উম্মে কুলসুম ঝুমু
“বাংলার রুপের অপার মহিমায় ছুটে যাই সবুজের ঘ্রানে,
যেদিকে তাকাই আনন্দ হিল্লোল বয়ে আনে আনন্দ প্রানে।
এ আমার দেশ, দেশের মাটি ভালোবাসা দিয়ে তারে কেনা,
যতদূর চোখ যায় ততদূর আপন ততটাই খুব চেনা।”
সৃষ্টিকর্তার অপরূপ শিল্পের সেরা প্রদর্শনী আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে সূচনা এই সবুজের গালিচায় আঁকা বাংলাদেশ যার সমাপ্তি হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। শ্যামল সবুজ বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশ বিদেশের ভ্রমন প্রিয় মানুষের কাছে অনেক প্রিয় গন্তব্য।
আমরা গর্বিত যে এবং ধন্য যে আমাদের আছে পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত, বৃহত্তমন ম্যানগ্রোভ বন, বিস্তীর্ণ সবুজ দিগন্ত, পাহাড় – নদী – ঝর্ণা এবং চা বাগান। বাংলাদেশে রয়েছে একমাত্র পাহাড়ঘেরা দ্বীপ মহেশখালিসহ আর ও অনেক আকর্ষনীয় পর্যটন স্পট।
দেশের আনাচে কানাচে প্রাচীন পুরাকৃতি ও ঐতিহ্য বাহী স্থাপনা ।এইসবের সমন্বয়ে আমাদের এই সোনার বাংলাদেশে পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ইতিহাসের প্রসিদ্ধ স্থাপনা ও হাজার বছরের ইতিহাসের বাহক পুরাকৃর্তি দেশি বিদেশী পর্যটকদের বিষ্মিত ও বিহোমিত করে।
তাই তো কবি লিখেছেন -এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে
না কো তুমি ,সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি ।
প্রতিবছর লক্ষাধিক মানুষ দেশের পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে ভ্রমণ করেন। এই সকল পর্যটকদের বেশিরভাগ মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সচ্ছলতা কারণে মানুষের মাঝে ভ্রমণ প্রবণতা বেড়েই যাচ্ছে। যা আমাদের অর্থনীতিকে আরও সচল করছে। তাছাড়া ইদানীং বয়স্ক যেমন ৬০ বছরের পর্যটকরা বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গাগুলো পরিদর্শন করছে। এটা আশার আলো জাগিয়ে তুলছে।একটা বয়সের পর মানুষ একা হয়ে পরে নিঃসঙ্গ হয়ে পরে। এই একাকীত্ব এবং কর্মহীনতা মানুষ কে মানসিকভাবে অসুস্থ করে দেয়ে সেখান থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
ভ্রমনবিলাসীদের শখের কারনে বাড়ছে বিভিন্ন ব্যাবসায়িক খাত- পর্যটন শিল্পের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে পরিবহন, আবাসন, হোটেল, রেস্তোরা, পোশাক ও হাতে তৈরি বিভিন্ন শখের জিনিসের শিল্প।এছাড়া বাড়ছে ট্যুরিজম গ্রুপ।ছোট ছোট গ্রুপ করে এরা ভ্রমন পিপাসুদের নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে।এই কাজে মেয়েরাও এগিয়ে আসছে।তারা মেয়েদের আলাদা গ্রুপ করে বিভিন্ন ট্যুরের আয়োজন করছে যার ফলে বেকারত্ব কমে যাওয়ার এবং স্বাবলম্বী হওয়ার অপার সম্ভাবনা আছে ।
পর্যটন হলো এক ধরনের বিনোদন। অবসর যাপন অথবা ব্যবসায়ের উদ্দেশ্যে এক স্থান থেকে অন্য স্থান কিংবা এক দেশ থেকে অন্য দেশে পর্যটক রা ভ্রমণ করে।আর ভ্রমণের সময় প্রয়োজন হয় পরিবহন ব্যবস্থার, থাকার জন্য আবাসন, খাবার জন্য রেস্তোরা, কেনাকাটার জন্য দোকান ।মানুষ দেশ বিদেশ দেখার তাড়নায় ছুটে চলেছেন মাইলের পর মাইল, পাড়ি দিয়েছেন অতল সমুদ্র। তাদেরই একজন কলম্বাস আবিষ্কার করেন আমেরিকা।
আমাদের বাংলা প্রাচীন কাল থেকেই তার সৌন্দর্য ও শিল্পের জন্য বিশ্বে পরিচিত ছিল। তাইতো বাংলার রূপের টানে মধ্যযুগে ইবনে বতুতা, হিউয়েন সাং এর মত বিখ্যাত পরিব্রাজক গন এ দেশে পর্যটনে এসেছিলেন।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর ষড়ঋতুর এই বাংলাদেশ নানা সময়ে নানান রূপের দেখা মিলে। যা দেশি বিদেশী ভ্রমণপ্রিয় মানুষদের আকর্ষিত করে।
পর্যটকদের প্রকৃতির মায়ার জালে অবোধ করতে বাংলার ভূমিজুড়ে রয়েছে শতশত রূপের ফাঁদ। সমুদ্রের বুকে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার জন্য কুয়াকাটা, সমুদ্রের বিশালতায় হারিয়ে যেতে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সমুদ্রসৈকত কক্সবাজার, সিলেটের পাহাড়ের ভাগে সবুজ চায়ের বাগান কিংবা জলাবন রাতারগুল, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জুলন্ত ব্রিজ, কাপ্তান হ্রদ, সাজেক ভ্যালি, সীতাকুণ্ডের পাহাড় এবং মধুপুরের চিরহরিৎ বন।
তাছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন ঝর্ণার সৌন্দর্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়।সুন্দরবনের অনাবিল সবুজ প্রবল দ্বীপ সেনমার্টিন ,কাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার ও সমুদ্রতীরে ঝাউবনে তাঁবুবাস পর্যটকের রোমাঞ্চিত ও ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে বাড়িয়ে তুলে।
বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পর্যটন কেন্দ্রগুলি মধ্যে অন্যতম ঢাকার লাগবাগ দুর্গ, কুমিল্লার ময়নামতি, পাহাড়পুর বিহার, সোনারগাঁয়ের পানাম নগর, মহাস্থান গড়, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, কেন্দ্রীয় শহীদমিন, জাতীয় জাদুঘর, মেহেরপুর, পুঠিয়া রাজবাড়ী ভ্রমন পিয়াসীদের আনাগোনায় সারাবছর মুখরিত থাকে।
বর্তমানে ইন্টারনেটের কল্যাণে মুহূর্তে যে কোন পর্যটন কেন্দ্রের ছবি পৃথিবী ব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে, এবং উন্নত যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে, ভ্রমণপ্রিয় মানুষ জন ছুটে চলছেন দেশ বিদেশের নানা প্রান্তে। তাদের সাথে ছুটে চলছে সেসব দেশের অর্থনীতির চাকা।
পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর সবুজ শ্যামলা বাংলাদেশ ভ্রমণের জন্য দেশি বিদেশী ভ্রমণ প্রিয় মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয় গন্তব্য।
বিশ্বব্যাপী পর্যটন শিল্প দ্রুত বিকশিত হচ্ছে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি যে, পর্যটনে অপার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমরা তার সামান্যতম সুবিধা ভোগ করতে পারছি। পর্যটন শিল্পের বিকাশের জন্য সর্বপ্রথম আমাদের
দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করতে হবে। কারণ, ভ্রমণে বেশিরভাগ সময় রাস্তায় জ্যাম জটে কাটালে পর্যটকরা পরবর্তীতে ভ্রমণে নিরুৎসাহিত হন। এছাড়াও দেশের অনেক দুর্গম ও দূরবর্তী অঞ্চলে অনেক সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে। ভালো যাতায়াত ব্যাবস্থা না থাকায় পর্যটকেরা বঞ্চিত হন বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্য থেকে।
তাছাড়া ঝুঁকিপূর্ণ জায়গা গুলোতে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। যেখানে হোটেল মোটেল নেই সেখানে সরকারি বেসরকারি উদ্যোগে করতে হবে। ভ্রমনকালীন সময় পর্যটকরা যেন সুবিধাভোগী মানুষের পাল্লায় অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত না হন সেই বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে।
এই সুন্দর দেশকে সুন্দর রাখা আমাদের দায়িত্ব, সরকারের পাশাপাশি নাগরিক হিসেবে আমারও দেশের পর্যটন শিল্পের বিকাশে কাজ করতে পারি। আমরা যখন কোন পর্যটন কেন্দ্রে ঘুরতে যাব তখন যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে পরিবেশ ও সৌন্দর্য নষ্ট করব না। পর্যটক হিসাবে ঘুরতে গেলে স্থানীয় মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হতে হবে আর আমাদের এলাকায় পর্যটক এলে তাদের অতিথির মত খেয়াল রাখতে হবে। তাহলে আমাদের সোনার বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প আরও সমৃদ্ধ হবে এবং এদেশের সুনাম সমুন্নত থাকবে ।
তাছাড়া বাংলার রুপ সৌন্দর্য ব্যখ্যা করতে গিয়ে বিখ্যাত কবি, জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন,
বাংলার মুখ দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর!
