০২:১০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ০৫ জুলাই ২০২৫, ২০ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ঈদুল আযহা ও কুরবানির শিক্ষা

  • প্রকাশিত ০৫:০২:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫
  • ১১৭ বার দেখা হয়েছে

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের : ঈদুল আযহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি। যা জিলহজ্ব মাসে পালন করা হয়। এ মাসেই মুসলমানরা পবিত্র হজ্বও পালন করে থাকেন। ঈদের পরিসীমা যার কাছে যাই হোকনা কেন অন্তত ঈদের দিনটি ধনী-গরীব সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে
মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরীব, উচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাড় করায় ঈদ।

ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী সৌন্দর্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ
আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবানী সকলের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় “সকলের তরে সকলে আমরা” এ
মর্মবানী সকল অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরনা জোগায়। এ প্রেরনায়
উদ্দীপ্ত সমাজের হত দরিদ্র অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মুসলমান
হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব। জিলহজ্ব মাস হজেরও মাস, পবিত্র জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ
পর্যন্ত সময়ে সামর্থ্যবান মুসলমানরা হজব্রত পালন করে থাকেন।

হজ্ব একান্তই একটি ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই হজব্রত পালন করা হয়। ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিক নির্ভর ধর্ম নয়, কর্ম নির্ভর ধর্ম। যার কর্ম শুদ্ধ নয়, তার ধর্মও শুদ্ধ নয়। ঈমান পাকাপোক্ত হয় সৎকর্মের মাধ্যমে। সৎকর্মে যারা আজীবন নিবিষ্ট থাকে তারাই সৃষ্টির সেরা। (সুরা বাইয়্যেনাহ ৭)। প্রবৃত্তির দাস কখনও আল্লাহ্র দাসে পরিণত হতে পারে না। ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়ে মানবতার সেবা এমনভাবে করতে হবে যেভাবে আল্লাহ্ আমাদের অনুগ্রহ করেন। (কাসাস ৭৭)। শেখ সাদী (রঃ) বলেন, “তব তসবিহ এবং সিজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবে না, মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না”। হজ ফরজ হওয়ার মূলে অপরিসীম আধ্যাত্মিক ও জাগতিক গুরুত্ব নিহিত রয়েছে যা অনুধাবন ছাড়া হজ করতে যাওয়া নিছক আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পবিত্র কোরআনে এর মূল্যবোধের বিষয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমের দিকে মুখ ফেরানোর মধ্যে নেই কোনো কল্যাণ, কল্যাণ নিহিত রয়েছে যে ঈমান আনে আল্লাহ্র উপর, পরকালে,
ফেরেশতাগণ, সব কিতাবে, নবীদের ওপর এবং আল্লাহ্র মহব্বতে দান খয়রাত করে প্রতিবেশীদের জন্য,
এতিম, মিশকিন, মুসাফির ও ইবাদতকারীদের জন্য গোলামমুক্ত করার জন্য এবং সালাত কায়েম করে, জাকাত
প্রদান করে, অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করে, ধৈর্য্যধারণ করে বিপদের সময়, দুঃখ কষ্ট ও যুদ্ধের সময়, তারাই
সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই প্রকৃত মুত্তাকি। (সুরা বাকারা ১৭৭)। পবিত্র এ আয়াতের মাধ্যমে এ
কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আনুষঙ্গিক অন্য দায়িত্ব তথা হক্কুল ইবাদ বা আর্তমানবতার প্রতি অর্পিত
দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন ব্যতিরেকে শুধু কেবালামুখী হয়ে, আনুষ্ঠানিক ইবাদতে কোনো কল্যাণ নেই। হক্কুল
ইবাদ তথা মানবতার হক আদায় ব্যতিত হক্কুুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র হক আদায় হয় না। ত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর
পবিত্র ঈদুল আযহা বছর ঘুরে আবার এলো মুসলমানদের জীবনে। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয় কারও সঙ্গে কারও
ভেদাভেদ নয়। ত্যাগের মহিমায় ক্ষুদ্রতা ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের সুযোগ করে দেয় ঈদুল আযহা। আমাদের
উচিত ঈদুল আযহার ত্যাগের মহিমা, ত্যাগের আদর্শ অনুসরণ করা, উপলব্ধি করা। ঈদের শিক্ষা হলো মানুষ
মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মানুষ মানুষকে বুকে টেনে নেবে।

ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারেন
একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আযহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস
উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব। ঈদুল আযহা কোরবানি বা ত্যাগের ঈদ।

কোরবানী মানে শুধু পশুহত্যা নয় মনের পশু হত্যা করার দিন। চার হাজার বছরেরও বেশী আগে হযরত ইব্রাহীম
(আঃ) মহান আল্লাহ্ -তায়ালার নির্দেশে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস অর্থাৎ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)
কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহ্-তায়ালার অপার কুদরত ও মহিমায় হযরত ইসমাইল
(আঃ) এর পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই থেকেই চালু হয় কোরবানিতে পশু জবাই করার বিধান।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করে মুসলমানরা ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহ্র অনুগ্রহ
কামনা করে পশু কোরবানি করেন। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি করা ফরজ। ঈদের পরের দুই
দিনও পশু কোরবানি করা যায়। ঈদ নামায শেষে করতে হয়। কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ
নিজের জন্যে, আত্মীয় স্বজনদের জন্যে এক ভ্াগ এবং গরীব মানুষদের মধ্যে একভাগ বন্টন করে দেয়া উত্তম।
ইসলাম শব্দের অর্থের সাথে কোরবানির এক অভিন্ন মিল খুজে পাওয়া যায়। ইসলাম অর্থই হচেছ আত্মসমর্পন
এবং আত্মসমর্পন এর অর্থ হচ্ছে আত্মবিসর্জন, আর আত্মবিসর্জন মানেই কোরবানি। রাসুল (আঃ) এরশাদ
করেছেন যে ব্যক্তির কুরবানি করার সামর্থ আছে আর সেই ব্যক্তি যদি কোরবানি না করে সে যেন ঈদগাহে না
আসে। সামর্থবান মানে যিনি নিছাব পরিমান সম্পদের মালিক হবেন তার উপর কোরবানি করা বাধ্যতামূলক বা
ওয়াজিব। কোরবানির গুরুত্ব বিষয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত হাদিসে রয়েছে হযরত রাসুল (সাঃ)
এরশাদ করেন ‘কোরবানির দিনে কোরবানির চেয়ে কোন আমল আল্লাহ্-তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় নয়।
কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশুর শিং, লোম ও পায়ের খুর সব কিছু নিয়েই আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে।

কোরবানিকৃত পশুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মহান আল্লাহ্-তায়ালার কাছে তা বিশেষ মর্যাদায় পৌছে
যায়। সুতরাং তোমরা স্বাচ্ছন্দে কোরবানি কর’। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে কোরবানিকৃত পশুর গোশত
এবং রক্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌছায় না বরং পৌছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া (সুরাঃ হজ্ব-৩৭) অন্য
আয়াতে এরশাদ হয়েছে আল্লাহর তো কেবল মুক্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন। সুরা কাওসার এর ২নং
আয়াতে এরশাদ হয়েছে অতএব তোমার মালিককে স্মরণ করার জন্য তুমি নামাজ পড় এবং (তারই উদ্দেশ্যে)
তুমি কোরবানি করো। কোরবানির ইতিহাস অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। হযরত ইসমাইল (আঃ) যখন তরুণ বয়সের
আল্লাহ্ পাক ইব্রাহীম (আঃ) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন হে ইব্রাহীম আমি আল্লাহর ভালবাসায় তোমার ইসমাইলকে
কোরবানি কর। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছেলে ইসমাইল (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন হে প্রিয় ছেলে আল্লাহ্
আমাকে স্বপ্নযোগে নির্দেশ দিলেন আল্লাহ্কে ভালবেসে তোমাকে জবাই করে কোরবানি করে দিতে। এবার তুমি
এ ব্যাপারে তোমার মতামত জানাও। ছেলে ইসমাইল বলেন আমি জবাই হলে যদি আল্লাহ্ রাজি ও খুশী হয়ে
যান তাহলে হাসিমুখে আল্লাহ্্র পথে জবাই হতে রাজি আছি। পিতা যখন পুত্রকে জবাই করার জন্য শুয়ালেন
তখন আল্লাহ্ -তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষনা এলো আমি তোমার ছেলের রক্ত, গোশত চাইনা, আমি যা চেয়েছি তা
পেয়েছি এখন অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে তুমি কোরবানি করো। আল্লাহ্্-তায়ালার দুম্বা পাঠালেন এবং ইব্রাহীম
(আঃ) অনুষ্টান পালনের কোরবানি করলেন। কাজেই কোরবানি কোন অনুষ্টান নয়, কোরবানি হলো পশুর সঙ্গে
পশুত্ব কোরবানির নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে অনেকে অনেক মানসিকতায় কোরবানি
করেন যা সহজেই দৃশ্যমান হয়। কেউ কেউ লোক লজ্জায় নিজে কোরবানি না দিলে সন্তানরা গোশত পাবে

