০৬:৪৭ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫, ২৮ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
নিজস্ব প্রতিবেদক:

কেন এই নৃশংশতা, কেন এই বর্বরতা অধ্যাপক ড. মু. নজরুল ইসলাম তামিজী

  • প্রকাশিত ০৬:৩৭:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫
  • ৭১৬ বার দেখা হয়েছে

যখন বাংলাদেশের রাজপথে প্রতিদিন রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের খবর আসে। এটি কেবল একঘেয়ে ঘটনা নয়, বরং একটি বিভৎস রূপে আমাদের সামনে উঠে আসে, এবং আমরা ক্রমেই এর প্রতি আরো বেশি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ভুলে গেলেও, গরিব শ্রমিক কিংবা সাধারণ মানুষের প্রাণহানি যেন আমাদের সমাজের এক দুর্ভাগ্যজনক নীরব বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় ঘটে যাওয়া এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা আজ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। একটি মানুষকে হত্যা করলেই তো থেমে যায় না; তার পরিণতি, সেই হত্যাকাণ্ডের পরের নৃশংসতা, মানবতার কূলকিনারা না হওয়া প্রতিটি ঘটনা চমকে দেয়।

এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, শুধুমাত্র চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার কিংবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য। একদিকে যখন এসব ঘটনায় সমাজ মেনে নিয়েছে যে প্রতিদিন কত হত্যা ঘটে— ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক বিরোধ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব— তবে কি এমন একটি হত্যাকাণ্ড, যা মানবিকতার প্রতি এক ভয়ংকর আঘাত, কল্পনার বাইরে এক অমানবিক দৃশ্য নয়?

এই হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর এক ভয়াবহ মৃত্যু সবার চোখে পড়ে। পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা, পিটিয়ে, কুপিয়ে, নির্যাতন করে একটি তরতাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। একের পর এক পাথরের আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত করল ঘাতক। এমন অমানবিকতার দৃশ্য কি কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

এ ধরনের নৃশংসতা কীভাবে সমাজে জায়গা পেতে পারে? এ কেমন বীভৎসতা? হত্যাকারীদের এমন অমানবিকতার বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া একান্ত জরুরি। যেভাবে এক মানুষকে দেহের ক্ষতি করল, তার তো মানবাধিকার রক্ষা হওয়া উচিত ছিল। প্রতিবাদ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো পথ থাকবে না।

একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের প্রতি হিংস্রতার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। এটা নিছক হত্যাকাণ্ড নয়, এটি আমাদের বিবেক, মানবতা ও সমাজের জন্য একটি কলঙ্ক।

একটি প্রশ্ন যেন অমিমাংসিত রয়ে গেছে— আমরা কোথায় পৌঁছালাম? কেন এমন এক নির্মম সহিংসতা আমাদের সমাজে প্রতিদিন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে?

‘মিটফোর্ডের গেট
নেই কোনো আগাম সংবাদ
একজন মানুষ—সোহাগ—ভাঙারির মতো পড়ে থাকে
তার হাড় ভাঙা
তার দৃষ্টি স্থবির
তার পাশে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ইতিহাস—
তুমি কি দেখছো? নাকি
গাড়ির হর্নে ঢাকা পড়ে যায় মৃত্যু?

এই শহর জানে কিভাবে ছুরি হাসে
কিভাবে থাপ্পড় ফেটে যায় নিঃশব্দে
আমরা কেউই নির্দোষ না
আমরা দাঁড়িয়ে থাকি গেটের পাশে
আর গুলি খাওয়া খবরের কাগজ বিক্রি করি।’

যতটা আশ্চর্যজনক, ততটাই দুঃখজনক— রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘকাল ধরে চলমান সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে এক একটি হত্যাকাণ্ড সাধারণ ঘটনার মতো হয়ে গেছে। এবং এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সাথে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সংশ্লিষ্ট এই হত্যা, এক ধরনের পারস্পরিক লড়াই এবং শক্তির রাজনীতি প্রকাশ করে। এখানে রাজনৈতিক দলের ভিতরের শক্তির সংকটে এমন নির্মমতা দেখা দিচ্ছে, যা শুধু জাতির ইতিহাসেই নয়, মানুষের মৌলিক নৈতিকতার ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

