তারেক আহামেদ বোখারী, বান্দরবান প্রতিনিধি।
বান্দরবানের সবুজ পাহাড়ের বুক চিরে উঠে এসেছে অসংখ্য প্রেরণার গল্প।
তবে তার মধ্যেই উজ্জ্বল হয়ে আছে এক নাম—ভিক্ষু উঃ-নন্দমালা থের।
তিনি শুধু একজন বৌদ্ধ সন্ন্যাসী নন, তিনি যেন পাহাড়ি সমাজে শিক্ষা ও মানবতার প্রতীক, এক জীবন্ত কিংবদন্তি।
শৈশবের অভাব, জীবনের নতুন লক্ষ্য
১৯৬৫ সালে লামা উপজেলার ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের সাঙ্গু মৌজার ত্রিশডেবা পাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন উঃ-নন্দমালা থের।
খুমি আদিবাসী জুমচাষি পরিবারে জন্ম নেওয়া এই মানুষটির শৈশব কেটেছে সীমাহীন দারিদ্র্য ও সংগ্রামের ভেতরে।
তবে সেই কষ্টই তাকে তৈরি করে দেয় নতুন স্বপ্ন দেখার শক্তি।
১৯৮৫ সালে সংসার জীবন ত্যাগ করে তিনি বেছে নেন বুদ্ধ সন্ন্যাসীর জীবন। তখন থেকেই শুরু হয় পাহাড়ি জনপদের জন্য এক আত্মনিবেদিত যাত্রা।
শিক্ষার অগ্রদূত
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোতে না পারলেও তিনি উপলব্ধি করেছিলেন—শিক্ষাই পারে সমাজকে বদলে দিতে।
“শিশুদের জন্য আলোর পথ তৈরি করতে হবে,”
এই চিন্তা থেকে তিনি স্থির করেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর শিশু-কিশোরদের জন্য শিক্ষার আলো জ্বালাবেন।
১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠা করেন জীনা মেজু অনাথ আশ্রম। এরপর একে একে গড়ে তোলেন—
১/ জীনা মেজু উচ্চ বিদ্যালয়
২/ জীনা মেজু টেকনিক্যাল কলেজ ইনস্টিটিউট
৩/ জীনা মেজু সানজেট উপজাতি ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র।
৪/ আলীকদম মেরিংচ সাঙ্গু মৈত্রী ম্রো আশ্রম।
৫/ জীনা মেজু কল্যাণ ট্রাস্ট
এবং আরও অসংখ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আজ এসব প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করছে পাহাড়ি জনপদের শত শত অনাথ শিশু-কিশোর।
তারা নতুন স্বপ্ন সেই অনাথ শিশুরা এখন—ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাংকার, শিক্ষক এখন মানবসেবায়..
রুপা মুরুং-১০ বছর: “ভিক্ষু উঃ-নন্দমালা থের আমাদের বাবা-মায়ের মতো।
তিনি আমাদের পড়াশোনা শেখাচ্ছেন, খাওয়াচ্ছেন আর ভালোবাসছেন।”
রানী ত্রিপুরা-১২ বছর: “আমরা আগে স্কুলে যাইনি। এখন ভিক্ষু সাহেব আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। তার জন্য আমরা স্বপ্ন দেখি।”
কিরণ চাকমা, ৯ বছর: “ভিক্ষু উঃ-নন্দমালা থের থাকলে আমরা নিরাপদ। তিনি আমাদের বাবা, শিক্ষক, বন্ধু সব একসাথে।”
গন্যমান্য ব্যক্তিদের বক্তব্য
নাজিম উদ্দীন স্থানীয় শিক্ষক: “ভিক্ষু উঃ-নন্দমালা শুধু একজন ভিক্ষু নন, তিনি পাহাড়ি সমাজের সত্যিকারের অগ্রদূত। তাঁর কাজ প্রমাণ করেছে একজন মানুষও বদলে দিতে পারে পুরো প্রজন্মের ভাগ্য।”
উপজেলা জামায়েত ইসলাম নেতা: “তিনি আমাদের সমাজে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন। এতিম ও অসহায় শিশুদের জন্য উঃ-নন্দমালা থের এক জীবন্ত আশ্রয়।”
সাঙ্গু মৌজা হেড়মেন- বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ: “দেশে-বিদেশে মানবতার কাজে বিশেষ অবদানের জন্য উঃ-নন্দমালা থেরকে রাষ্ট্রীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে অনেক সম্মাননা দেওয়া হয়েছে।
তিনি এক অনন্য মানবিক উদাহরণ।”
মানবতার আশ্রয়
স্থানীয়রা তাঁকে শুধুই সন্ন্যাসী হিসেবে দেখেন না, বরং একজন অভিভাবক মনে করেন।
এক অভিভাবক বলেন: “অভিভাবকহীন এতিম, অসহায় শিশুদের ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে আশ্রয়ের শেষ ঠিকানা উঃ-নন্দমালা থের।
তিনি না থাকলে আমাদের সন্তানরা শিক্ষার আলো দেখতে পারত না।”
বিলুপ্তির পথে থাকা খুমি সম্প্রদায়ের সন্তান উঃ-নন্দমালা থের আজ হয়ে উঠেছেন পাহাড়ি সমাজের আশার বাতিঘর।
তিনি যেন অন্ধকারে জ্বলে ওঠা এক প্রদীপ, নিজের আলোয় আলোকিত করছেন পুরো জনপদ।
এক জীবন্ত কিংবদন্তি
পাহাড়ের প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম নেওয়া এই মানুষটি আজ হয়ে উঠেছেন গর্ব, প্রেরণা এবং মানবতার প্রতীক।
তিনি শুধু পাহাড়ের নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য এক অনন্য আলোকবর্তিকা।
ভিক্ষু উঃ-নন্দমালা থের—একজন সন্ন্যাসী, একজন শিক্ষাগুরু, একজন মানবতার দূত।
দেশে ও বিদেশে মানবতার কাজে বিশেষ অবদানের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে সম্মানসূচক পদক পেয়েছেন।
এক জীবন্ত কিংবদন্তি, পাহাড়ের আলোকবর্তিকা, শিশুদের স্বপ্নের রূপকার।