২৫/০৪/২০২৪
“পচা ধূলিসাৎ”
রম্যরচনা
অরবিন্দ সরকার
বহরমপুর,মুর্শিদাবাদ।
পঞ্চানন বিশ্বাসের জন্ম নোনাডাঙা গ্রামে। সব জিনিসই পচনশীল,তাই বাপ্ মায়ের দেওয়া নাম অচিরেই পঞ্চানন থেকে পচা ছড়িয়েছে গ্রামে। ভোম্বল ওই গ্রামের মাতব্বর। মোটামুটি সচ্ছল পরিবার তার। পচা লেখাপড়ায় তেমন ভালো নয় কিন্তু খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বি,এ পাশ করেছে। স্কুল কলেজে কেউ পচা নয়, ফেল করা কবেই উঠে গেছে। এখন সবাই পাশ। ফার্স্ট ডিভিশন, সেকেন্ড,থার্ড ও পাশ ডিভিশনে পাশ করলেও সবাই এক জাতের কুলীন। কারণ এদের মধ্যে যাকেই জিজ্ঞাসা করা হোক না কেন, সবাই বলবে বি. এ পাশ। তাই পচার সঙ্গে ভালো মেশে এখন সবাই পচা! ভোম্বলদের নোনাডাঙা গ্রামে সবাই কাজে ব্যস্ত, সরকারি, বেসরকারি, কোম্পানির কাজের সঙ্গে যুক্ত। পচার লক্ষ্য একটা সরকারী চাকুরী অথবা বেসরকারি ঘরজামাই পদে চাকুরী। পচা পড়েছে স্কুলে– যে টাকা থাকলে বাঘের দুধ পাওয়া যায়! আশায় চাষা খাটে ইত্যাদি। ভোম্বল পচাকে বললো তুই তো বেকার, বাড়ীতেই রয়েছিস? তাহলে এক কাজ কর,- আমার গোয়ালের গরুগুলার দেখাশোনা কর। খাওয়া দাওয়া সব ফ্রি। বেতন কাঠামো তো বদলানো যাবে না, মাসে ধান দেবো পাঁচ আড়ি। পচা বললো – আমি কি গরু চরানোর জন্য লেখাপড়া শিখেছি? তুমি গ্রামের মোড়ল, তুমি তো প্রাইমারি স্কুলের গণ্ডি পেরোতে পারোনি? জমি জমা টাকা পয়সা আছে তোমার তাই এতো গ্রামে মুল্লাকি! টাকায় মানসম্মান, আমারও চলার মতো জমি জায়গা আছে। হাতখরচ বা শখ আহ্লাদের জন্য একটি চাকুরীর দরকার। দেখি চেষ্টা করলে বা কষ্ট করলে কেষ্ট অবশ্যই মিলবে!
পচা একদিন শহরে গেলো তার সাইকেলের টায়ার টিউব লাগাতে! চারিদিকে পোষ্টারে ছয়লাপ। বেসরকারি গার্ড, ফ্ল্যাটবাড়ির নাইটগার্ড অষ্টম শ্রেণী পাশ দরকার। প্রাইমারি, হাইস্কুলে কেরানী, পিওন ও শিক্ষকের জন্য ব্যবস্থা করা হয়। ন্যূনতম যোগ্যতা, মাধ্যমিক, হাইস্কুলের শিক্ষকের জন্য বি. এ পাশ হলেই চলবে।
পচা চোখ বুলিয়ে বারবার পড়ে আর দেখে অফিসের ঠিকানা। কারো নাকতলা, কারো কানতলা আবার কারো সুখতলায় অফিস। পচা সাইকেল দোকানে সারাতে দিয়ে কাছেই সুখতলা অফিস দেখতে পেলো। দ্যাখে লাইনে ভীড় খুব, তাড়াতাড়ি লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লো। সর্বত্র লাইন এ দেশে। বেলাইন হলেই পথভ্রষ্ট! অফিসের দারোয়ান গেটে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলো,টিপছাপ থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত একটি লাইন, অন্যটি মাধ্যমিক থেকে গ্রাজুয়েট। পচা ছুটে গিয়ে সবার আগে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়লো। পচাকে ভেতরে আসতে বললো দারোয়ান। পচা ঢুকে নমস্কার করলো। এক ব্যক্তি কাগজ পত্র দেখাতে বললো।