১২:২৪ অপরাহ্ন, সোমবার, ০৭ এপ্রিল ২০২৫, ২৪ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

উৎপাদন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অবাধে চলছে পলিথিন

  • প্রকাশিত ১২:০১:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • ১৪০ বার দেখা হয়েছে

 

অবনী অনিমেষ
নিজস্ব প্রতিবেদক

পলিথিনের ভয়ঙ্কর দূষণ জনস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশে প্রায় ২০ বছর আগে আইন করে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ হয়নি।

আইনী দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের এই উপাদান এখন রাজধানীসহ সারাদেশেই সহজলভ্য।ঢাকা শহরের কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, বেগমগঞ্জ, চকবাজার, মৌলভীবাজার, চানখাঁরপুল, ইসলামবাগ, লালবাগ, ইমামগঞ্জ, আরমানিটোলা, দেবীদাস লেন, সোয়ারিঘাট, মিরপুর, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর, জিঞ্জিরা ও টঙ্গীতে পলিথিন কারখানা রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকায়ও পলিথিন উৎপাদন হয়।

পরিবেশ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা করে ও কারাদণ্ডও দেয়। তবুও পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না। আইনের কঠোর প্রয়োগ না করায় অভিযানের ক’দিন পরই আবারও স্বাভাবিকভাবেই চলে উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। যার বেশির ভাগই ঢাকায়। শুধু পুরান ঢাকার অলিগলিতে আছে ৫ শতাধিক কারখানা।

অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর-মহানগরের পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যরে কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল-বিল-নদী, দূষিত হচ্ছে পানি।পলিথিন বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে পারলে পলিথিন উঠিয়ে নেয়া সহজ হবে। পলিথিন থেকে নির্গত হয় বিষফেনোল নামক বিষাক্ত পদার্থ। যা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। এছাড়া পলিথিন এমন একটি উপাদান যা পরিবেশের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। মানুষের অবাধে ব্যবহারের পর যত্রতত্র ছুড়ে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে-নর্দমায় ঢুকে পড়ে। এতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হওয়ার ফলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী। ঢাকা শহর সহ সারা দেশের পয়োনিষ্কাশনের ৮০ ভাগ ড্রেনে পলিথিন জমাট বেঁধে আছে। এর ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির সময় অনেক ম্যানহোল থেকে পলিথিনের স্ত‚প বের করা হয়। এ ছাড়া পলিথিন খাল-বিল, নদী-নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া রাস্তাঘাটে স্তপ হয়ে জমে থাকা পলিথিন অনেক সময় পোড়ানো হয়ে থাকে। এই পোড়া পলিথিন থেকেও ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পলিথিন বন্ধে কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। পলিথিনবিরোধী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে‌ ক্ষতিকর পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধের চেষ্টা করছে।

