ষাটের দশকের দুর্দান্ত কবি আসাদ চৌধুরী। তবক দেয়া পানের মধ্য দিয়ে প্রথম প্রকাশ ঘটে। বই প্রকাশের আগে দৈনিক সংবাদে তাঁর লেখা প্রকাশিত হয়। হাস্য লাস্য অভিমানী আসাদ চৌধুরী এক ফালি হাসি দিয়ে বলে ফেলেন কেমন আছো। আমার চোখে এখনো ভাসে তাঁর হাসিমুখ। “হৃদয় মাঝে রেখে দিও সবটুকু অর্জন, মানুষের সাথে ভেদাভেদ না করে নিজেকে সঁপে দিয়ো”। কবিতো সেই মনেরই একজন মানুষ ছিলেন। পদ্যের লালিত্যে যে মহতী শিল্পের নির্মাণ তাঁর কাব্যের অবয়ব তা শুধু লোকজধারা নয়, কবি হিসাবে সমকালীন জীবন প্রবাহ, যুগ চেতনা, সমাজ, রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ও দেশের উত্থান-পতন এ সবই তাঁর কাব্যে স্থান পেয়েছে।
এই শেকড় সন্ধানী কবির হাতে বাংলা কাব্যের আদি ও লোকজধারা নতুনভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি কবিতায় লোকজতার ব্যবহার করেছেন সচেতন ভাবে। যেখানে ছড়া, প্রবাদ-প্রবচন এবং লোকজ শব্দের চিত্রল ব্যবহারে সমকালীন জীবনের প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তাঁর কবিতায় লোকসাহিত্যর উপাদান আধুনিক বুননে নতুনভাবে বিকশিত হয়েছে। আসাদ
চৌধুরীর কবিতায় প্রেমের নান্দনিক প্রকাশ লক্ষণীয়। এই কবি সৃষ্টি ভাণ্ডার পূর্ণ হয়েছে তাঁর অনবদ্য কাব্য প্রতিভায়। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ তাঁর কবিতার শাশ্বত রুপ। প্রগতিশীল রাজনৈতিক চেতনায় বিশ্বাসী এবং গণমানুষের অধিকার সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা ও জীবন জগতের প্রতি গাঢ় ভালোবাসার কারণে তিনি তাঁর কাব্যে সবকিছুকে অকৃপণভাবে ধারণ করতে পেরেছেন। তাঁর শিল্পী দর্শনের রুপটি বহুমাত্রিক। ফলে তাঁর শিল্পীমানস হয়ে উঠেছে শুদ্ধচারী এক জীবনবাদী লোকজ কবির অকুণ্ঠ বর্ণনার ব্যঞ্জনাময় মূর্ত প্রতীক। বলা যায় লোকজতা ও সমকালীন জীবন প্রবাহ নির্মাণে নিজের এই সংবেদনশীল কবিসত্তার রূপায়ণে সৃষ্টি করেছেন নিজস্ব নির্মাণ কৌশল। তাই তিনি লোকজ কবি হয়েও চেতনায় জাতিসত্ত্বার কবি। আসাদ চৌধুরী জীবনবাদী কবি। ইতিহাস, ঐতিহ্য, শ্লেষাত্মক প্রেম এবং মরমীবাদের অনায়াসলব্ধ সৃষ্টিশীলতা তাঁর কবিতার মেজাজকে ভিন্নতর শিল্প মহিমায় উন্নীত করছেন। তবে অবশ্যই তিনি কবিতায় পরিমিতিবোধ বজায় রেখেছেন।
ষাটের দশকে যে কয়জন কবি সাহিত্যিকদের আগমন ঘটেছে তন্মধ্যে আসাদ চৌধুরীর কাব্যে ও সৃষ্টিকর্মে বাঙালির ঐতিহ্যকে ধারণ করার দায়বোধ্যতা লক্ষ করা যায়। জনপ্রিয় কবি ও প্রখ্যাত উপস্থাপক আসাদ চৌধুরী। আসাদ চৌধুরী এক চেতনার নাম, মাটির শেকড়ের নাম, বাঙালির লালিত লোকজ ঐতিহ্যের নাম। আপাদমস্তক বাঙালিয়ানা এক কবি। সদা হাস্যোজ্জ্বল কর্মব্যস্ত কবি। ১৯৬১ সালে দৈনিক সংবাদ পত্রিকায় নিহত প্যাট্রিস লুমুম্বার এর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জালি ইতিহাসের আর এক নায়ক নামে কবিতা প্রকাশের মাধ্যমে। কবি দীর্ঘদিন ধরে লিখে গেছেন। তিনি প্রবন্ধকার, অনুবাদক, শিশুসাহিত্যিক, ছড়াকার এ জাতীয় নানা বিশেষণে বিশেষায়িত হলেও তাঁর প্রধানতম পরিচয় তিনি কবি। আসাদ চৌধুরী ভুলে যাননি মাটির গন্ধ, শেকড়ের টান, লোক ঐতিহ্যের গীতলতা আর কবিতায় আধুনিক বুনন।
এ এক অনবদ্য সৃষ্টি কৌশল। যেমন ধান নিয়ে ধানাই পানাই কবিতায়-
লবণ লবণ ডাক পাড়ি
লবণ গেলো কার বাড়ি?
লঙ্কা-লঙ্কা ডাকপাড়ি
লঙ্কা গেল দেশ ছাড়ি!
আয়রে মুর্দা ঘরে আয়
দুধ-মাখা ভাত কাকে খায়।
এই কবিতাটি যেমন দুর্ভিক্ষের দুঃসহ স্মৃতি স্মরণ দেয় তেমনি কবিতাটির সাথে লোকসাহিত্যর ছড়ার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
তবক দেওয়া পান কাব্যগ্রন্থের “তখন সত্যি মানুষ ছিলাম” একটি অসাধারণ কবিতা হিসাবে কালের স্বাক্ষরে ভাস্বর হয়ে আছে।
নদীর জলে আগুন ছিলো
আগুন ছিলো বৃষ্টিতে
আগুন ছিলো বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে।
“সত্য ফেরারি” কবিতায় কবি সত্যকে খুঁজে ফিরেছেন কিন্তু সত্য নামক সোনার হরিণের দেখা মেলে না। সমাজে যে অবক্ষয় ও মূল্যবোধের বিপর্যয় ঘটেছে তা কবি অনুভব করতে পেরেছিলেন।
কোথায় পালালো সত্য
দুধের বোতলে, ভাতের হাঁড়িতে! নেই তো।
“চোর” কবিতায় সমাজের শোষক শ্রেণির এবং লুটেরাদের চিত্র বিধৃত করেছেন
নামটি চোরের বলতে গেলে হবেন দাদা জব্দ।
জব্দ না করার শালীনতাবোধে আসাদ চৌধুরীর কবিতা শিল্পীত সত্যের প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন।
এই কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “বিত্ত নাই বেসাত নাই” এই কাব্যগ্রন্থের সমাজ, স্বদেশ ও ব্যক্তি সচেতনতার বোধটি আরো বেশি তীব্র ও চমৎকারিত্বে প্রকাশ পেয়েছে। “স্বীকারোক্তি” কবিতায় নিজেকে লড়াইয়ের নিয়ম না জানা এক নগণ্য মানুষ মনে হয়েছে তাঁর। সবকিছু মূল্যহীন মনে হয়েছে রুটি-রুজির কাছে।
“যে পারে পারুক” কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায় কবির লোকজ সহজাত প্রবণতা অনিবার্যভাবে ধরা দিয়েছে। “ফাগুন এলেই” কবিতায়-
ফাগুন এলেই পাখি ডাকে
থেকে থেকেই ডাকে
তাকে তোমরা কোকিল বলবে? বলো।
আমি যে তার নাম রেখেছি আশা,
নাম দিয়েছি ভাষা,
কতো নামেই ‘তাকে’ ডাকি
মেটে না পিপাসা।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালির মাতৃভাষাকে দিয়েছিল অধিকার। প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল বাংলা ভাষার গৌরব ও স্বাধীকার। মাতৃভাষার চেতনার রঙে রঙিন বাংলা ভাষাকে কত নামে ডাকতে চান তবু তার পিপাসা মিটেনা। তাঁর শিল্পীত চেতনার কোকিলের কণ্ঠেও যেন বাংলা ভাষার সুমধুর ধ্বনি শুনতে পান।
“দুঃখীরা গল্প করে” কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতায়ই কবির মানুষের প্রতি, সমাজের প্রতি দুঃখবোধ প্রকাশ পেয়েছে। “যা পারে না” কবিতায়-
হয়তো পারি অনেক কিছুই
যা পারি না (ধরুন যেমন)
লোভীর চোখের দীপ্তিটুকু
একটি ফুঁতে নিভিয়ে দিতে
ভিখারীদের হ্যাংলা হাতে
মর্যাদার মহিমা দিতে।
“স্বাধীনতা ও রিপোর্ট ১৯৭১” কবিতায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকাশ ঘটেছে বিশেষ মর্যাদায় এবং কবি ভিন্ন মাত্রায় অনুভব করতে চেয়েছেন চেতনাকে।
“এরই নাম স্বাধীনতা” কবিতায় কবির সেই ভাব ব্যক্ত হয়েছে- মরার কাফন ভাতের লবণ
কেড়ে নিল স্বাধীনতা?
ওঠে আহাজারি প্রতি ঘরে-ঘরে
এরই নাম স্বাধীনতা।
উৎপ্রেক্ষা ঃ- আগুন ছিলো গানের সুরে
আগুন ছিলো কাব্যে
মরার চোখে আগুন ছিলো
এ কথা কে ভাববে।
এভাবেই কবি আসাদ চৌধুরীর ছন্দ অলঙ্কারে নানা বৈচিত্র্যে, নানা আয়তনিক কবিতার সৃষ্টিতে মগ্ন থেকেছেন। ফয়সাল বারী কবিকে যে উচ্চ মাত্রায় আসিন করেছেন আমি তাঁর ছিটেফোঁটাও সেই সন্মানটুকু দিতে পেরেছি কিনা জানি না। তবে ফয়সাল বারী অসাধারণ লেখনীর মধ্য দিয়ে কবির সবটুকু আশা পূরন করতে পেরেছেন বলে আমি মনে করি। কবির ভিতরের মানুষটাকে বের করে আনতে পেরেছেন এই স্বার্থকতা গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন। আমি শুধু কবিকে একজন শুদ্ধ মানুষ হিসাবে দেখতে পেয়েছি। অন্য কোন হিসেব মিলাতে আমি আসিনি। কবিকে আরও আরও বেশি বেশি স্মরণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। বইটি পাঠক সমাজের মাঝে সাড়া জাগবে বলে মনে কবি।