিল অধ্যায়। সদ্য গঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপির জন্য কঠিন একটি সময়।
প্রেসিডেন্ট জিয়া হত্যাকাণ্ডের পর ১৯৮২ সালে ক্ষমতা দখল করেন সেনা শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ।
তার আকস্মিক মৃত্যুর পর বিএনপির সভাপতি নির্বাচিত হন বিচারপতি আব্দুস সাত্তার।
জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী খালেদা জিয়া একজন সাধারণ গৃহিণী থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ করে হাল ধরেন বিএনপির।
১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি বিএনপির প্রাথমিক সদস্যপদ লাভের পর ১৯৮৪ সালের ১০ মে পূর্ণাঙ্গ চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন তিনি।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখে বিএনপি। তার নেতৃত্বে ১৯৮৩ সালে বিএনপি সহ সাত-দলীয় ঐক্যজোট গঠিত হয়, যা ছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান শক্তি। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে তার এই ভূমিকা তাঁকে ‘আপসহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি এনে দেয়। আন্দোলনের সময় তিনি ১৯৮৩, ১৯৮৪ এবং ১৯৮৭ সালে একাধিকবার গ্রেফতার হন ।
দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রাম এবং সর্বদলীয় ঐক্যের মাধ্যমে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদের পতন হলে ব্যপক জনপ্রিয়তায় ১৯৯১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হয় বিএনপি।
খালেদা জিয়া বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এবং রাষ্ট্রপতি-শাসিত থেকে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় উত্তরণের জন্য সংবিধানের ঐতিহাসিক দ্বাদশ সংশোধনী পাশ করেন।
পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০১ সালের ১ অক্টোবর আবারও দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করে বাংলাদেশে জাতীয়তাবাদি দল। এ সময় দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ১ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয় এবং সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ ২.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে ।
২০০৬ সালের ২৯ নভেম্বর তৎকালীন বিএনপি জোট সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় যা ‘ওয়ান-ইলেভেন’ বা ‘১/১১’ হিসেবে পরিচিত।
সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ড. ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে ক্ষমতা গ্রহণ করে। এই সরকার রাজনৈতিক নেতৃত্বকে বিরাজনীতিকরণের লক্ষ্যে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা ঘোষণা করে। এ সময় গ্রেফতার করা হয় শেখ হাসিনা সহ বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে। নতুন সংকটে পরে দলটি।
এ সময় ১/১১ সরকার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট এবং জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলাসহ একাধিক মামলা দায়ের করে।
২০০৭ সালের ৭ মার্চ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকেও দুর্নীতি মামলায় গ্রেপ্তার করে। বিএনপির পক্ষ থেকে দাবি করা হয় মামলাগুলো মামলাগুলো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। মামলায় প্রায় ১৮ মাস কারাবাসে থাকার পর ২০০৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান জামিন লাভ করেন এবং চিকিৎসার জন্য সপরিবারে যুক্তরাজ্যে চলে যান।
২০০৮ সালের ২৯শে ডিসেম্বরে নবম জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।
আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপি’র নেতাকর্মীদের ওপর চালায় ব্যাপক দমন-পীড়ন। এ সময় অনুষ্ঠিত হয় তিনটি একপাক্ষিক নির্বাচন। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময় বিরোধী দলের রাজনৈতিক কার্যকলাপ কার্যত নিষিদ্ধ করা হয় এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার করা হয়। ‘ক্রসফায়ার’ ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বৃদ্ধি পায় । ২০০৮ থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত বিএনপির ২,২৭৬ জন নেতাকর্মীকে ক্রসফায়ারে হত্যা এবং ১৫৩ জনকে গুম করা হয়।
এ সময় গুমের শিকার হওয়া উল্লেখযোগ্য নেতাদের মধ্যে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমদ, ইলিয়াস আলী এবং চৌধুরী আলম।
গুমের শিকার হওয়াদের বেশিরভাগই ছিলেন বিরোধী দলীয় নেতা, কর্মী এবং ভিন্ন মত পোষণকারী ।
এ সময় বিএনপির প্রায় ৩৫ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে লক্ষাধিক মামলা দায়ের করা হয়। পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২১ সালের জুন মাস পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৭ হাজার মামলা করা হয়েছে ।
আওয়ামী সরকারের মেয়াদে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের কারাদণ্ড দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে হাইকোর্ট ১০ বছর পর্যন্ত বৃদ্ধি করে । একই বছরের ২৯ অক্টোবর জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় তার ৭ বছরের সাজা হয়।
২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়া কারাবন্দী হন এবং তাকে ঢাকার পুরনো কেন্দ্রীয় কারাগারের একটি পরিত্যক্ত ভবনে রাখা হয় ।
পরবর্তীতে, ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকারি নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে তিনি মুক্তি পান। গৃহবন্দী থাকেন গুলশানের বাড়ি ফিরোজায়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে এ সময় বিএনপির প্রতি চলে প্রতিহিংসার রাজনীতি। এ সময় শারীরিক অনুপস্থিতি সত্ত্বেও বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে দলের কার্যক্রম পরিচালনা করেন।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় তারেক রহমানের নেতৃত্বে বিএনপির অংশগ্রহণে এবং ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ এর ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের।
ক্ষমতায় আসে ড. মোহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার।
রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত শতাধিক মামলা থেকে মুক্তি পান বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপার্সন তারেক রহমান এবং তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমান।
শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হাতে গড়া বিএনপি, এরশাদবিরোধী গণআন্দোলন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দীর্ঘ আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণমুখী রাজনৈতিক দলে রূপান্তরিত হয়েছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিএনপি কেবল একটি দলের নাম নয়, বরং রাষ্ট্রের বিকল্প দর্শন ও গণতন্ত্রের প্রতীক, যা জিয়াউর রহমানের হাতে রচিত ভিত্তি ও তাঁর রাজনৈতিক উত্তরাধিকারের ওপর দাঁড়িয়ে আজও প্রাসঙ্গিক ।
রাজু আলীম।
কবি , সাংবাদিক ও মিডিয়া ব্যক্তিত্ব