আমার দেশে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে আমাদের সুন্দরবন।রাতারগুলে নৌকাভ্রমণের রোমাঞ্চএর টানে প্রতিবছর এখানে প্রচুর দেশি-বিদেশী পর্যটক আসেন।
চায়ের দেশ সিলেট অপুরূপ সৌন্দর্যের লীলাভূমি ।তাছাড়া সিলেটের বিছাকান্দি,জাফলং,এবং ভোলাগন্জের সাদা পাথর।সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার তো অপার সৌন্দর্যে মুগ্ধ করে পর্যটকদের। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত তার সাদা বালি, নীল জল এবং সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য জনপ্রিয়। কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে প্রতি বছর হাজার হাজার দেশি বিদেশী পর্যটক ভ্রমনে আসেন। এছাড়াও পর্যটকেরা চট্রগ্রামের পতেজ্ঞা, কক্সবাজারের ইনানী, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, সুন্দরবনের কটকা সমুদ্রসৈকতে ভ্রমণে যান। প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন আজ মনোরম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন স্থানে পরিণত হয়েছে।
রাঙামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি বাংলাদেশের তিন পার্বত্য জেলা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি। পযটকেরা পাহাড়ের চূড়ায় মেঘের ছোয়ার আনন্দ ও প্রাকৃতিক ঝর্ণাধারার কলতানে বিষ্মিত ও বিহমিত হন। রাঙামাটির কাপ্তাই লেকে নৌকা ভ্রমণ, ঝুলন্ত সেতু, নিবিড় পাহাড়ের বোনরাজির মায়া ও পাহাড়ি জনজাতির সরল আদিম জীবন পর্যটকদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতাকে পরিপূর্ণ করে।
এছাড়াও প্রাচীন কালের দিনাজপুরের কান্তজীর মন্দির, পুরান ঢাকার লালবাগের কেল্লা, বুড়িগংগার তীরবর্তী আহসান মঞ্জিল, সোনারগাঁয়ের পানাম নগর, বাগেরহাটের ষাটগম্বুয মসজিদ এগুলি দেশের অন্যতম প্রাচীর পুরাকৃতিক নির্র্দশন এবং প্রাণপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।
বাংলাদেশের ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে আরেক শ্রেণীর স্থাপত্য যেগুলো বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বহন করে যুগ যুগ ধরে ।ফলকে ফলকে লেখা আমাদের মহান সংগ্রামের ইতিহাস। এদের মধ্যে অন্যতম হলো ঢাকা মেডিকেল প্রঙ্গনে ৫২’র ভাষা আন্দোলনের শহীদের উদ্দেশ্য নির্মিত কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্দ্বে লাখো শহীদের স্মৃতির স্মরণে সাভারে নির্মিত স্মৃতিসৌধ। আবার ঢাকার শাহবাগে আছে জাতীয় যাদুঘর মিরপুরে মহান মুক্তিযুদ্ধের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানি ও তাদের দোসরদের নিহত বুদ্ধিজীবীদের স্মরণে বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ, এবং ঢাকার সোয়ার্দী উদ্দানে স্থাপিত স্বাধীনতা জাদুঘর ইতিহাসপ্রেমী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে।
পৃথিবীকে অবাক করে দিয়ে অবকাঠামোগত ভাবেও বাংলাদেশ অনেক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। যেগুলি যোগাযোগের পাশাপাশি পর্যটন গন্তব্যে পরিনিত হয়েছে। এদের মধ্যে অন্যতম পদ্মা সেতু।
সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই কবিতারই বাস্তব প্রতিফলন আমাদের এই মেগা প্রকল্পগুলো।
সাবাস, বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়ঃ জ্বলে পুড়ে-মরে ছারখার তবু মাথা নোয়াবার নয় ।
ঢাকা নগরবাসীর যাতায়তের জন্য আরেক মেগা প্রকল্প মেট্রোরেল চালু হয়েছে। গণপরিবহন হলেও নগরের মানুষের উপর থেকে শহর দেখার নতুন মাত্রা দিয়েছে মেট্রোরেল প্রকল্প। এছাড়াও মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ে, মেরিন ড্রাইভ রোড, রুপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, কর্ণফুলী টানেল এর মতো মেগা প্রকল্পগুলি পর্যটকদের আকর্ষিত করছে।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চিরসবুজ বাংলার রূপের বিশালতা ও ব্যাপকতা, পুরাকীর্তি, ঐতিহাসিক স্থাপনা, সমৃদ্ধ ইতিহাস ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দেশী ও বিদেশী পর্যটকদের আকর্ষণ করার জন্যে যথেষ্ঠ। বাংলাদেশের অতিথি পরায়ণতা, মানবিক সংস্কৃতি, রূপের বর্ণনা, ইতিহাস ঐতিহ্য যেভাবে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে তার সম্মান ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের ।