০৭:০২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ফারুক প্রধান

জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে ভালোবাসার কাছে প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের সংযত রেখেছে।

  • প্রকাশিত ১০:১১:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫
  • ৭ বার দেখা হয়েছে

গল্পের ঝুড়িতে পাত্র পাত্রীরা যেন পসরা সাজিয়ে বসে আছে। লেখক প্রদীপ গুপ্ত এক গুচ্ছ গল্প একটি ঝুড়িতে বসে পাঠকে শোনাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি দুই বাংলার সমাদৃত লেখক। কখনো কখনো বাংলাদেশের কথা তাঁর গল্পে উঠে এসেছে। আবার কলকাতা শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়ানোর যে অভিজ্ঞতা বিনি সুতার মালায় গেঁথেছেন।

তাঁর প্রথম গল্প “রসকলি” নদের মাজদিয়ায় এসে যেখানে পদ্মা ওর গুমোর ভেঙেছে। একদিকে নাচতে নাচতে এগিয়ে গেছে ইছামতী আর অন্যদিকে চূর্ণী, সেই চূর্ণীর পথচলার বাঁকে, কি জানি কবে, ঘর বেঁধেছিল কিছু বোষ্টোম বোষ্টমী। হাতের ছোট্ট খঞ্জনির আর শ্রীখোল বা মৃদঙ্গের বোলে সন্ধ্যে হতেই ডিবে লম্ফের কাঁপতে থাকা আলোয় জমে উঠতো কীর্তনগানের আসর। এখন সে পাড়ায় সূর্য ওঠে পুন্নি মে বাউলনির রসকলি আঁকার সাথে, ছিকণ্ঠ বাউলের প্রভাতী সাধনাকে সঙ্গী করে।
সদ্য হেমন্তের মসলিন ওড়নার মতো কুয়াশারা তখনও গাছের মাথা আর পাকা ধানের ক্ষেত ছেড়ে উধাও হওয়ার জন্য ডানা মেলেনি। সেই কুয়াশার ওড়নার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছিকণ্ঠের খমকের সুর।প্রভাতী সূর্যের মতোই যেন খমক বাজিয়ে আর বাঁপায়ে বাঁধা ঘুঙুরের তালে আড় ভাঙ্গছে ছিকণ্ঠ বাউল। দু’চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খমকের তারে মনকে নিমগ্ন রাখে ছিকণ্ঠ।

তারপর কোথা থেকে কি যে হলো, সবার দোর গেল বন্ধ হয়ে। বাউলদের জীবন চলে যে মাধুকরীতে সেই মাধুকরী বৃত্তিতেও পড়লো টান। তাদের ঘরে তো আর গেরস্তবাড়ির মতো চাল ডাল আটা জমানো থাকেনা। মা তবুও বেড়োতেন। কপালে রসকলি এঁকে কাঁধে হলুদ রঙে ছোপানো কাপড়কে গিঁট মেরে ঝুলিয়ে গেরস্ত বাড়ির দোরে গিয়ে দাঁড়াতেন। “জয় রাধে গো ঠাকুরণ, তোমার দোরে এয়েচি গো,ছিরাদা বোষ্টমী।” -একন এ’কদিন এসো না গো বোষ্টমী। এ অসুখ আগে বিদেয় নিক, তাপ্পর না হয় এসো।”
অসুখটা প্রথমে ধরলো রসময়কেই। জ্বর, সাথে গলা ব্যথা, স্বাদ গন্ধ সবকিছু যেন হাওয়ায় মিশে গেল। ঘর থেকে ধরে যে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবে এমন মুনিষ্যি কেউ এগিয়ে এলো না। মরে যাওয়ার পর মিউনিসিপালিটির ধাঙড়রা এসে, কাপড়ে মুড়ে নে গেল রসময়ের শরীরটা। এর ভিতরে ছি’রাধার শরীরেও বাসা বেঁধেছে ব্যাধি।
এখনও ছিকণ্ঠ যখন সে স্মৃতিগুলোকে নামিয়ে আনে মনের কুলুঙ্গির ওপারের তাকের থেকে ঠিক তখনই রসকলি আঁকা শেষ হয় পুন্নিমের।
রসকলি গল্পের জীবন কাহিনি বোষ্টমীদের নিয়ে এক অসামান্য ছবি পাঠকের সামনে ভাসতে থাকে। গল্পের শুরুটা যেমন বোষ্টমীদের এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে তেমনি লেখকের প্রত্যেকটা গল্পে মানুষের জীবন সংগ্রাম নিহিত থাকে।