যেখানে পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে, অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরা হচ্ছে, মামলা দেয়া হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে মানুষকে পলিথিনের বিকল্প চটের ও কাগজের ব্যাগ পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে। বাজারে কাগজ ও চটের ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে পলিথিনের ক্ষতি থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারি। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সারাদেশে চলছে পলিথিনের রমরমা বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার হচ্ছে। ক্ষুদ্র একটি জিনিস থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন বিক্রেতারা পলিথিনের ব্যাগে করেই ক্রেতাদের হাতে তুলে দেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে চর্মরোগ ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে পলিথিন ব্যাগকে চর্মরোগের এজেন্ট বলা হয়। এছাড়া পলিথিনে মাছ, মাংস মুড়িয়ে রাখলে এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়। সরেজমিনে রাজধানীর বসুন্ধরা, নতুনবাজার, গুলশান, বাড্ডা, আজমপুর, খিলক্ষেত, মালিবাগ, মগবাজার, সেগুনবাগিচা ও কাওরানবাজার ঘুরে দেখা পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। দোকানিরা প্রতিটি পণ্যই পলিথিনের ব্যাগে পুরে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যসহ ছোট ছোট পলিথিনের ব্যাগগুলো আবার বড় বড় পলিথেনের ব্যাগে ভরে ক্রেতাদের হাতে দেয়া হচ্ছে। খুব কম ক্রেতাকেই বাসা থেকে চট কিংবা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাজারে আসতে দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেমে জ্যাম লাগিয়ে রাখা আবর্জনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ পলিথিন। পলিথিনের কারণে অন্য সব আবর্জনাও জট পাকিয়ে থাকে। তাই নগরবাসী যখন অপচনশীল পলিথিন রাস্তায় ফেলছেন, তা বহুবছর কোন না কোন ড্রেনে আটকে থাকে কিংবা বুড়িগঙ্গানদীসহ আশপাশের কোন জলাশয়ে গিয়ে জমে থাকে। এ কারণেই পলিথিন বর্জ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের জলাশয় সহ সারা দেশের নদী এবং খালগুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার। বিভিন্ন সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বেশ কয়েক ফুট পুরো পলিথিনের স্তরের কারণে বুড়িগঙ্গার তলদেশের পানি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে তলদেশের কয়েক ফুট মাটিও। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ আশঙ্কাজন হারে কম। এ কারণে এখানে মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। এছাড়া শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর তলদেশেও কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর জমে আছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দশম স্থানে। সম্প্রতি এসডো নামক এক বেসরকারী সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে দেশে করোনাভাইরাস মহামারীকাল থেকে পরবর্তী সময়ে ৭৮ হাজার টনেরও বেশি পলিথিন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে‌ বর্তমানে শুধু রাজধানী ঢাকায় পাঁচ হাজার ৯৯৬ টন। পলিথিন বন্ধে অভিযান একসময় চললেও এখন অজ্ঞাত কারণে বন্ধ আছে। এখন যেভাবে পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে তা বেআইনী। এ ব্যাপারে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই। বিএসটিআই এ ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের প্রজ্ঞাপন পাশ কাটিয়ে এসব হলেও তারা নীরব থেকে ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিচ্ছেন, তা দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ। এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকার প্রাণ বলে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এখন পলিথিনের কারণে ভয়াবহ দূষিত। এই নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে প্রায় ৮ ফুট পুরো পলিথিনের স্তর। ভয়াবহ দূষণের কারণে এই নদীর পানি থেকে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। আরেক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাজধানীর একটি পরিবার গড়ে প্রতিদিন ৪টি পলিথিন ব্যবহার করে। সে হিসাবে শুধু রাজধানীতে ঢাকার মানুষই প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যবহার করে। আর ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে রাখে এসব পলিথিন। এ কারণেই রাজধানী ও আশপাশের এলাকা এখন ভয়ঙ্কর পলিথিন দূষণের মুখে। পরিবেশের জন্য পলিথিন মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি অপচনশীল পদার্থ। তাই এর পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। মাটির উর্বরতা হ্রাস ও গুণাগুণ পরিবর্তন করে ফেলে। কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন সূর্যের আলো ফসলের গোড়ায় পৌঁছতে বাধা দেয়। ফলে মাটির ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া না মারা যাওয়ায় জমিতে উৎপাদন কমছে। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিফিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে। পলিথিনের পরিত্যক্ত ব্যাগ শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপক ব্যবহার ও যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় সারাদেশে রাস্তা-ঘাট ও খাল-বিল-নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এসব জলাশয় থেকে ধৃত মাছের মাধ্যমে এ দূষণ মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে চর্মরোগসহ মারাত্মক ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

‘নারডল’ নামক এক প্রকার পলিথিন বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে যাওয়ায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই পলিথিনবিরোধী অভিযান চালানো হয়। কারখানা বন্ধ করার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ পলিথিন জব্দও করা হয়। কিন্তু অভিযানের পর আবারও উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। পলিথিনের ব্যাগের বিকল্প চটের ব্যাগ আছে। এর প্রভাবে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ হতে পারে। পলিথিন মাটির সঙ্গে মিশতে প্রায় শতবছর লাগে। পরিত্যক্ত পলিথিন বিভিন্ন জলাশয় হয়ে সমুদ্রে পর্যন্ত চলে যায়। এ সকল জলাশয়ের মাছ থেকে পলিথিনের দূষণ মানুষের কাছে চলে আসে। এভাবে মানবদেহের অনেক ক্ষতি করে। তাই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে চট ও কাগজের ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতলের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে সরকারের তেমন কোন পদক্ষেপ নেই। দেশের ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী তাই পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও তেমন তৎপরতা নেই। পৃথিবীর অনেক দেশ পলিথিনের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কেন তা বন্ধ করতে পারছে না। সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন তেমনটি এখন আর দেখা যায় না। তবে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বায়োপলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার করা যেতে পারে। বায়োপলিথিন দ্রিত পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন তৈরির চেয়ে আরও ভয়াবহ ক্ষতিকর হচ্ছে পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে এর থেকে আবার নতুন পলিথিন তৈরি করা। এতে করে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া পুরনো পলিথিন এনে তা গলিয়ে আবারও বানানো হচ্ছে নতুন ব্যাগ। এতে পরিবেশ আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন কারখানায় পুরনো পলিথিন পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকা হুমকির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রকাশিত তথ্যমতে, শুধু রাজধানী ঢাকায়ই দিনে প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। আর বিশ্বে প্রতি বছর ব্যবহার হচ্ছে পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক বলে বিবেচনা করে প্রায় ২০ বছর আগে রফতানিমুখী শিল্প ছাড়া সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রাণ ও পরিবেশ বাঁচাতে শাস্তির বিধান রেখে আইন করা হয়। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি থামানো যায়নি, কিছুদিন পর ফের বাজার ছেয়ে যায় পলিথিনে। পণ্য বহনে পরিবেশবান্ধব পাটজাত ব্যাগ ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা থাকলেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ, উৎপাদন, মজুদ, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। রফতানিযোগ্য কিছু পণ্য, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণু পোনা পরিবহন ও মাশরুম চাষের জন্য পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পলিথিন ব্যাগ তৈরি করছে। আর ক্ষতিকর জানার পরও দিন দিন এই ব্যাগের ব্যবহার বেড়েই চলছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। এ বিষয়টি সবাই জানলেও কার্যত তেমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০০২ সালে সরকার আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬(ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, যদি কোন ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। ২০০২ সালে তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ পলিথিনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এর উৎপাদন ও বিপণন প্রায় বন্ধ হয়ে আসলেও এরপর ধীরে ধীরে আবারও পলিথিনের উৎপাদন ও এর ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দেয়া তথ্য অনুসারে বিশ্বের ৮৭টি দেশে একবার ব্যবহার উপযোগী পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। অনেক আইন করে পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্থলের পর এবার জল তথা সাগর-মহাসাগরকেও বিষিয়ে তোলা হচ্ছে বিষাক্ত পলিথিন ব্যবহার করে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত কিংবা সেন্টমার্টিন সৈকতেও ফেলা হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ ও প্লাস্টিকের বোতল। পলিথিনের কারণে কৃষি জমির উর্বরতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ায় মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচে পানি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। যে কারণে মাটির গুণগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নিচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম অক্সিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়। পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। আইন অমান্য করেই সারাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম উপাদান পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ফের ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারি না থাকায় প্রকাশ্যে বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে এসব পলিথিন ব্যাগ। খুচরা বাজারই নয়, নিষিদ্ধ পলিথিনের রয়েছে পাইকারি বাজারেও। চকবাজার, মৌলভীবাজার ও কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে পাইকারি দরে তা বিক্র হচ্ছে দেদার। ঢাকার খালগুলো মরে যাওয়ার জন্যও অনেকাংশে দায়ী পলিথিন। পলিথিনের বহুবিধ ব্যবহারের কারণে মানবদেহে বাসা বাঁধছে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ। ঢাকায় যে কয়টি পানি শোধনাগার রয়েছে সেগুলোও ঠিকমতো চালানো সম্ভব হয় না পরিত্যক্ত পলিব্যাগের কারণে। এ অবস্থার অবসানে পলিথিন বর্জ্যকে বিশেষ কৌশলে রিসাইক্লিং বা ডাম্পিং করা জরুরী।

Tag :
জনপ্রিয়

এলজিইডির ভিতর বাহির ক্ষমতাধর মশিউর, কে রুখবে তাকে

উৎপাদন, বিপণন এবং বাজারজাতকরণে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও অবাধে চলছে পলিথিন

প্রকাশিত ১২:০১:৩৬ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

অবনী অনিমেষ
নিজস্ব প্রতিবেদক

পলিথিনের ভয়ঙ্কর দূষণ জনস্বাস্থ্য ও প্রাকৃতিক পরিবেশকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। দেশে প্রায় ২০ বছর আগে আইন করে নিষিদ্ধ হওয়ার পরও এর উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধ হয়নি।

আইনী দুর্বলতার সুযোগে পরিবেশ বিপর্যয়ের এই উপাদান এখন রাজধানীসহ সারাদেশেই সহজলভ্য।ঢাকা শহরের কোতোয়ালি, সূত্রাপুর, বেগমগঞ্জ, চকবাজার, মৌলভীবাজার, চানখাঁরপুল, ইসলামবাগ, লালবাগ, ইমামগঞ্জ, আরমানিটোলা, দেবীদাস লেন, সোয়ারিঘাট, মিরপুর, তেজগাঁও, কামরাঙ্গীরচর, জিঞ্জিরা ও টঙ্গীতে পলিথিন কারখানা রয়েছে। এছাড়া নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য এলাকায়ও পলিথিন উৎপাদন হয়।

পরিবেশ অধিদফতর ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধে মাঝে মাঝে অভিযান চালিয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জরিমানা করে ও কারাদণ্ডও দেয়। তবুও পলিথিন ব্যবহার বন্ধ হয় না। আইনের কঠোর প্রয়োগ না করায় অভিযানের ক’দিন পরই আবারও স্বাভাবিকভাবেই চলে উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকাসহ সারাদেশে নিষিদ্ধ পলিথিন তৈরির এক হাজার ২০০ কারখানা রয়েছে। যার বেশির ভাগই ঢাকায়। শুধু পুরান ঢাকার অলিগলিতে আছে ৫ শতাধিক কারখানা।

অপচনশীল সর্বনাশা পলিথিনের যত্রতত্র ব্যবহারের ফলে ভরাট হচ্ছে নগর-মহানগরের পয়োনিষ্কাশনের নালা-নর্দমা। ভেঙ্গে পড়ছে ড্রেনেজ ব্যবস্থা। পলিথিন বর্জ্যরে কারণে উর্বরতা হারাচ্ছে মাটি, বাতাসে ছড়াচ্ছে বিষ। ভরাট হচ্ছে খাল-বিল-নদী, দূষিত হচ্ছে পানি।পলিথিন বন্ধ করার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে বিকল্প ব্যবহার বাড়াতে পারলে পলিথিন উঠিয়ে নেয়া সহজ হবে। পলিথিন থেকে নির্গত হয় বিষফেনোল নামক বিষাক্ত পদার্থ। যা মানবদেহের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর। এছাড়া পলিথিন এমন একটি উপাদান যা পরিবেশের জন্য মোটেই উপযোগী নয়। মানুষের অবাধে ব্যবহারের পর যত্রতত্র ছুড়ে ফেলে দেয়া উচ্ছিষ্ট পলিথিন বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনে-নর্দমায় ঢুকে পড়ে। এতে ড্রেনেজ ব্যবস্থা অচল হওয়ার ফলে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে। দুর্ভোগের শিকার হয় নগরবাসী। ঢাকা শহর সহ সারা দেশের পয়োনিষ্কাশনের ৮০ ভাগ ড্রেনে পলিথিন জমাট বেঁধে আছে। এর ফলে সামান্য বৃষ্টি হলেই দেখা দেয় অসহনীয় জলাবদ্ধতা। বৃষ্টির সময় অনেক ম্যানহোল থেকে পলিথিনের স্ত‚প বের করা হয়। এ ছাড়া পলিথিন খাল-বিল, নদী-নালায় জমা হয়ে তলদেশ ভরাট করে ফেলে। নাব্য নষ্ট হওয়ায় নৌপরিবহনে বিঘ্ন ঘটে। এছাড়া রাস্তাঘাটে স্তপ হয়ে জমে থাকা পলিথিন অনেক সময় পোড়ানো হয়ে থাকে। এই পোড়া পলিথিন থেকেও ভয়াবহ পরিবেশ দূষণ হয়। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পলিথিন বন্ধে কঠোরভাবে আইন বাস্তবায়ন করতে হবে। পলিথিনবিরোধী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করতে হবে। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য রক্ষার বিষয়টিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে‌ ক্ষতিকর পলিথিনের উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার বন্ধের চেষ্টা করছে।

যেখানে পলিথিন পাওয়া যাচ্ছে, অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের ধরা হচ্ছে, মামলা দেয়া হচ্ছে। কাউকে ছাড় দেয়া হচ্ছে না। অভিযান অব্যাহত থাকবে। তবে মানুষকে পলিথিনের বিকল্প চটের ও কাগজের ব্যাগ পর্যাপ্ত পরিমাণে দিতে হবে। বাজারে কাগজ ও চটের ব্যাগ পাওয়া যাচ্ছে। আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, যাতে পলিথিনের ক্ষতি থেকে দেশের মানুষকে রক্ষা করতে পারি। নিষিদ্ধ হওয়ার পরও সারাদেশে চলছে পলিথিনের রমরমা বাণিজ্য। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখের সামনেই রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার হচ্ছে। ক্ষুদ্র একটি জিনিস থেকে শুরু করে সবকিছুই এখন বিক্রেতারা পলিথিনের ব্যাগে করেই ক্রেতাদের হাতে তুলে দেন। চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারে চর্মরোগ ও ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগে আক্রান্ত হতে পারেন যে কেউ। তাই চিকিৎসা বিজ্ঞানে পলিথিন ব্যাগকে চর্মরোগের এজেন্ট বলা হয়। এছাড়া পলিথিনে মাছ, মাংস মুড়িয়ে রাখলে এতে রেডিয়েশন তৈরি হয়ে খাবার বিষাক্ত হয়। সরেজমিনে রাজধানীর বসুন্ধরা, নতুনবাজার, গুলশান, বাড্ডা, আজমপুর, খিলক্ষেত, মালিবাগ, মগবাজার, সেগুনবাগিচা ও কাওরানবাজার ঘুরে দেখা পলিথিনের ব্যাপক ব্যবহার লক্ষ্য করা গেছে। দোকানিরা প্রতিটি পণ্যই পলিথিনের ব্যাগে পুরে ক্রেতাদের হাতে তুলে দিচ্ছেন। বিভিন্ন পণ্যসহ ছোট ছোট পলিথিনের ব্যাগগুলো আবার বড় বড় পলিথেনের ব্যাগে ভরে ক্রেতাদের হাতে দেয়া হচ্ছে। খুব কম ক্রেতাকেই বাসা থেকে চট কিংবা কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে বাজারে আসতে দেখা গেছে। একই অবস্থা দেখা গেছে বিভিন্ন মার্কেট ও শপিংমলে। ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, রাজধানীর ড্রেনেজ সিস্টেমে জ্যাম লাগিয়ে রাখা আবর্জনাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যার কারণ পলিথিন। পলিথিনের কারণে অন্য সব আবর্জনাও জট পাকিয়ে থাকে। তাই নগরবাসী যখন অপচনশীল পলিথিন রাস্তায় ফেলছেন, তা বহুবছর কোন না কোন ড্রেনে আটকে থাকে কিংবা বুড়িগঙ্গানদীসহ আশপাশের কোন জলাশয়ে গিয়ে জমে থাকে। এ কারণেই পলিথিন বর্জ্যে বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকার চারপাশের জলাশয় সহ সারা দেশের নদী এবং খালগুলো ভয়াবহ দূষণের শিকার। বিভিন্ন সমীক্ষা রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, বেশ কয়েক ফুট পুরো পলিথিনের স্তরের কারণে বুড়িগঙ্গার তলদেশের পানি একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে গেছে তলদেশের কয়েক ফুট মাটিও। বুড়িগঙ্গার পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ আশঙ্কাজন হারে কম। এ কারণে এখানে মাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী অস্বাভাবিক হারে কমে গেছে। এছাড়া শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর তলদেশেও কয়েক ফুট পলিথিনের স্তর জমে আছে। পলিথিন ও প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদনে সারা বিশ্বে বাংলাদেশ এখন দশম স্থানে। সম্প্রতি এসডো নামক এক বেসরকারী সংস্থার সমীক্ষা রিপোর্টে প্রকাশিত হয়েছে দেশে করোনাভাইরাস মহামারীকাল থেকে পরবর্তী সময়ে ৭৮ হাজার টনেরও বেশি পলিথিন বর্জ্য উৎপাদন হয়েছে‌ বর্তমানে শুধু রাজধানী ঢাকায় পাঁচ হাজার ৯৯৬ টন। পলিথিন বন্ধে অভিযান একসময় চললেও এখন অজ্ঞাত কারণে বন্ধ আছে। এখন যেভাবে পলিথিন ব্যবহৃত হচ্ছে তা বেআইনী। এ ব্যাপারে সরকারের তেমন মাথাব্যথা নেই। বিএসটিআই এ ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ। তাদের প্রজ্ঞাপন পাশ কাটিয়ে এসব হলেও তারা নীরব থেকে ব্যবসায়ীদের সুবিধা করে দিচ্ছেন, তা দুর্নীতির বহিঃপ্রকাশ। এক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ঢাকার প্রাণ বলে পরিচিত বুড়িগঙ্গা নদীর পানি এখন পলিথিনের কারণে ভয়াবহ দূষিত। এই নদীর তলদেশে জমাট বেঁধেছে প্রায় ৮ ফুট পুরো পলিথিনের স্তর। ভয়াবহ দূষণের কারণে এই নদীর পানি থেকে ছড়াচ্ছে তীব্র দুর্গন্ধ। আরেক গবেষণা রিপোর্ট থেকে জানা যায়, রাজধানীর একটি পরিবার গড়ে প্রতিদিন ৪টি পলিথিন ব্যবহার করে। সে হিসাবে শুধু রাজধানীতে ঢাকার মানুষই প্রতিদিন প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যবহার করে। আর ব্যবহারের পর যত্রতত্র ফেলে রাখে এসব পলিথিন। এ কারণেই রাজধানী ও আশপাশের এলাকা এখন ভয়ঙ্কর পলিথিন দূষণের মুখে। পরিবেশের জন্য পলিথিন মারাত্মক ক্ষতিকর। এটি অপচনশীল পদার্থ। তাই এর পরিত্যক্ত অংশ দীর্ঘদিন অপরিবর্তিত ও অবিকৃত থেকে মাটি ও পানি দূষিত করে। মাটির উর্বরতা হ্রাস ও গুণাগুণ পরিবর্তন করে ফেলে। কৃষিক্ষেত্রে পলিথিন সূর্যের আলো ফসলের গোড়ায় পৌঁছতে বাধা দেয়। ফলে মাটির ক্ষতিকারক ব্যাক্টেরিয়া না মারা যাওয়ায় জমিতে উৎপাদন কমছে। পলিথিন পোড়ালে এর উপাদান পলিফিনাইল ক্লোরাইড পুড়ে কার্বন মনোক্সাইড উৎপন্ন হয়ে বাতাস দূষিত করে। পলিথিনের পরিত্যক্ত ব্যাগ শহরের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। পলিথিন ও বিভিন্ন প্লাস্টিক পণ্য ব্যাপক ব্যবহার ও যত্রতত্র ফেলে দেয়ায় সারাদেশে রাস্তা-ঘাট ও খাল-বিল-নদী-নালা থেকে শুরু করে সমুদ্র পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে। মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। এসব জলাশয় থেকে ধৃত মাছের মাধ্যমে এ দূষণ মানবদেহে প্রবেশ করছে। ফলে চর্মরোগসহ মারাত্মক ক্যান্সার পর্যন্ত হচ্ছে। সেই সঙ্গে মারাত্মক হুমকির মুখে পড়েছে জীববৈচিত্র্য।

‘নারডল’ নামক এক প্রকার পলিথিন বর্জ্য সমুদ্রের পানিতে মিশে যাওয়ায় সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশেই পলিথিনবিরোধী অভিযান চালানো হয়। কারখানা বন্ধ করার পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ পলিথিন জব্দও করা হয়। কিন্তু অভিযানের পর আবারও উৎপাদন ও ব্যবহার শুরু হয়ে যায়। পলিথিনের ব্যাগের বিকল্প চটের ব্যাগ আছে। এর প্রভাবে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন মারাত্মক রোগ হতে পারে। পলিথিন মাটির সঙ্গে মিশতে প্রায় শতবছর লাগে। পরিত্যক্ত পলিথিন বিভিন্ন জলাশয় হয়ে সমুদ্রে পর্যন্ত চলে যায়। এ সকল জলাশয়ের মাছ থেকে পলিথিনের দূষণ মানুষের কাছে চলে আসে। এভাবে মানবদেহের অনেক ক্ষতি করে। তাই পলিথিনের বিকল্প হিসেবে চট ও কাগজের ব্যাগ এবং প্লাস্টিকের পরিবর্তে কাচের বোতলের ব্যবহার বাড়াতে হবে। পলিথিনের ক্ষতিকর দিক থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে। কিন্তু পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে সরকারের তেমন কোন পদক্ষেপ নেই। দেশের ব্যবসায়ীরা প্রভাবশালী তাই পলিথিনের উৎপাদন বন্ধ করা যাচ্ছে না বলে মনে হচ্ছে। এ বিষয়ে সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। তিনি বলেন, পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও তেমন তৎপরতা নেই। পৃথিবীর অনেক দেশ পলিথিনের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কেন তা বন্ধ করতে পারছে না। সাবেক পরিবেশ ও বনমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ পলিথিনের উৎপাদন ও ব্যবহারের বিরুদ্ধে যেভাবে সোচ্চার ছিলেন তেমনটি এখন আর দেখা যায় না। তবে পলিথিনের বিকল্প হিসেবে বায়োপলিথিন উৎপাদন ও ব্যবহার করা যেতে পারে। বায়োপলিথিন দ্রিত পচে মাটির সঙ্গে মিশে যায়। পলিথিন তৈরির চেয়ে আরও ভয়াবহ ক্ষতিকর হচ্ছে পুরনো পলিথিন পুড়িয়ে এর থেকে আবার নতুন পলিথিন তৈরি করা। এতে করে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করছে। ব্যবহারের পর ফেলে দেয়া পুরনো পলিথিন এনে তা গলিয়ে আবারও বানানো হচ্ছে নতুন ব্যাগ। এতে পরিবেশ আরও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন কারখানায় পুরনো পলিথিন পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণের ক্ষেত্রে রাজধানী ঢাকা হুমকির মুখে পড়ছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) প্রকাশিত তথ্যমতে, শুধু রাজধানী ঢাকায়ই দিনে প্রায় ২ কোটি পলিথিন ব্যাগ জমা হচ্ছে। আর বিশ্বে প্রতি বছর ব্যবহার হচ্ছে পাঁচ লাখ কোটি পলিথিন। পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক বলে বিবেচনা করে প্রায় ২০ বছর আগে রফতানিমুখী শিল্প ছাড়া সব ধরনের পলিথিন ব্যাগ উৎপাদন, বাজারজাতকরণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। প্রাণ ও পরিবেশ বাঁচাতে শাস্তির বিধান রেখে আইন করা হয়। কিন্তু আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকায় পলিথিনের উৎপাদন ও বিক্রি থামানো যায়নি, কিছুদিন পর ফের বাজার ছেয়ে যায় পলিথিনে। পণ্য বহনে পরিবেশবান্ধব পাটজাত ব্যাগ ও কাগজের ব্যাগ ব্যবহার করার কথা থাকলেও আইন অমান্য করে নিষিদ্ধ পলিথিন ব্যাগ, উৎপাদন, মজুদ, বাজারজাত ও ব্যবহার করা হচ্ছে। রফতানিযোগ্য কিছু পণ্য, প্যাকেজিং, নার্সারির চারা, রেণু পোনা পরিবহন ও মাশরুম চাষের জন্য পলিথিন উৎপাদনের ছাড়পত্র নিয়ে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী পলিথিন ব্যাগ তৈরি করছে। আর ক্ষতিকর জানার পরও দিন দিন এই ব্যাগের ব্যবহার বেড়েই চলছে, যা পরিবেশকে ঠেলে দিচ্ছে হুমকির দিকে। এ বিষয়টি সবাই জানলেও কার্যত তেমন কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। ২০০২ সালে সরকার আইন করে পলিথিন উৎপাদন, বিপণন ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করে তা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ৬(ক) ধারাটি সংযোজন করা হয়। আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়, যদি কোন ব্যক্তি নিষিদ্ধ পলিথিন সামগ্রী উৎপাদন, আমদানি বা বাজারজাত করে তাহলে ১০ বছরের কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা, এমনকি উভয় দণ্ডও হতে পারে। ২০০২ সালে তৎকালীন সরকারের বন ও পরিবেশমন্ত্রী শাহজাহান সিরাজ পলিথিনের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে এর উৎপাদন ও বিপণন প্রায় বন্ধ হয়ে আসলেও এরপর ধীরে ধীরে আবারও পলিথিনের উৎপাদন ও এর ব্যবহার শুরু হয়। বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) দেয়া তথ্য অনুসারে বিশ্বের ৮৭টি দেশে একবার ব্যবহার উপযোগী পলিথিনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আছে। অনেক আইন করে পলিথিন ও প্লাস্টিক দ্রব্য নিষিদ্ধ করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে স্থলের পর এবার জল তথা সাগর-মহাসাগরকেও বিষিয়ে তোলা হচ্ছে বিষাক্ত পলিথিন ব্যবহার করে। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত কিংবা সেন্টমার্টিন সৈকতেও ফেলা হচ্ছে পলিথিনের ব্যাগ ও প্লাস্টিকের বোতল। পলিথিনের কারণে কৃষি জমির উর্বরতা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। মাটির অভ্যন্তরে চলে যাওয়ায় মাটিতে থাকা অণুজীবগুলোর স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। মাটির নিচে পানি চলাচলেও প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে। যে কারণে মাটির গুণগত মান ও উর্বরতা হ্রাস পাওয়ায় শস্যের উৎপাদন কমে যায়। মাটির নিচের পলিথিনের কারণে গাছ খাবার পায় না। এ কারণে গাছ কম অক্সিজেনের উৎপাদন করায় বাতাসে কার্বনডাই অক্সাইড, সীসা এসবের পরিমাণ বেড়ে যায় এবং অক্সিজেনের স্বল্পতার প্রভাবে মানুষের মধ্যে হাঁপানি কিংবা শ্বাসরোগ বেড়ে যায়। পরিবেশবিদদের মতে, ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহার হয় পলিথিন তৈরিতে। পলিথিন মাটির স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা কমিয়ে দেয়। পচনশীল না হওয়ায় বাধা সৃষ্টি করে সব ধরনের চাষাবাদে। আইন অমান্য করেই সারাদেশে পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম উপাদান পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার ফের ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। অভিযোগ রয়েছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঠিক নজরদারি না থাকায় প্রকাশ্যে বিক্রি ও ব্যবহার হচ্ছে এসব পলিথিন ব্যাগ। খুচরা বাজারই নয়, নিষিদ্ধ পলিথিনের রয়েছে পাইকারি বাজারেও। চকবাজার, মৌলভীবাজার ও কাওরান বাজারসহ বিভিন্ন বাজারে পাইকারি দরে তা বিক্র হচ্ছে দেদার। ঢাকার খালগুলো মরে যাওয়ার জন্যও অনেকাংশে দায়ী পলিথিন। পলিথিনের বহুবিধ ব্যবহারের কারণে মানবদেহে বাসা বাঁধছে ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ। ঢাকায় যে কয়টি পানি শোধনাগার রয়েছে সেগুলোও ঠিকমতো চালানো সম্ভব হয় না পরিত্যক্ত পলিব্যাগের কারণে। এ অবস্থার অবসানে পলিথিন বর্জ্যকে বিশেষ কৌশলে রিসাইক্লিং বা ডাম্পিং করা জরুরী।