পচা বললো, সাইকেল সারাতে শহরে এসেছি, কাগজ পত্র আগামী কাল দেবো, আমি বি,এ পাশ। হাইস্কুলে মাষ্টারী করতে চাই। সামনের ব্যক্তি বললো- আপনি কাগজ পত্র ও চৌদ্দ লাখ টাকা নিয়ে আসবেন। হাতে হাতে চাকুরী দেওয়া হচ্ছে এখন ওয়েটিং লিস্ট থেকে। দেরী করলে হবে না। পচা বললো আমাকে দুদিন সময় দিন। পচা বাড়ি এসে ভোম্বলের কাছে আব্দার করলো চৌদ্দ লাখ টাকার। ভোম্বল বললো এতো টাকা কি করবি? তোর জমি জমা বিক্রি করে হয়তো টাকা জুটবে কিন্তু খাবি কি? পচা ও বাবাকে সঙ্গে এনেছে। পচার বাবা রাখহরি বললো, ভোম্বল জমি বন্ধকী দিয়ে চৌদ্দ লাখ টাকা দাও। ভোম্বল বললো, তোমার জমি বিক্রি করলেও ওই টাকা আসবে না। তবে আমি টাকা দিতে রাজি আছি, আগে রেজেষ্ট্রি পরে টাকা।পচা রাজী হয়ে বললো আজকেই জমি রেজিস্ট্রি করে টাকা নেবো। সেই মতো পচা রেজেষ্ট্রী করে পাওয়া টাকা নিয়ে অফিসে গিয়ে হাতে হাতে চাকুরীর নিয়োগপত্র নিয়ে পরের দিন শহরের উপকণ্ঠে একটি নতুন হাইস্কুলে যোগদান করে বাড়ি ফিরে এলো। ভোম্বল চেয়ারে ব’সে আছে দেখে পচা পাশ কাটিয়ে যেতেই ডাক পড়লো – এই পচা শোন? কোথায় গেছিলি? পচা বললো মেয়ে দেখতে? ভোম্বল বললো তোকে মেয়ে কে দেবে? তোর বিয়ে করার যোগ্যতায় নাই?
পচা বললো বিয়ের যোগ্যতা বি,এ পাশ করে করেছি।
ভোম্বল – তোর সঙ্গে বিয়ে যে দেবে সে মস্ত বোকা গাধা? টাকা থাকলে টাটকা চাকুরী ওয়ালা ছেলে পাবে! তোর মতো পচা ছেলে কেন নেবে? তা কোথায় বিয়ে করছিস? পচা – বিয়ে হলেই জানতে পারবে? আমি পাঁচ কান করতে পারবো না? তুমি তো আমাকে পচা বললে? তোমার উত্তর আমি ঠিক দেবো। পচার স্কুলে চাকুরী দেখে ওই এলাকার লোকজন পচার কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে। পচা বললো সর্বোচ্চ যিনি দেবেন তার মেয়েকে বিয়ে করবো। পচার সর্বোচ্চ দক্ষিনায় স্কুলের কাছেই বিয়ে হ’য়ে গেলো ধূমধাম ছাড়াই। পচা বলেছিলো অপচয় করতে নেই। টাকার সদ্ব্যবহার করতে হয়। তাই পচা ওই যৌতুকের টাকায় বিশাল বাড়ি ও জমি জমা কিনলো। বেচা জমির চেয়ে পচা অনেক জমি কিনলো। যেহেতু স্কুলের পাশেই বিয়ে হয়েছে তাই মাষ্টারের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলতো না। ছাত্রদের নামতা ধারাপাত ও বর্ণপরিচয় শেখাতো। ছেলেমেয়েরা বলতো এতো অতীতের হাতে খড়ি? পচা বলতো, অতীত ভুললে চলবে না, বর্তমান তো দেখতে পাচ্ছো,আর ভবিষ্যতে কি হবে সেটা ঈশ্বরের হাত। ছেলেমেয়েরা হাসাহাসি করতো ওকে নিয়ে। সবাই বুঝে গেছিলো মোল্লার দৌড় মসজিদ! তাই পচার ক্লাসটা বাঁয়ে জমা রাখতো ছেলেমেয়েরা। পচার সন্তান হয়েছে, চাকুরী সাত আট বছর হয়েছে, এবার আদালতের রায়ে চাকুরীহারা। ভোম্বল পচাকে বাড়িতে দেখে বললো, বাড়ীতে কেন? কাজে যাবি না? পচা বললো কাজ আর ভালো লাগছে না,তাই ছেড়ে দিলাম। এবার সংসারে মন দিতে হবে। গ্রামে রটে গেলো – গাঁ নষ্ট করে কানা, পুকুর নষ্ট করে পানা,আর পচা নামের বৈশিষ্ট্য সবকে পচানো ! তাই গোটা চাকুরী পচা বলে আখ্যায়িত হলো!!!