পরের গল্পে পা রাখতেই লেখক নতুন নতুন কাহিনির উদ্রেক করেন।
“প্রেম উপাখ্যান” গল্পের প্রেম কাহিনি ধোঁয়া ধোঁয়া ছোঁয়া যায় না যেটা সেটা বাস্তব কি করে হয়।
একেবারেই কি ছোঁয়া যায় না অনু।
মানে? মানে তুমি যখন আমায় আদর কর, সেটার ভেতর কি এতোটুকুও ভালোবাসার বোধ কাজ করে না?
অতনু একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। আজ বেশ সুন্দর একটা হাওয়া আছে। হালকা, মিষ্টি।
না, আমি বুঝতে চাইছি, যে ভালোবাসার সাথে শরীরের যোগ কতোটুকু আর মনের-
কিন্তু মন মানেই কি অলীক? ইন ফ্যাক্ট মনের কি কোনো রিয়ালিস্টিক পয়েণ্ট অব-
-আমার মনে হয় নেই। এই যে দেখ, আমরা দুজন বসে আছি, সামনে বেঁধে রাখা নৌকাগুলো ঢেউয়ের দোলায় দুলছে, আকাশ জুড়ে মেঘেরা যেন, কবির কথায় গাভীর মত চলছে, এই মিষ্টি হাওয়া -আমাদের মনে রঙ, এতোটুকুও ছোঁয়াও যেন কাঙ্খিত, কতোটা রোমাণ্টিক, হঠাৎ যদি আবিস্কৃত হয়, আমাদের দুজনের কারো একজনের অন্য একজন এমন বন্ধু আছে, যার সাথে কিনা আমার অথবা তোমার শারীরিক সম্পর্ক আছে, তাহলে-
-মানে? তাহলে বোঝা যাবে আমরা কেউ কাউকে চিনিনি এতোদিনেও। অথবা আমরা কেউ সত্যি সত্যি অন্যকে ভালোবাসি। অথচ – আচ্ছা, আমরা কি সত্যিই ভালোবাসা যাকে বলে সেরকমটা বেসে উঠতে পারি?
– পারিনা?
– আমার তো মনে হয় পারিনা। সংজ্ঞায় পারি কিন্তু বাস্তবে বোধহয় পারিনা।
মন ছাড়া কি ভালোবাসার কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে? শরীরতো কেবলই বোঝা। প্রেমের সাথে তার সম্পর্ক কোথায়? আমরা ভাবি শরীরকে আদর করছি। আসলে সে পুষ্পাঞ্জলি গিয়ে ঠাঁই নেয় মনের মন্দিরে। আমার ভুল হয়েছে তনু। আমায় তুমি—-
লেখক তার গল্পে প্রেমকে পবিত্র রেখেছেন। বাস্তবে কখনো শরীর স্পর্শ না করে প্রেম হয়নি একথা কেউ মানতে চায় না।

“পুরোহিত ও প্রেম” গল্পের যে কাহিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন লেখক তা কিছুটা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। মধ্যরাতে অন্ধকারের বুক চিরে চিৎকার করে উঠলেন পুরোহিত–জয় মা”। মাথার উপর রামদা তুলে নিয়ে একজন ক্ষীণকায় মানুষ চকিতে নামিয়ে আনলেন তার দুটো হাত। একটা অবলা প্রাণীর আর্তচিৎকারে বাতাস মথিত হলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে গেল যিনি হাঁড়িকাঠে পাঠার পেছনের পাদু’টো টেনে ধরে রেখেছিলেন তার হাঁ করা মুখের দিকে। সৌমির সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়মের শরীরটাকে খামছে ধরলো।

লেখকের ধারণা ” জীবিত ও মৃত” গল্পের মধ্যে মানুষের কোন দাম নেই। মানুষ বেঁচে থাকে অবলম্বন করে। জীবনের দায়টুকু আমি তুমি বা সে বয়ে নিয়ে বেড়াই। তাহলে আমাদের জীবনের, মানে বেঁচে থাকার আর কোন দাম থাকলো না।
সুদেষ্ণার মুখে কথাটা শুনে থতমত খেলো দিব্যেন্দু।
মানে? মানেটা তো এমনকিছু না বোঝার নয়। শেষ এল আই সি সার্টিফিকেটটাকেও তো আজ ভেঙে ফেলতে হবে। এসব সার্টিফিক করে রাখার মানেই তো অসময়ে।
তাই? ও হবে হয়তো। আমি তো জানতাম এসব ফোর্সফুল সেভিংস মানুষ না ভাঙ্গার জন্যই করে।
-দেখ তোমাকে আগেও বলেছি ফের আবারও বলছি, লাইফ ইনসিওরেন্স করার কোন মানে নেই। মানুষ যদি বেঁচে থাকতেই —-
-অ, তা আমাদের এই সার্টিফিকেটটা ছাড়া আর সঞ্চয়ে যেন কী কী আছে? কত লক্ষ টাকার ফিক্সড, রেকারিং আর সেভিংস একাউন্টে আরও কত যেন?

ডালহৌসিতে ইনশিওরেন্স কোম্পানি থেকে শেষ সার্টিফিকেটটা ভাঙ্গিয়ে টাকাটাকে নিজের ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করে ইনশিওরেন্সের অফিস থেকে রাস্তায় পা রাখে দিব্যেন্দু। আজ কেন যেন ওর মনটাতে একতিল পরিমানেও আনন্দ নেই।

রাসবিহারী মোড় থেকে হাঁটছে সে। মনের ভেতর ঘুরোফিরে সুদেষ্ণার সেই কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
-তাহলে আমাদের জীবনের, মানে বেঁচে থাকার আর কোনো মানে রইলো না।

বাঙ্গুর হাসপাতালের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো দিব্যেন্দু। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৃতদেহ বইবার গাড়ি। গাড়িগুলো দেখে কী যেন হয়ে গেল ওর। একটু পিছিয়ে এসে দুটো ফুলের রিং, একটা সাদা কাপড়, একটা ধূপকাঠির প্যাকেট কিনে সোজা খুলে ফেললো একটা গাড়ির পেছনকার দরজা। ধূপকাঠি জ্বেলে পায়ের কাছে গুঁজে শুয়ে পড়লো টিনের স্ট্রেচারে। শুয়ে গায়ের ওপর সাদা কাপড়টা টেনে দিয়ে রিংদুটোকে পেটের কাছে সাজিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো সোজা।
ঘুম আসছে দিব্যেন্দুর। দুচোখ বন্ধ করে আপাত মৃত দিব্যেন্দু শুয়ে আছে।
এখন আর৷ পৃথিবীতে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভালোবাসা নেই। একবারই শুধু জ্ঞান ফিরেছিল। সেটুকু সময় খুব করে মনে করার চেষ্টা করেছিল যে সুদেষ্ণা কি আদৌ সেভিংস একাউন্টের একজন জয়েণ্ট সিগনেটারি অথরিটি?

লেখক প্রদীপ গুপ্ত “কুড়ি কিসিমে’র ঝুড়ি” গল্পের বইয়ে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন বটে কিন্তু জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে কিছু কিছু চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আবার কিছু গল্পের মধ্যে প্রেম জাতীয় পদার্থ একেবারে নিরেট মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের আত্নসন্মান বোধটুকু রক্ষা করে চলেছেন মনে হয়। সাদা মাটা ইমেজকে ধরে রাখতে গিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়াও মিলেছ। বইটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা বই মেলা ২০২৪, প্রসর প্রকাশনী, প্রচ্ছদ করেছেন পামেলা পাখি বসু।

Tag :
জনপ্রিয়

জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে ভালোবাসার কাছে প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের সংযত রেখেছে।

ফারুক প্রধান

জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে ভালোবাসার কাছে প্রেমিক প্রেমিকারা নিজেদের সংযত রেখেছে।

প্রকাশিত ১০:১১:০৯ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ২০ মে ২০২৫

গল্পের ঝুড়িতে পাত্র পাত্রীরা যেন পসরা সাজিয়ে বসে আছে। লেখক প্রদীপ গুপ্ত এক গুচ্ছ গল্প একটি ঝুড়িতে বসে পাঠকে শোনাবার চেষ্টা করেছেন। তিনি দুই বাংলার সমাদৃত লেখক। কখনো কখনো বাংলাদেশের কথা তাঁর গল্পে উঠে এসেছে। আবার কলকাতা শহরের অলি গলি ঘুরে বেড়ানোর যে অভিজ্ঞতা বিনি সুতার মালায় গেঁথেছেন।

তাঁর প্রথম গল্প “রসকলি” নদের মাজদিয়ায় এসে যেখানে পদ্মা ওর গুমোর ভেঙেছে। একদিকে নাচতে নাচতে এগিয়ে গেছে ইছামতী আর অন্যদিকে চূর্ণী, সেই চূর্ণীর পথচলার বাঁকে, কি জানি কবে, ঘর বেঁধেছিল কিছু বোষ্টোম বোষ্টমী। হাতের ছোট্ট খঞ্জনির আর শ্রীখোল বা মৃদঙ্গের বোলে সন্ধ্যে হতেই ডিবে লম্ফের কাঁপতে থাকা আলোয় জমে উঠতো কীর্তনগানের আসর। এখন সে পাড়ায় সূর্য ওঠে পুন্নি মে বাউলনির রসকলি আঁকার সাথে, ছিকণ্ঠ বাউলের প্রভাতী সাধনাকে সঙ্গী করে।
সদ্য হেমন্তের মসলিন ওড়নার মতো কুয়াশারা তখনও গাছের মাথা আর পাকা ধানের ক্ষেত ছেড়ে উধাও হওয়ার জন্য ডানা মেলেনি। সেই কুয়াশার ওড়নার বুকে ভেসে বেড়াচ্ছে ছিকণ্ঠের খমকের সুর।প্রভাতী সূর্যের মতোই যেন খমক বাজিয়ে আর বাঁপায়ে বাঁধা ঘুঙুরের তালে আড় ভাঙ্গছে ছিকণ্ঠ বাউল। দু’চোখ বন্ধ করে বেশ কিছুক্ষণ ধরে খমকের তারে মনকে নিমগ্ন রাখে ছিকণ্ঠ।

তারপর কোথা থেকে কি যে হলো, সবার দোর গেল বন্ধ হয়ে। বাউলদের জীবন চলে যে মাধুকরীতে সেই মাধুকরী বৃত্তিতেও পড়লো টান। তাদের ঘরে তো আর গেরস্তবাড়ির মতো চাল ডাল আটা জমানো থাকেনা। মা তবুও বেড়োতেন। কপালে রসকলি এঁকে কাঁধে হলুদ রঙে ছোপানো কাপড়কে গিঁট মেরে ঝুলিয়ে গেরস্ত বাড়ির দোরে গিয়ে দাঁড়াতেন। “জয় রাধে গো ঠাকুরণ, তোমার দোরে এয়েচি গো,ছিরাদা বোষ্টমী।” -একন এ’কদিন এসো না গো বোষ্টমী। এ অসুখ আগে বিদেয় নিক, তাপ্পর না হয় এসো।”
অসুখটা প্রথমে ধরলো রসময়কেই। জ্বর, সাথে গলা ব্যথা, স্বাদ গন্ধ সবকিছু যেন হাওয়ায় মিশে গেল। ঘর থেকে ধরে যে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাবে এমন মুনিষ্যি কেউ এগিয়ে এলো না। মরে যাওয়ার পর মিউনিসিপালিটির ধাঙড়রা এসে, কাপড়ে মুড়ে নে গেল রসময়ের শরীরটা। এর ভিতরে ছি’রাধার শরীরেও বাসা বেঁধেছে ব্যাধি।
এখনও ছিকণ্ঠ যখন সে স্মৃতিগুলোকে নামিয়ে আনে মনের কুলুঙ্গির ওপারের তাকের থেকে ঠিক তখনই রসকলি আঁকা শেষ হয় পুন্নিমের।
রসকলি গল্পের জীবন কাহিনি বোষ্টমীদের নিয়ে এক অসামান্য ছবি পাঠকের সামনে ভাসতে থাকে। গল্পের শুরুটা যেমন বোষ্টমীদের এক আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে তেমনি লেখকের প্রত্যেকটা গল্পে মানুষের জীবন সংগ্রাম নিহিত থাকে।

পরের গল্পে পা রাখতেই লেখক নতুন নতুন কাহিনির উদ্রেক করেন।
“প্রেম উপাখ্যান” গল্পের প্রেম কাহিনি ধোঁয়া ধোঁয়া ছোঁয়া যায় না যেটা সেটা বাস্তব কি করে হয়।
একেবারেই কি ছোঁয়া যায় না অনু।
মানে? মানে তুমি যখন আমায় আদর কর, সেটার ভেতর কি এতোটুকুও ভালোবাসার বোধ কাজ করে না?
অতনু একটুক্ষণ চুপ করে থাকে। আজ বেশ সুন্দর একটা হাওয়া আছে। হালকা, মিষ্টি।
না, আমি বুঝতে চাইছি, যে ভালোবাসার সাথে শরীরের যোগ কতোটুকু আর মনের-
কিন্তু মন মানেই কি অলীক? ইন ফ্যাক্ট মনের কি কোনো রিয়ালিস্টিক পয়েণ্ট অব-
-আমার মনে হয় নেই। এই যে দেখ, আমরা দুজন বসে আছি, সামনে বেঁধে রাখা নৌকাগুলো ঢেউয়ের দোলায় দুলছে, আকাশ জুড়ে মেঘেরা যেন, কবির কথায় গাভীর মত চলছে, এই মিষ্টি হাওয়া -আমাদের মনে রঙ, এতোটুকুও ছোঁয়াও যেন কাঙ্খিত, কতোটা রোমাণ্টিক, হঠাৎ যদি আবিস্কৃত হয়, আমাদের দুজনের কারো একজনের অন্য একজন এমন বন্ধু আছে, যার সাথে কিনা আমার অথবা তোমার শারীরিক সম্পর্ক আছে, তাহলে-
-মানে? তাহলে বোঝা যাবে আমরা কেউ কাউকে চিনিনি এতোদিনেও। অথবা আমরা কেউ সত্যি সত্যি অন্যকে ভালোবাসি। অথচ – আচ্ছা, আমরা কি সত্যিই ভালোবাসা যাকে বলে সেরকমটা বেসে উঠতে পারি?
– পারিনা?
– আমার তো মনে হয় পারিনা। সংজ্ঞায় পারি কিন্তু বাস্তবে বোধহয় পারিনা।
মন ছাড়া কি ভালোবাসার কোনো অস্তিত্ব থাকতে পারে? শরীরতো কেবলই বোঝা। প্রেমের সাথে তার সম্পর্ক কোথায়? আমরা ভাবি শরীরকে আদর করছি। আসলে সে পুষ্পাঞ্জলি গিয়ে ঠাঁই নেয় মনের মন্দিরে। আমার ভুল হয়েছে তনু। আমায় তুমি—-
লেখক তার গল্পে প্রেমকে পবিত্র রেখেছেন। বাস্তবে কখনো শরীর স্পর্শ না করে প্রেম হয়নি একথা কেউ মানতে চায় না।

“পুরোহিত ও প্রেম” গল্পের যে কাহিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন লেখক তা কিছুটা আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম। মধ্যরাতে অন্ধকারের বুক চিরে চিৎকার করে উঠলেন পুরোহিত–জয় মা”। মাথার উপর রামদা তুলে নিয়ে একজন ক্ষীণকায় মানুষ চকিতে নামিয়ে আনলেন তার দুটো হাত। একটা অবলা প্রাণীর আর্তচিৎকারে বাতাস মথিত হলো। ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটে গেল যিনি হাঁড়িকাঠে পাঠার পেছনের পাদু’টো টেনে ধরে রেখেছিলেন তার হাঁ করা মুখের দিকে। সৌমির সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়মের শরীরটাকে খামছে ধরলো।