কোথায়, আশপাশের অনেকেই কোরবানি দিচ্ছে আমি না দেই কিভাবে- এ ধরনের মানসিকতায়ও কোরবানি
করেন। এ ধরনের কোরবানি আল্লাহ্্্ তায়ালার দরবারে নাও পৌঁছাতে পারে। তাছাড়া অনেক বিত্ত বৈভবের
মালিকগণকে কত দামের কোরবানি করবেন সে প্রতিযোগিতায় শামিল হতে দেখা যায়। তাদের কাছে কোরবানি
লৌকিক প্রথা হয়ে গেছে। লক্ষাধিক টাকায় গরু বা উঠ কিনে বাসার গেটের সামনে বেধে রেখে নিজ এলাকায়
খ্যাতি অর্জনই অনেকের কোরবানির উদ্দেশ্য বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। এ ধরনের কোরবানি দ্বারা আত্মত্যাগ
হয়না। ঈদুল আযহার দিনে পশু কোরবনির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জল হউক আমাদের জীবন তা না
হলে সামর্থ্যবান মুসলমানদের কোরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না। কোরবানীর মূল তাৎপর্য হলো
আল্লাহর আনুগত্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। কোরবানী শুধুমাত্র একটি ইবাদতই নয় বরং কোরবানীর মধ্যে
রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের এক মহান দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ্ আমাদের সত্যিকারের কোরবানি করার
তৌফিক দান করুণ। আমরা যেন ভুলে না যাই ঈদের চেতনাই হলো মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন জোরদার
করা। সেজন্য আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে।

সব মানুষের জন্য একটা সুন্দর, বাসযোগ্য, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এমন একটা সুন্দর ব্যবস্থাপনার
পৃথিবী হবে যেখানে কোন মানুষই আক্রান্ত হবে না, কোন মানুষ মানবাধিকার বঞ্চিত হবে না, হিংসা বিদ্বেষের
শিকার হবে না। এমন এক সুন্দর পৃথিবীর জন্যই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সকলের দোয়া করা উচিত।
লেখক
আইনজীবী, কলামিস্ট ও গবেষক
সহযোগী সম্পাদক- দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা

Tag :
জনপ্রিয়

তেজগাঁও ২৬ নাম্বার ওয়ার্ডের কমিশনার পদপ্রার্থী ল্যাব এইডে দেখতে যান মোঃ বেলায়েত হোসেন কে

ঈদুল আযহা ও কুরবানির শিক্ষা

প্রকাশিত ০৫:০২:৪৮ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৬ মে ২০২৫

ড. মোহাম্মদ আবু তাহের : ঈদুল আযহা মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি। যা জিলহজ্ব মাসে পালন করা হয়। এ মাসেই মুসলমানরা পবিত্র হজ্বও পালন করে থাকেন। ঈদের পরিসীমা যার কাছে যাই হোকনা কেন অন্তত ঈদের দিনটি ধনী-গরীব সবার কাছেই অত্যন্ত আনন্দের। ঈদ সমাজের সব ভেদাভেদ ও সীমানা মুছে দিয়ে
মানুষে মানুষে মহামিলন ঘটায়। ধনী-গরীব, উচু-নিচু নির্বিশেষে সব মানুষকে এক কাতারে দাড় করায় ঈদ।

ঈদের দিনে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী সৌন্দর্যের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে আনন্দকে একত্রে উপভোগ করেন। ঈদ
আনন্দের মধ্যে দিয়ে এক গুরুত্বপূর্ণ মর্মবানী সকলের কাছে প্রতিধ্বনিত হয় “সকলের তরে সকলে আমরা” এ
মর্মবানী সকল অন্যায় অবিচার ও অসাম্যকে অতিক্রম করে এক ভ্রাতৃত্ববোধের প্রেরনা জোগায়। এ প্রেরনায়
উদ্দীপ্ত সমাজের হত দরিদ্র অবহেলিত ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়া মুসলমান
হিসাবে আমাদের সকলের দায়িত্ব। জিলহজ্ব মাস হজেরও মাস, পবিত্র জিলহজ্ব মাসের ৮ থেকে ১৩ তারিখ
পর্যন্ত সময়ে সামর্থ্যবান মুসলমানরা হজব্রত পালন করে থাকেন।