কবিতার ভাষায়,
ওসি বলেন—
“পুরনো শত্রুতা ছিল…”
তারপর তিনি থামেন না
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে এক শিশু, যার বাবা সোহাগ ছিল
আর সামনে সাংবাদিক, তার হাতে টাস্কিং রিপোর্ট
ভবিষ্যৎ তৈরি হয় ফাইল নোটে
যেখানে জবানবন্দি মানেই পলিথিন মোড়া ব্যথা।

চোখ খুলে দেখো, ঢাকা শহর
তোমার শরীরে প্রতিদিন
৮-১০ জন কুপিয়ে যায় মানবতা।’

চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের চিত্র, যে কোনো সভ্য সমাজের জন্য একটি বড় কলঙ্ক।

কেবল হত্যার মধ্যেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা, সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশের ওপর চলতে থাকে নৃশংসতা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে সোহাগকে হত্যা করা হয়, এরপর তার নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে দেওয়া হয়। এমন একটি ঘটনা যে কোনো মানুষের হৃদয় ও বিবেককে কষ্ট দেয়।

এ ঘটনার পেছনে রয়েছে পুরোনো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক বিরোধ, এবং চাঁদাবাজির প্রেক্ষাপট। সোহাগ এবং তার হত্যাকারীরা সবাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জানা গেছে। হত্যাকারীদের মূল হোতা, মহম্মদ মাহমুদুল হাসান মহিনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং ঘুষের অভিযোগও রয়েছে।

এমন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড পুরান ঢাকার দরজি বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল। কিন্তু বর্তমান হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা আরও বেশি, যেখানে শত শত মানুষের সামনে এক নাগাড়ে পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে, অথচ কেউ এগিয়ে আসেনি।

এটি শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি আমাদের সমাজের সেই স্থিতি এবং নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আজকের সমাজে, যেখানে আমাদের প্রতিবাদ করার সাহস ছিল, সেখানে আমরা এখন নীরব দর্শক। আমাদের কি মানবিকতাহীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুলে যাচ্ছে?

এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে, আমাদের মানসিক বিপর্যস্ততা ও বিভক্তি আরও গভীর হয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের এখন এক প্রশ্নের মুখোমুখি : আমরা কোথায় দাঁড়াচ্ছি?

যে বিষয়টি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো জনতার নিরবতা। ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত থাকা শত শত মানুষ কেউই এগিয়ে আসেনি, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে যায়নি। এটি সমাজে এক ধরনের মানবিক সংকট এবং শৈথিল্য সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, তখন সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীনতার কারণে চুপ হয়ে যায়, বা কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পায় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা বা হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসে এই ঘটনাটি নতুন নয়। আগে যেমন পুরান ঢাকা এলাকায় বিশিষ্ট টেইলরের হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল, ঠিক তেমনি আবার সোহাগ হত্যার ঘটনাও রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন আমরা এমন নৃশংসতার দায় নিতে পারছি না? কেন আমাদের আইন এবং বিচারব্যবস্থা এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে এই ধরনের খুন-খারাপির মধ্যে সাধারণ জনগণ আর প্রশাসন— দু’পক্ষই যেন অনভ্যস্ত?

কবিতার ভাষায়,
‘চকবাজারের মাংস দোকানে
আজ ছুরি বিক্রি বাড়তি
আর সন্দেহভাজন ধরা পড়ে
পুলিশের ব্যাকসেটে
তার চোখে নেই ভয়ের ছায়া
সে জানে, আবারও ছাড়া পাবে

এ শহরের প্রতিটি গলি জানে
কে খুন করল,
কেন করল,
আর কবে আবার করবেই।’

এটি আমাদের বোঝার জন্য সময় এবং উপযুক্ত কর্মপন্থা অন্বেষণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ। প্রথমত, আমাদের প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমে প্রতিশ্রুতি এবং দৃঢ়তা, বিশেষত রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে। দ্বিতীয়ত, এটি সরকার এবং রাজনৈতিক দলের প্রতি বৃহত্তর দায়বদ্ধতা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন। তৃতীয়ত, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রতি নিষ্ঠাবান দায়িত্বজ্ঞানকে ফিরে আনতে হবে।