লেখকের ধারণা ” জীবিত ও মৃত” গল্পের মধ্যে মানুষের কোন দাম নেই। মানুষ বেঁচে থাকে অবলম্বন করে। জীবনের দায়টুকু আমি তুমি বা সে বয়ে নিয়ে বেড়াই। তাহলে আমাদের জীবনের, মানে বেঁচে থাকার আর কোন দাম থাকলো না।
সুদেষ্ণার মুখে কথাটা শুনে থতমত খেলো দিব্যেন্দু।
মানে? মানেটা তো এমনকিছু না বোঝার নয়। শেষ এল আই সি সার্টিফিকেটটাকেও তো আজ ভেঙে ফেলতে হবে। এসব সার্টিফিক করে রাখার মানেই তো অসময়ে।
তাই? ও হবে হয়তো। আমি তো জানতাম এসব ফোর্সফুল সেভিংস মানুষ না ভাঙ্গার জন্যই করে।
-দেখ তোমাকে আগেও বলেছি ফের আবারও বলছি, লাইফ ইনসিওরেন্স করার কোন মানে নেই। মানুষ যদি বেঁচে থাকতেই —-
-অ, তা আমাদের এই সার্টিফিকেটটা ছাড়া আর সঞ্চয়ে যেন কী কী আছে? কত লক্ষ টাকার ফিক্সড, রেকারিং আর সেভিংস একাউন্টে আরও কত যেন?

ডালহৌসিতে ইনশিওরেন্স কোম্পানি থেকে শেষ সার্টিফিকেটটা ভাঙ্গিয়ে টাকাটাকে নিজের ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করে ইনশিওরেন্সের অফিস থেকে রাস্তায় পা রাখে দিব্যেন্দু। আজ কেন যেন ওর মনটাতে একতিল পরিমানেও আনন্দ নেই।

রাসবিহারী মোড় থেকে হাঁটছে সে। মনের ভেতর ঘুরোফিরে সুদেষ্ণার সেই কথাটাই ঘুরপাক খাচ্ছে।
-তাহলে আমাদের জীবনের, মানে বেঁচে থাকার আর কোনো মানে রইলো না।

বাঙ্গুর হাসপাতালের সামনে এসে থমকে দাঁড়ালো দিব্যেন্দু। লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে মৃতদেহ বইবার গাড়ি। গাড়িগুলো দেখে কী যেন হয়ে গেল ওর। একটু পিছিয়ে এসে দুটো ফুলের রিং, একটা সাদা কাপড়, একটা ধূপকাঠির প্যাকেট কিনে সোজা খুলে ফেললো একটা গাড়ির পেছনকার দরজা। ধূপকাঠি জ্বেলে পায়ের কাছে গুঁজে শুয়ে পড়লো টিনের স্ট্রেচারে। শুয়ে গায়ের ওপর সাদা কাপড়টা টেনে দিয়ে রিংদুটোকে পেটের কাছে সাজিয়ে রেখে শুয়ে পড়লো সোজা।
ঘুম আসছে দিব্যেন্দুর। দুচোখ বন্ধ করে আপাত মৃত দিব্যেন্দু শুয়ে আছে।
এখন আর৷ পৃথিবীতে কোনো শব্দ নেই, কোনো ভালোবাসা নেই। একবারই শুধু জ্ঞান ফিরেছিল। সেটুকু সময় খুব করে মনে করার চেষ্টা করেছিল যে সুদেষ্ণা কি আদৌ সেভিংস একাউন্টের একজন জয়েণ্ট সিগনেটারি অথরিটি?

লেখক প্রদীপ গুপ্ত “কুড়ি কিসিমে’র ঝুড়ি” গল্পের বইয়ে বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি তুলে ধরবার চেষ্টা করেছেন বটে কিন্তু জীবনের হিসেব মিলাতে গিয়ে কিছু কিছু চরিত্র জীবন্ত হয়ে উঠেছে। আবার কিছু গল্পের মধ্যে প্রেম জাতীয় পদার্থ একেবারে নিরেট মধ্যবিত্ত সমাজের মানুষের আত্নসন্মান বোধটুকু রক্ষা করে চলেছেন মনে হয়। সাদা মাটা ইমেজকে ধরে রাখতে গিয়ে আধুনিকতার ছোঁয়াও মিলেছ। বইটি প্রকাশিত হয়েছে কলকাতা বই মেলা ২০২৪, প্রসর প্রকাশনী, প্রচ্ছদ করেছেন পামেলা পাখি বসু।