হজ্ব একান্তই একটি ব্যক্তিগত আমল। ব্যক্তিগত জীবনে আল্লাহ্ তা’আলার নৈকট্য লাভ ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই হজব্রত পালন করা হয়। ইসলাম শুধু আনুষ্ঠানিক নির্ভর ধর্ম নয়, কর্ম নির্ভর ধর্ম। যার কর্ম শুদ্ধ নয়, তার ধর্মও শুদ্ধ নয়। ঈমান পাকাপোক্ত হয় সৎকর্মের মাধ্যমে। সৎকর্মে যারা আজীবন নিবিষ্ট থাকে তারাই সৃষ্টির সেরা। (সুরা বাইয়্যেনাহ ৭)। প্রবৃত্তির দাস কখনও আল্লাহ্র দাসে পরিণত হতে পারে না। ষড়রিপুর প্রভাবমুক্ত হয়ে মানবতার সেবা এমনভাবে করতে হবে যেভাবে আল্লাহ্ আমাদের অনুগ্রহ করেন। (কাসাস ৭৭)। শেখ সাদী (রঃ) বলেন, “তব তসবিহ এবং সিজদা দেখে খোদ এলাহী ভুলবে না, মানবসেবার কুঞ্জি ছাড়া স্বর্গ দুয়ার খুলবে না”। হজ ফরজ হওয়ার মূলে অপরিসীম আধ্যাত্মিক ও জাগতিক গুরুত্ব নিহিত রয়েছে যা অনুধাবন ছাড়া হজ করতে যাওয়া নিছক আনুষ্ঠানিকতা ভিন্ন অন্য কিছু নয়। পবিত্র কোরআনে এর মূল্যবোধের বিষয়ে স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। পূর্ব ও পশ্চিমের দিকে মুখ ফেরানোর মধ্যে নেই কোনো কল্যাণ, কল্যাণ নিহিত রয়েছে যে ঈমান আনে আল্লাহ্র উপর, পরকালে,
ফেরেশতাগণ, সব কিতাবে, নবীদের ওপর এবং আল্লাহ্র মহব্বতে দান খয়রাত করে প্রতিবেশীদের জন্য,
এতিম, মিশকিন, মুসাফির ও ইবাদতকারীদের জন্য গোলামমুক্ত করার জন্য এবং সালাত কায়েম করে, জাকাত
প্রদান করে, অঙ্গীকার করে তা রক্ষা করে, ধৈর্য্যধারণ করে বিপদের সময়, দুঃখ কষ্ট ও যুদ্ধের সময়, তারাই
সত্য পথের ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং তারাই প্রকৃত মুত্তাকি। (সুরা বাকারা ১৭৭)। পবিত্র এ আয়াতের মাধ্যমে এ
কথা স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, আনুষঙ্গিক অন্য দায়িত্ব তথা হক্কুল ইবাদ বা আর্তমানবতার প্রতি অর্পিত
দায়িত্বগুলো যথাযথ পালন ব্যতিরেকে শুধু কেবালামুখী হয়ে, আনুষ্ঠানিক ইবাদতে কোনো কল্যাণ নেই। হক্কুল
ইবাদ তথা মানবতার হক আদায় ব্যতিত হক্কুুল্লাহ্ বা আল্লাহ্র হক আদায় হয় না। ত্যাগের মহিমায় চিরভাস্বর
পবিত্র ঈদুল আযহা বছর ঘুরে আবার এলো মুসলমানদের জীবনে। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয় কারও সঙ্গে কারও
ভেদাভেদ নয়। ত্যাগের মহিমায় ক্ষুদ্রতা ভুলে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের সুযোগ করে দেয় ঈদুল আযহা। আমাদের
উচিত ঈদুল আযহার ত্যাগের মহিমা, ত্যাগের আদর্শ অনুসরণ করা, উপলব্ধি করা। ঈদের শিক্ষা হলো মানুষ
মানুষের পাশে দাঁড়াবে, মানুষ মানুষকে বুকে টেনে নেবে।