কবিতার ভাষায়,
‘ভাঙারির দোকান কি শুধুই পুরনো ফ্যান, তারের গোছা,
না কি সেখানে জমে থাকে
মানুষের ভাঙা স্বপ্ন?
সোহাগ ছিল এক নাম
এখন সে হয়ে গেছে রিপোর্ট নম্বর: ৩৫/২০২৫

সে চিৎকার করেনি,
কারণ শহরের শব্দতন্ত্রী তার কণ্ঠনালী চুরি করে নিয়েছে
সে শুধু তাকিয়ে ছিল—
যেভাবে একজন নদী মরুভূমির দিকে তাকায়।’

অতএব, সময় এসেছে আমাদের সমাজের শিকড়ে কিছু বড় পরিবর্তন আনার। যতক্ষণ না আমরা শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা এবং সচেতন নাগরিক গঠন করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত সোহান হত্যা এবং তার মতো আরও অগণিত হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজকে গিলে খাবে। আর আমরা তা না দেখেও দেখতে থাকব।

কবিতার ভাষায়,
‘আমি বলি—এই মৃত্যু রাজনৈতিক না,
না-এটা ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব
এটা এই শহরের
জন্মগত বদনাম
যেখানে বেঁচে থাকাটাই রক্তাক্ত সৌন্দর্য

তুমি যদি এখনও বাঁচো
তবে তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে
সোহাগের আর্তনাদ থাকে
আর আমি, মৃত আমি,
পথের পাশে বসে কবিতা লিখি
একটা লাশের হয়ে।’

একটার পর একটা নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলছে, এবং প্রতিটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ উঠছে, অথচ রাষ্ট্র ও সরকার কী করছে? প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কিন্তু ঘটনার পর প্রশাসনের কোনো কার্যকর উপস্থিতি কোথায়? প্রতিটি ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন কেন ছুটে যাচ্ছে না? থানা-পুলিশ, সরকারী কর্তৃপক্ষ কোথায়?

এক বছর হতে চলেছে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি কেন সবচেয়ে ‘গুরুত্বহীন’ করে ফেলা হলো? নিরাপত্তাহীনতায় জনগণকে ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? শুধু রাজধানীতে বসে হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়ে প্রশাসন চালানো কি আসলেই যথেষ্ট?

অথচ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি দ্রুতগতিতে এগিয়ে না নেওয়ার ফলে, দেশে আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে এবং মানুষের মধ্যে ভীতি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশাসন যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে শুধু বার্তা দিয়ে কিংবা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।

Tag :
জনপ্রিয়

গংগাচড়ায় হত্যাকান্ডকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দিচ্ছে পুলিশ #হত্যাকারীদের সাথে পুলিশ ও ফরেনসিক ডাক্তার আয়শা পারভীনের যোগসাজশ #প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে হত্যাকারীরা

নিজস্ব প্রতিবেদক:

কেন এই নৃশংশতা, কেন এই বর্বরতা অধ্যাপক ড. মু. নজরুল ইসলাম তামিজী

প্রকাশিত ০৬:৩৭:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১২ জুলাই ২০২৫

যখন বাংলাদেশের রাজপথে প্রতিদিন রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডের খবর আসে। এটি কেবল একঘেয়ে ঘটনা নয়, বরং একটি বিভৎস রূপে আমাদের সামনে উঠে আসে, এবং আমরা ক্রমেই এর প্রতি আরো বেশি অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছি। জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তগুলো ভুলে গেলেও, গরিব শ্রমিক কিংবা সাধারণ মানুষের প্রাণহানি যেন আমাদের সমাজের এক দুর্ভাগ্যজনক নীরব বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতাল এলাকায় ঘটে যাওয়া এক নির্মম হত্যাকাণ্ডের বর্ণনা আজ আমাদের চোখের সামনে তুলে ধরা হচ্ছে। একটি মানুষকে হত্যা করলেই তো থেমে যায় না; তার পরিণতি, সেই হত্যাকাণ্ডের পরের নৃশংসতা, মানবতার কূলকিনারা না হওয়া প্রতিটি ঘটনা চমকে দেয়।

এক ভাঙারি ব্যবসায়ীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়, শুধুমাত্র চাঁদাবাজি, আধিপত্য বিস্তার কিংবা সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণের জন্য। একদিকে যখন এসব ঘটনায় সমাজ মেনে নিয়েছে যে প্রতিদিন কত হত্যা ঘটে— ব্যক্তিগত শত্রুতা, পারিবারিক বিরোধ, ব্যবসায়িক দ্বন্দ্ব— তবে কি এমন একটি হত্যাকাণ্ড, যা মানবিকতার প্রতি এক ভয়ংকর আঘাত, কল্পনার বাইরে এক অমানবিক দৃশ্য নয়?

এই হত্যাকাণ্ডের সিসিটিভি ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর এক ভয়াবহ মৃত্যু সবার চোখে পড়ে। পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে হত্যা, পিটিয়ে, কুপিয়ে, নির্যাতন করে একটি তরতাজা প্রাণ কেড়ে নেওয়া হলো। একের পর এক পাথরের আঘাতে মৃত্যু নিশ্চিত করল ঘাতক। এমন অমানবিকতার দৃশ্য কি কখনও গ্রহণযোগ্য হতে পারে?

এ ধরনের নৃশংসতা কীভাবে সমাজে জায়গা পেতে পারে? এ কেমন বীভৎসতা? হত্যাকারীদের এমন অমানবিকতার বিরুদ্ধে আমাদের সোচ্চার হওয়া একান্ত জরুরি। যেভাবে এক মানুষকে দেহের ক্ষতি করল, তার তো মানবাধিকার রক্ষা হওয়া উচিত ছিল। প্রতিবাদ ছাড়া আমাদের অন্য কোনো পথ থাকবে না।

একটি নির্মম হত্যাকাণ্ডের পেছনে থাকা সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, মানুষের প্রতি হিংস্রতার কোনো সঠিক ব্যাখ্যা থাকতে পারে না। এটা নিছক হত্যাকাণ্ড নয়, এটি আমাদের বিবেক, মানবতা ও সমাজের জন্য একটি কলঙ্ক।

একটি প্রশ্ন যেন অমিমাংসিত রয়ে গেছে— আমরা কোথায় পৌঁছালাম? কেন এমন এক নির্মম সহিংসতা আমাদের সমাজে প্রতিদিন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে?

‘মিটফোর্ডের গেট
নেই কোনো আগাম সংবাদ
একজন মানুষ—সোহাগ—ভাঙারির মতো পড়ে থাকে
তার হাড় ভাঙা
তার দৃষ্টি স্থবির
তার পাশে দাঁড়িয়ে রক্তাক্ত ইতিহাস—
তুমি কি দেখছো? নাকি
গাড়ির হর্নে ঢাকা পড়ে যায় মৃত্যু?

এই শহর জানে কিভাবে ছুরি হাসে
কিভাবে থাপ্পড় ফেটে যায় নিঃশব্দে
আমরা কেউই নির্দোষ না
আমরা দাঁড়িয়ে থাকি গেটের পাশে
আর গুলি খাওয়া খবরের কাগজ বিক্রি করি।’

যতটা আশ্চর্যজনক, ততটাই দুঃখজনক— রাজনীতির অঙ্গনে দীর্ঘকাল ধরে চলমান সহিংসতার পরিপ্রেক্ষিতে আজকে এক একটি হত্যাকাণ্ড সাধারণ ঘটনার মতো হয়ে গেছে। এবং এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সাথে জড়িত রাজনৈতিক দলগুলির সাথে সংশ্লিষ্ট এই হত্যা, এক ধরনের পারস্পরিক লড়াই এবং শক্তির রাজনীতি প্রকাশ করে। এখানে রাজনৈতিক দলের ভিতরের শক্তির সংকটে এমন নির্মমতা দেখা দিচ্ছে, যা শুধু জাতির ইতিহাসেই নয়, মানুষের মৌলিক নৈতিকতার ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে।

কবিতার ভাষায়,
ওসি বলেন—
“পুরনো শত্রুতা ছিল…”
তারপর তিনি থামেন না
পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে এক শিশু, যার বাবা সোহাগ ছিল
আর সামনে সাংবাদিক, তার হাতে টাস্কিং রিপোর্ট
ভবিষ্যৎ তৈরি হয় ফাইল নোটে
যেখানে জবানবন্দি মানেই পলিথিন মোড়া ব্যথা।

চোখ খুলে দেখো, ঢাকা শহর
তোমার শরীরে প্রতিদিন
৮-১০ জন কুপিয়ে যায় মানবতা।’

চাঁদাবাজি, সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, এবং আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের চিত্র, যে কোনো সভ্য সমাজের জন্য একটি বড় কলঙ্ক।

কেবল হত্যার মধ্যেই থেমে থাকেনি সন্ত্রাসীরা, সোহাগের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পরও লাশের ওপর চলতে থাকে নৃশংসতা। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, পাথর দিয়ে মাথা থেঁতলে সোহাগকে হত্যা করা হয়, এরপর তার নিথর দেহটি রাস্তার মাঝখানে ফেলে দেওয়া হয়। এমন একটি ঘটনা যে কোনো মানুষের হৃদয় ও বিবেককে কষ্ট দেয়।

এ ঘটনার পেছনে রয়েছে পুরোনো সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ, রাজনৈতিক বিরোধ, এবং চাঁদাবাজির প্রেক্ষাপট। সোহাগ এবং তার হত্যাকারীরা সবাই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিল বলে জানা গেছে। হত্যাকারীদের মূল হোতা, মহম্মদ মাহমুদুল হাসান মহিনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি এবং ঘুষের অভিযোগও রয়েছে।

এমন ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড পুরান ঢাকার দরজি বিশ্বজিত হত্যাকাণ্ডের কথা মনে করিয়ে দেয়, যখন ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে তাঁকে হত্যা করেছিল। কিন্তু বর্তমান হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতা আরও বেশি, যেখানে শত শত মানুষের সামনে এক নাগাড়ে পাথর দিয়ে আঘাত করে হত্যা করা হয়েছে, অথচ কেউ এগিয়ে আসেনি।

এটি শুধুমাত্র একটি হত্যাকাণ্ড নয়, এটি আমাদের সমাজের সেই স্থিতি এবং নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। আজকের সমাজে, যেখানে আমাদের প্রতিবাদ করার সাহস ছিল, সেখানে আমরা এখন নীরব দর্শক। আমাদের কি মানবিকতাহীনতার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথ খুলে যাচ্ছে?

এই বীভৎস হত্যাকাণ্ডের পরিপ্রেক্ষিতে, আমাদের মানসিক বিপর্যস্ততা ও বিভক্তি আরও গভীর হয়েছে। জাতি হিসেবে আমাদের এখন এক প্রশ্নের মুখোমুখি : আমরা কোথায় দাঁড়াচ্ছি?

যে বিষয়টি বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা হলো জনতার নিরবতা। ঘটনার সময় সেখানে উপস্থিত থাকা শত শত মানুষ কেউই এগিয়ে আসেনি, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে যায়নি। এটি সমাজে এক ধরনের মানবিক সংকট এবং শৈথিল্য সৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। যখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাষ্ট্রের স্বীকৃত কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারেনি, তখন সাধারণ মানুষও নিরাপত্তাহীনতার কারণে চুপ হয়ে যায়, বা কোনো অপরাধের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে সাহস পায় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সহিংসতা বা হত্যাকাণ্ডের ইতিহাসে এই ঘটনাটি নতুন নয়। আগে যেমন পুরান ঢাকা এলাকায় বিশিষ্ট টেইলরের হত্যাকাণ্ডটি ঘটেছিল, ঠিক তেমনি আবার সোহাগ হত্যার ঘটনাও রাষ্ট্র এবং সমাজের জন্য বড় প্রশ্নবোধক চিহ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন আমরা এমন নৃশংসতার দায় নিতে পারছি না? কেন আমাদের আইন এবং বিচারব্যবস্থা এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে, যেখানে এই ধরনের খুন-খারাপির মধ্যে সাধারণ জনগণ আর প্রশাসন— দু’পক্ষই যেন অনভ্যস্ত?

কবিতার ভাষায়,
‘চকবাজারের মাংস দোকানে
আজ ছুরি বিক্রি বাড়তি
আর সন্দেহভাজন ধরা পড়ে
পুলিশের ব্যাকসেটে
তার চোখে নেই ভয়ের ছায়া
সে জানে, আবারও ছাড়া পাবে

এ শহরের প্রতিটি গলি জানে
কে খুন করল,
কেন করল,
আর কবে আবার করবেই।’

এটি আমাদের বোঝার জন্য সময় এবং উপযুক্ত কর্মপন্থা অন্বেষণ করার একটি সুবর্ণ সুযোগ। প্রথমত, আমাদের প্রয়োজন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমে প্রতিশ্রুতি এবং দৃঢ়তা, বিশেষত রাজনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধে। দ্বিতীয়ত, এটি সরকার এবং রাজনৈতিক দলের প্রতি বৃহত্তর দায়বদ্ধতা এবং জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে সরকারের আস্থা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন। তৃতীয়ত, সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ এবং রাজনীতি ও প্রশাসনের প্রতি নিষ্ঠাবান দায়িত্বজ্ঞানকে ফিরে আনতে হবে।

কবিতার ভাষায়,
‘ভাঙারির দোকান কি শুধুই পুরনো ফ্যান, তারের গোছা,
না কি সেখানে জমে থাকে
মানুষের ভাঙা স্বপ্ন?
সোহাগ ছিল এক নাম
এখন সে হয়ে গেছে রিপোর্ট নম্বর: ৩৫/২০২৫

সে চিৎকার করেনি,
কারণ শহরের শব্দতন্ত্রী তার কণ্ঠনালী চুরি করে নিয়েছে
সে শুধু তাকিয়ে ছিল—
যেভাবে একজন নদী মরুভূমির দিকে তাকায়।’

অতএব, সময় এসেছে আমাদের সমাজের শিকড়ে কিছু বড় পরিবর্তন আনার। যতক্ষণ না আমরা শক্তিশালী আইন প্রয়োগকারী প্রতিষ্ঠান, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতা এবং সচেতন নাগরিক গঠন করতে পারছি, ততক্ষণ পর্যন্ত সোহান হত্যা এবং তার মতো আরও অগণিত হত্যাকাণ্ড আমাদের সমাজকে গিলে খাবে। আর আমরা তা না দেখেও দেখতে থাকব।

কবিতার ভাষায়,
‘আমি বলি—এই মৃত্যু রাজনৈতিক না,
না-এটা ব্যবসায়ী দ্বন্দ্ব
এটা এই শহরের
জন্মগত বদনাম
যেখানে বেঁচে থাকাটাই রক্তাক্ত সৌন্দর্য

তুমি যদি এখনও বাঁচো
তবে তোমার প্রতিটি নিঃশ্বাসে
সোহাগের আর্তনাদ থাকে
আর আমি, মৃত আমি,
পথের পাশে বসে কবিতা লিখি
একটা লাশের হয়ে।’

একটার পর একটা নৃশংস ঘটনা ঘটেই চলছে, এবং প্রতিটি ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিবাদ উঠছে, অথচ রাষ্ট্র ও সরকার কী করছে? প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির কেউ জড়িত থাকলে তাঁকে দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে, কিন্তু ঘটনার পর প্রশাসনের কোনো কার্যকর উপস্থিতি কোথায়? প্রতিটি ঘটনাস্থলে তাৎক্ষণিকভাবে প্রশাসন কেন ছুটে যাচ্ছে না? থানা-পুলিশ, সরকারী কর্তৃপক্ষ কোথায়?

এক বছর হতে চলেছে, কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে দেশের মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য কেউ নেই। এমন পরিস্থিতিতে পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি কেন সবচেয়ে ‘গুরুত্বহীন’ করে ফেলা হলো? নিরাপত্তাহীনতায় জনগণকে ছেড়ে দিয়ে রাষ্ট্র কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে? শুধু রাজধানীতে বসে হুঁশিয়ারি বার্তা দিয়ে প্রশাসন চালানো কি আসলেই যথেষ্ট?

অথচ জনগণের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের প্রধান দায়িত্ব। পুলিশ সংস্কারের বিষয়টি দ্রুতগতিতে এগিয়ে না নেওয়ার ফলে, দেশে আইনের শাসন ভেঙে পড়ছে এবং মানুষের মধ্যে ভীতি ও অস্থিরতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রশাসন যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে শুধু বার্তা দিয়ে কিংবা প্রতিক্রিয়া জানিয়ে কোনো সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। সরকারের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, যাতে মানুষের জীবন ও সম্পত্তির নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।