নাম তাঁর রহমান বাহাদুর। একদিন সে মধু মনে করে আতর খেয়ে ফেললে সেই থেকে তাঁর নাম হয়ে যায় আতর আলী। রহমান বাহাদুর বলে এখন কেউ তাঁকে ডাকে না। গ্রামের লোকজন আতর আলী বলেই ডাকে। একদিন ডাকপিয়ন রহমান বাহাদুর নামে চিঠি এলে ডাকপিয়ন রহমান বাহাদুরকে খুঁজে পায় না। গ্রামের লোকজনও ভুলে গেছে শুধু আতর আলী নামটাই মনে রেখেছে। আতর আলীর চেহরা দেখতে স্বামী বিবেকানন্দের মত। তবে একটু সাজ গোজ করলে তাহলেতো আর কথাই নেই। ইতি পূর্বে আতর আলীর চেহারা দেখে স্কুলের দেড়শ মেয়ে আতর আলীর পেছনে পেছনে ঘুরে অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়েছে। তাঁর নাকি মন টন বলে কিছু নেই। ছেলে না মেয়ে এই নিয়ে সন্দেহ দেখা দিয়েছে মেয়েদের চোখে।
আতর আলী ফিরে তাকাতেই মেয়েটি হাঁফাতে হাঁফাতে কাছে এসে দাঁড়ালো বেশ কিছু পথ দৌড়ে এসেছে সে। আতর আলী একটু তাকিয়ে রমিনা বললো কিছু বলবে? আমার তাড়া আছে। মুখটা বাঁকা করে মমতা মাখা কণ্ঠে বললো, শুনলাম তুমি সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাক।
হ্যাঁ সারাক্ষণ মায়ের আঁচল ধরে থাকছি তাতে কি হয়েছে তোমার। একটু থেমে আবার বললো, মনে হচ্ছে তুমি আমার সব খবর রাখ। রমিনা কিছু বললো না শুধু চোখে চোখ রেখে মায়াবী হাসি দিয়ে চোখটি নামিয়ে নিল মাটির দিকে। এবার আতর আলী রমিনার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, পৃথিবীর সব মানুষ কারো না কারোর আঁচল ধরে ঘোরে। তোমরা যখন মায়ের আঁচল ধরে ঘুরতে পার ছেলেরা ঘুরলে দোষ কি। এবার রমিনা বেশ অবাক হল। আতর আলীর কথা সে জীবনেও শুনে নাই। আগে আতর আলীকে বোকা বোকা লাগত এখন কিন্তু তা মনে হচ্ছে না।
আতর আলী মুখটা বাঁকা করে রমিনার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, মনে হচ্ছে তোমাকে ব্যারামে ধরেছে ফকির দেখাতে হবে।
এবার রমিনা লজ্জার মাথা খেয়ে বলল, এই ব্যারাম সারাবার জন্যই তো তোমার কাছে আসি।
এবার আতর আলী রমিনার মনের কথা বুঝতে পেরে বেশ অবাক হয়ে ধপাস করে ঘাসের উপর বসে পড়ল। তারপর বলল, মানুষ ইচ্ছা করলে সব কিছু পারে না।
রমিনা কান্না ভরা স্বরে, কেন পারে না শুনি।
আতর আলী রমিনার যাবার পথের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মনে হচ্ছে রমিনা আমাকে তুমি তালাক দিয়ে গেলে।
রমিনা আতর আলীর দিকে তাকিয়ে রাগের স্বরে বলল, শুধু তালাক নয় পৃথিবীতে এর চেয়ে বেশি কিছু থাকলে তোমাকে তাই দিয়ে যেতাম বলেই রাগ করে চলে গেল একবারও ফিরে তাকালো না। আতর আলী রমিনার পথের দিকে তাকিয়ে রইলো অবাক হয়ে।
আতর আলী পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে আর চিন্তা করছে এতটুকু মেয়ে প্রেম ঠিকঠাক বুঝে গেছে এবং কীভাবে প্রেম করতে হয় তাও জানে। আজকাল ছেলেমেয়েরা লেখা পড়ায় সময় না দিয়ে সারাদিন সিনেমা দেখে আর প্রেম করে। এই জন্যই ছেলেমেয়েরা ব-কলম হয়ে যাচ্ছে দিনদিন।
ডাকটা শোনা মাত্র বুকের ভিতর কেমন যেন নাড়াচাড়া করে উঠলো। মনে হচ্ছে খুব পরিচিত কেউ তাকে ডাকছে। এই নামে সে একদিন লেখালেখি করত। তবু সাহিত্যিক মহল আতিক বলে ডাকতো না। ডাকতো ফিরোজ নামে কিন্তু একজন ডাকতো। আজ স্মৃতির আড়ালে এক বুক কষ্ট নিয়ে পালিয়ে গেল অন্যের হাত ধরে। সেই দিনের কথা ইচ্ছা করে মনে করতে চাই না ফিরোজ আতিক। আবার ডাক পড়ল।
ফিরোজ আতিক ঘাড় ঘুড়িয়ে তাকিয়ে মুখ দেখেই মনে হল যখন আকাশ ভেঙ্গে মাথার উপর পড়েছে। ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, আমাকে চিনতে পেরেছ? ফিরোজ আতিক কখনো ভাবেনি রিপার সাথে এইভাবে দেখা হবে দীর্ঘ বছর পর। এই মুহূর্তে মনে চাচ্ছে রিপাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বুকের ভিতরের কষ্টগুলো দূর করতে। তা-কি সম্ভব যাকে না পাওয়ার কষ্ট তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলে কি দূর করা সম্ভব। তা কখনো হয় না।
তারপর ভাঙা ভাঙা কণ্ঠে বলল, চিনতে পারবো না কেন? চল্লিশের পর মানুষ তেমন পরিবর্তন হয় না। বরং শরীর ভেঙে যায়।
রিপা শুধু হেসে দিয়ে বলল, তুমি দেখি আগের মতই কথা বলো এখনো। কেন আমিতো আর পরিবর্তন হয়নি একটু থেমে বলল, রিপা আপনি কোথা থেকে এলেন?
রিপা একটু অবাক হয়ে বলল, হঠাৎ তুমি থেকে আপনি বলছ যে?
কি আর বলবো, আপনি তো আর আমার আগের রিপা নেই। ইচ্ছা করলে ছোঁয়া যাবে?
কথাটা শুনে বেশ লজ্জা পেয়ে কাপড় দিয়ে মুখটা লুকিয়ে নিল রিপা। তোমার হাসি কিন্তু আগের মতই আছে একটুও পরিবর্তন হয়নি বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল, আমি নট হ্যাপি মাই লাইফ ফিরোজ আতিক। ইচ্ছা করলেই কি সুখী হওয়া যায়?
আমিতো সুখী হতাম আপনাকে পেলে। কথাগুলো বলতে বলতে চোখে পানি ছলছল করছে মনে চাচ্ছে শব্দ করে কেঁদে দিতে। তারপর বলল, আমি আপনাকে কিছু দিতে না পারলেও ভালোবাসাতো দিতে পারতাম। রিপা আপনার জন্য কত ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছি এই বুকে একবার বুঝার চেস্টা করলেন না। আপনাকে না পাওয়ার কষ্ট কত তা কি বুঝানো যায়? আমিতো আপনাকে দু’বেলা দুই মুঠো ভাত মোটা কাপড় দিতে পারতাম। আপনি যার হাত ধরে চলে গেলেন তার মত অর্থ আমার ছিল না কিন্তু আপনার জন্য ভালোবাসা ছিল আমার বুকে। আপনাকে না পাওয়ার বেদনায় আজও কাঁদি। ভুলতে পারিনি এখনো। আপনি ছিলেন আমার প্রথম প্রেম এবং শেষ প্রেম। আপনি আমার স্বপ্নের দেবী।
আতর আলী এখন প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে। কখনো ফিরোজ আতিক, কখনো রহমান বাহাদুর। নাম বদলের পালায় জীবন কখনো থেমে থাকেনি। আতর আলীর টাকা ছিল না সত্য কিন্তু তার বুকে একরাশ ভালোবাসা ছিল। কিন্তু সেই ভালোবাসা কখনই স্থায়ী হয়নি। যখন প্রেমিকা রিপা হাত বাড়িয়ে দিল তখন সে ফিরে তাকালো না। আতর আলীর প্রেম উপাখ্যান শুধু কষ্টই দিয়েছে কিন্তু জীবনের পথ দেখায় নাই। যখন সে চাকরীর জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছে। এমনি ক্ষুধার জ্বালায় কমলাপুর রেলস্টেশনে কুলির কাজও করতে হয়েছে কিন্তু সেখানেও টিকে থাকতে পারেনি। এমন সময় পথ চলতে চলতে সামনে ডাস্টবিন পড়ে যায়। দেখে সেখানে টোকাইরা ডাস্টবিন থেকে খাবার তুলে তুলে খাচ্ছে। আতর আলী ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে টোকাই এর সাথে খাওয়ার জন্য বসে যায়। একদিন এই টোকাইরা তার বিদেশে যাওয়ার জন্য নিজেদের রক্ত বিক্রি করে হলেও টাকা দিয়েছে। অথচ নিজের কাকা তাকে এক টাকা দিয়ও সাহায্য করেনি। আতর আলীর বাবার মৃত্যুর পর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। ভালো ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কোথাও কোন চাকরি পেল না। তাই আতর আলীর আক্ষেপ,” ইণ্টারভিউ দিয়ে কখনো চাকরি হয়না সাথে মামা, খালা ও মন্ত্রীর হাত থাকতে হয়।” আতর আলীর এই ধরনের কোন সাহায্য করার লোক ছিল না। টোকাইয়ের টাকা নিয়ে সে বিদেশে পাড়ি জমালো। এই দিকে মা জঙ্গলের শাক পাতা খেয়ে বেঁচে থাকে। জীবন দুঃখ কষ্টের মধ্য দিয়ে গড়াতে থাকে। বিদেশ থেকে ফিরে টোকাইয়ের টাকা গুলো ফেরৎ দিয়ে দিয়েছে।
আতর আলী এবার এলো অন্যভাবে একদিন সকালে আতর আলী অফিসে আসলেই আতর আলীকে জানানো হলো হেড অফিস থেকে ফোন এসেছে। তাড়াতাড়ি ম্যানেজারের সাথে দেখ করতে।
আতর আলী হেড অফিসে এসে ম্যানেজারের দরজায় দাঁড়িয়ে সালাম দিলেই ম্যানেজার আতর আলীর হাতে বিমানের টিকিট দিয়ে বলল, তোমার বাড়ি থেকে ফোন এসেছে। তোমার মায়ের নাকি শরীর ভালো নেই। ম্যনেজারের কথা শুনে আতর আলী বেশ অবাক হয়ে বলল, একি বলছেন স্যার?
ফোনে তো তাই বলল, একটু থেমে আবার বলল, তোমার মায়ের শরীর ভালো হলে ফিরে এসো। এখন আর দেরী করা বোধ হয় ঠিক হবে না। এই জন্য আজকের রাতের ফ্লাইটের টিকিট কেটেছি। তুমি সব কিছু গুছিয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে পড়। আতর আলী সালাম দিয়ে রুম থেকে বেড়িয়ে পরে।
বিমান ছাড়বে রাত একটার দিকে। আতর আলী তাড়াতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে নিয়ে রাত বারটার আগেই এয়ারপোর্টে পৌঁছে গেল। সকাল হতেই ঢাকায় নেমে পড়ল। বাসায় এসে মাকে দেখে অবাক হয়ে যায়। মা বলল, একটু মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলাম। মাকে সান্ত্বনা দিয়ে পরেরদিন বাসা থেকে বেড়িয়ে টোকাইদের সাথে দেখা এক বছরের জন্য টাকা বুঝিয়ে দিল ব্যাংকের মাধ্যমে। তারপর টোকাইদের বলল, আমার অনেক দিনের ইচ্ছা তোমাদের নিয়ে একদিন সোনার গাঁও হোটেলে খানা খাব। আতর আলীর কথাটা শোনামাত্র টোকাইরা হই চই করে উঠল।
আতর আলী টোকাইের সাথে সোনারগাঁও হোটেলে খানা খেয়ে দুই দিন পর ঢাকা থেকে ফিরে এলো গ্রামের বাড়িতে।
জীবনের সাথে সংগ্রাম করে বেঁচে ফেরাই হচ্ছে যুদ্ধ জয়ের কাজ। যারা হেরে যায় তাদের কাছে পৃথিবীর কোন কিছুই ভালো লাগে না। এমন কি প্রেম বলে যে বস্তুটি অনায়াসে ধরা দিলে টাকার অভাবে সেই প্রেম জানালা দিয়ে চলে যায়। একদিন রমিনা, রিপা তারা আতর আলীকে ভালো বেসেছিল কিন্তু অর্থের সংকটে পড়ে সেই প্রেম আবার ফিরিয়ে দিয়েছে। মানুষের জীবন সংগ্রাম নিহিত থাকে তার পেছনের আদর্শ আর বাবা মায়ের ভালোবাসা। আতর আলী যখন দিশেহারা হয়ে অন্ধকারে নিমজ্জিত তখন মা তাকে আশ্বাস দিয়ে ছিল, বাড়ি ভিটা বিক্রি করতে। সেই আশ্বাস নিয়ে যখন পথ চলতে শুরু করে তখন তার বিপদের বন্ধু হয়ে সামনে ধরা দেয় টোকাই বন্ধুরা। ভালোবাসা শুধু ছেলে মেয়ের সাথেই হয় তা নয়। ভালোবাসা বাবা মা, ভাই বোন এবং বন্ধু বান্ধব। আসল ভালোবাসা হচ্ছে বিপদের সময় যে এগিয়ে সামনে আসেবসেই হচ্ছে প্রকৃত বন্ধু। তার ভালোবাসাতেই জগৎ জয় করা যায়। প্রকৃত ভালোবাসা আতর আলী তাঁর জীবনের মানে খুঁজে পেয়েছেন।
লেখক সাহেদ বিপ্লব একজন সাদা মনের মানুষ। তাঁর ভিতরে কোন ছলচাতুরী নেই। আতর আলীর প্রেম উপাখ্যান লিখতে গেয়ে একটু এলোমেলো হয়েছে। প্রেম বলতে তিনি কি রাজনীতি বা নীতি বাক্য বোঝাতে চেয়েছেন না মানবিক প্রেম, না সত্যিকারের প্রেম, না প্রেমে হাবুডুবু খাওয়াকে বুঝাতে চেয়েছেন। আসলে তাঁর বিক্ষুব্ধ জীবনের চলার পথে যে প্রেম এসেছিল সে প্রেম আবার চলেও গেছে। অর্থের টানাপোড়েনের বিচ্ছিন্ন জীবন কোন কুল কিনারা যখন খুঁজে পায় না তখন আতর আলীরা দিশেহারা হয়ে প্রেমের উপাখ্যানে হয়তোবা দু’একটি নীতি বাক্য বলতেই পারে সেটি দোষের নয়। আতর আলীরা এভাবেই একদিন প্রেম নিবেদন করবে আমার বিশ্বাস।