ঈদ মুসলমানদের একান্ত নিজস্ব সংস্কৃতিরই একটা অংশ। ঈদের আনন্দ অন্তর থেকে উপলদ্ধি করতে পারেন
একমাত্র মুসলমানরাই। ঈদুল আযহায় আল্লাহ্-তায়ালার প্রতি হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সবচেয়ে প্রিয় জিনিস
উৎসর্গ করার যে আনন্দ তাও মুসলমানদেরই একান্ত ও নিজস্ব। ঈদুল আযহা কোরবানি বা ত্যাগের ঈদ।

কোরবানী মানে শুধু পশুহত্যা নয় মনের পশু হত্যা করার দিন। চার হাজার বছরেরও বেশী আগে হযরত ইব্রাহীম
(আঃ) মহান আল্লাহ্ -তায়ালার নির্দেশে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিস অর্থাৎ প্রিয় পুত্র হযরত ইসমাইল (আঃ)
কে কোরবানি করতে উদ্যত হন। কিন্তু মহান আল্লাহ্-তায়ালার অপার কুদরত ও মহিমায় হযরত ইসমাইল
(আঃ) এর পরিবর্তে দুম্বা কোরবানি হয়ে যায়। সেই থেকেই চালু হয় কোরবানিতে পশু জবাই করার বিধান।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর সেই ত্যাগের মহিমা স্মরণ করে মুসলমানরা ঈদুল আযহার দিনে আল্লাহ্র অনুগ্রহ
কামনা করে পশু কোরবানি করেন। সামর্থ্যবান মুসলমানদের জন্য কোরবানি করা ফরজ। ঈদের পরের দুই
দিনও পশু কোরবানি করা যায়। ঈদ নামায শেষে করতে হয়। কোরবানির মাংস তিন ভাগে ভাগ করে একভাগ
নিজের জন্যে, আত্মীয় স্বজনদের জন্যে এক ভ্াগ এবং গরীব মানুষদের মধ্যে একভাগ বন্টন করে দেয়া উত্তম।
ইসলাম শব্দের অর্থের সাথে কোরবানির এক অভিন্ন মিল খুজে পাওয়া যায়। ইসলাম অর্থই হচেছ আত্মসমর্পন
এবং আত্মসমর্পন এর অর্থ হচ্ছে আত্মবিসর্জন, আর আত্মবিসর্জন মানেই কোরবানি। রাসুল (আঃ) এরশাদ
করেছেন যে ব্যক্তির কুরবানি করার সামর্থ আছে আর সেই ব্যক্তি যদি কোরবানি না করে সে যেন ঈদগাহে না
আসে। সামর্থবান মানে যিনি নিছাব পরিমান সম্পদের মালিক হবেন তার উপর কোরবানি করা বাধ্যতামূলক বা
ওয়াজিব। কোরবানির গুরুত্ব বিষয়ে হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্নিত হাদিসে রয়েছে হযরত রাসুল (সাঃ)
এরশাদ করেন ‘কোরবানির দিনে কোরবানির চেয়ে কোন আমল আল্লাহ্-তায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় নয়।
কিয়ামত দিবসে কোরবানির পশুর শিং, লোম ও পায়ের খুর সব কিছু নিয়েই আল্লাহ্র দরবারে হাজির হবে।

কোরবানিকৃত পশুর রক্ত মাটিতে গড়িয়ে পড়ার আগেই মহান আল্লাহ্-তায়ালার কাছে তা বিশেষ মর্যাদায় পৌছে
যায়। সুতরাং তোমরা স্বাচ্ছন্দে কোরবানি কর’। পবিত্র কোরআনে এরশাদ হয়েছে কোরবানিকৃত পশুর গোশত
এবং রক্ত কিছুই আল্লাহর কাছে পৌছায় না বরং পৌছায় কেবল তোমাদের তাকওয়া (সুরাঃ হজ্ব-৩৭) অন্য
আয়াতে এরশাদ হয়েছে আল্লাহর তো কেবল মুক্তাকিদের কোরবানিই কবুল করেন। সুরা কাওসার এর ২নং
আয়াতে এরশাদ হয়েছে অতএব তোমার মালিককে স্মরণ করার জন্য তুমি নামাজ পড় এবং (তারই উদ্দেশ্যে)
তুমি কোরবানি করো। কোরবানির ইতিহাস অত্যন্ত হৃদয় বিদারক। হযরত ইসমাইল (আঃ) যখন তরুণ বয়সের
আল্লাহ্ পাক ইব্রাহীম (আঃ) কে নির্দেশ দিয়েছিলেন হে ইব্রাহীম আমি আল্লাহর ভালবাসায় তোমার ইসমাইলকে
কোরবানি কর। হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ছেলে ইসমাইল (আঃ) কে জিজ্ঞাসা করলেন হে প্রিয় ছেলে আল্লাহ্
আমাকে স্বপ্নযোগে নির্দেশ দিলেন আল্লাহ্কে ভালবেসে তোমাকে জবাই করে কোরবানি করে দিতে। এবার তুমি
এ ব্যাপারে তোমার মতামত জানাও। ছেলে ইসমাইল বলেন আমি জবাই হলে যদি আল্লাহ্ রাজি ও খুশী হয়ে
যান তাহলে হাসিমুখে আল্লাহ্্র পথে জবাই হতে রাজি আছি। পিতা যখন পুত্রকে জবাই করার জন্য শুয়ালেন
তখন আল্লাহ্ -তায়ালার পক্ষ থেকে ঘোষনা এলো আমি তোমার ছেলের রক্ত, গোশত চাইনা, আমি যা চেয়েছি তা
পেয়েছি এখন অনুষ্ঠান পালনের মাধ্যমে তুমি কোরবানি করো। আল্লাহ্্-তায়ালার দুম্বা পাঠালেন এবং ইব্রাহীম
(আঃ) অনুষ্টান পালনের কোরবানি করলেন। কাজেই কোরবানি কোন অনুষ্টান নয়, কোরবানি হলো পশুর সঙ্গে
পশুত্ব কোরবানির নাম। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য আমাদের সমাজে অনেকে অনেক মানসিকতায় কোরবানি
করেন যা সহজেই দৃশ্যমান হয়। কেউ কেউ লোক লজ্জায় নিজে কোরবানি না দিলে সন্তানরা গোশত পাবে

কোথায়, আশপাশের অনেকেই কোরবানি দিচ্ছে আমি না দেই কিভাবে- এ ধরনের মানসিকতায়ও কোরবানি
করেন। এ ধরনের কোরবানি আল্লাহ্্্ তায়ালার দরবারে নাও পৌঁছাতে পারে। তাছাড়া অনেক বিত্ত বৈভবের
মালিকগণকে কত দামের কোরবানি করবেন সে প্রতিযোগিতায় শামিল হতে দেখা যায়। তাদের কাছে কোরবানি
লৌকিক প্রথা হয়ে গেছে। লক্ষাধিক টাকায় গরু বা উঠ কিনে বাসার গেটের সামনে বেধে রেখে নিজ এলাকায়
খ্যাতি অর্জনই অনেকের কোরবানির উদ্দেশ্য বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়। এ ধরনের কোরবানি দ্বারা আত্মত্যাগ
হয়না। ঈদুল আযহার দিনে পশু কোরবনির মাধ্যমে প্রকৃত ত্যাগের মহিমায় উজ্জল হউক আমাদের জীবন তা না
হলে সামর্থ্যবান মুসলমানদের কোরবানি কোনো সার্থকতা বয়ে আনবে না। কোরবানীর মূল তাৎপর্য হলো
আল্লাহর আনুগত্য এবং তার সন্তুষ্টি অর্জন। কোরবানী শুধুমাত্র একটি ইবাদতই নয় বরং কোরবানীর মধ্যে
রয়েছে ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের এক মহান দৃষ্টান্ত। মহান আল্লাহ্ আমাদের সত্যিকারের কোরবানি করার
তৌফিক দান করুণ। আমরা যেন ভুলে না যাই ঈদের চেতনাই হলো মানুষে মানুষে ভালোবাসার বন্ধন জোরদার
করা। সেজন্য আমাদেরকে সবসময় সচেতন থাকতে হবে।

সব মানুষের জন্য একটা সুন্দর, বাসযোগ্য, মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এমন একটা সুন্দর ব্যবস্থাপনার
পৃথিবী হবে যেখানে কোন মানুষই আক্রান্ত হবে না, কোন মানুষ মানবাধিকার বঞ্চিত হবে না, হিংসা বিদ্বেষের
শিকার হবে না। এমন এক সুন্দর পৃথিবীর জন্যই মহান আল্লাহতায়ালার কাছে সকলের দোয়া করা উচিত।
লেখক
আইনজীবী, কলামিস্ট ও গবেষক
সহযোগী সম্পাদক- দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা