সাগর-পাহাড়ের বেষ্টনীঘেরা প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্যের আধার বাঁশখালী এক বিচিত্র জনপদ। প্রাকৃতিক সম্পদে ঐশ্চর্যপূর্ণ হওয়ার সত্ত্বেও এ জনপদ নানাভাবে অবহেলিত ও বঞ্জিত। অনেক ক্ষণজন্মা গুণীজনের আবির্ভাব ঘটেছে এ জনপদে। যাদের ত্যাগ,কৃতিত্ব,কর্ম ও অর্জনে বাঁশখালী পরিচিত হয়েছে দেশের সীমা পেরিয়ে বিশ্বজুড়ে।
সেসব মহাপুরুষদের মধ্য উল্লেখযোগ্য হলো –
আন্তর্জার্তিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ড.আব্দুল করিম (ইতিহাসবিদ, শিক্ষাবিদ ও সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়)
অধ্যাপক আসহাব উদ্দীন আহমদ (রাজনীতিবিদ ও ক্ষুরধার লেখক)
অধ্যক্ষ যোগেশ চন্দ্র সিংহ (রবীন্দ্র ধ্যানী কবি)
ইউ.এন সিদ্দিকী (
শাহ মুহাম্মদ বদিউল আলম(সুফিসাধক ও বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের অগ্রসৈনিক)
নভেরা আহমেদ(ভাস্কার্য শিল্পী) প্রমূখ।
বাঁশখালীর ইতিহাস পর্যালোচনা করলে সর্বপ্রথম জ্ঞানতাপস ড. আব্দুল করিমের কৃতিত্বকে স্বীকার করতে হবে।
তিনি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইতিহাসবিদ ও একুশে পদক প্রাপ্ত মনীষী, প্রফেসর ইমিরেটাস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি, ইতিহাস ও বিভিন্ন বিষয়ে লিখিত বহু গ্রন্থের রচিয়তা।
এ মহান জ্ঞাননসাধক শুধু বাঁশখালী চট্টগ্রামের মুখ উজ্জ্বল করেননি, তিনি বাংলাদেশ তথা এশিয়ার একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি এশিয়ার একজন খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, প্রথিতযশা শিক্ষাবিদ, উচ্চমান গবেষক, চিন্তাবিদ ও সমাজহিতৈষী।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এশিয়ায় যেসব মনীষী, পন্ডিত, প্রত্নবিদ, ইতিহাসবিদ ইতিহাস রচনা ও গবেষণার অনন্য স্বাক্ষর রেখেছেন নিঃসন্দেহে তাদের মধ্য ড.আব্দুল করিমের নাম পরিধানযোগ্য।
ড.আব্দুল করিমের বাংলা, সংস্কৃত, উর্দ্দু, ফার্সি, ইংরেজি, আরবীসহ বিভিন্ন ভাষায় পান্ডিত্য ছিলো।
যার কারণে বিভিন্ন ভাষায় লিখিত বইয়ের সূত্র ধরে সঠিক ইতিহাস উদঘটন করেন। তাঁর মধ্য ছিল গভীর অনুরাগ ও প্রবল অনুসন্ধিৎসা, মেধা ও মনন,সৃজনশীলতা, নিরলস প্রচেস্টা, শরিশ্রম, সততা, অধ্যবসায় ও অনুশীলন। যার কারণে তিনি জটিল, কঠিন ও দূর্ভেদ্য বিষয়ের ইতিহাস ও ঐতিহ্য বের করার চেষ্টা করতেন। তিনি শিলালিপি, মুদ্রা,, মাটি, স্হাপনা, ইমারাত, ভাস্কার্য ইত্যাদি গবেষণা করে তাঁর লেখা গ্রন্থগুলোকে তথ্যবহুল ও নির্ভরযোগ্য করে তুলেন। নতুন নতুন ইতিহাসের ক্ষেত্র উম্মোচন করে তিনি একজন সত্যানুসন্ধানী লেখক হিসেবে দেশ-বিদেশে খ্যাতি অর্জন করেন।
খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ড.আব্দুল করিম চট্টগ্রামের বাঁশখালী থানার বাহারছড়ার চাপাছড়ি গ্রামে ০১ জুন ১৯২৮ সালে (শিক্ষাসনদ অনুসারে) ধার্মিক মুসলিম পরিবারে সৈয়দ বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
সৈয়দ ওয়াইজ উদ্দিন তাঁর পিতা। তিনি মৌলভী ছিলেন। তারঁ মহিয়সী মাতা ছিলেন রশিদা বেগম। তিনি ধার্মিক এবং দানশীল মহিলা ছিলেন।
তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার ছোট।
জীবনের প্রথম পাঠ শেখেন তৎকালীন ভারতের বিখ্যাত সাহারানপুর মাদরাসা হতে উচ্চ শিক্ষা লাভ করা মৌলভী মনিরুজ্জমান চৌধুরী থেকে। মুনিরুজ্জান চৌধুরী পাঠের শুরুতে “বিসমিল্লাহ্ “, “ইকরা বিসমিকা ” বলেই পাঠদান শুরু করে শিশু আব্দুল করিমকে। সেই মানুষটি একদিন জগদ্বিখ্যাত হয়ে উঠে।
তিনি স্হানীয় চাপাছড়ি ও বাহারছড়া হতে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। পরে বাঁশখালীর বৈলছড়ি মাদরাসায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশুনা করেন।
এরপর চট্টগ্রাম শহরে চলে আসেন।
১৯৪০ সালে চট্টগ্রামের বুড়া মাদরাসায় সপ্তম (ইসলামিক ইন্টারমেডিয়েট কলেজ/মোহসেনিয়া মাদরাসা) শ্রেণিতে ভর্তি হন।
১৯৪৪ খ্রিঃ চট্টগ্রাম ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষা এবং ১৯৪৬ সালে আই.এ পাশ করেন। পরে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৪৯ সালে ইতিহাসে বি.এ(অনার্স), এবং ১৯৫০ সালে এম.এ ডিগ্রিতে প্রথম শ্রেণাতে প্রথম হয়ে পাশ করেন। প্রতিটি শিক্ষাস্তরে
রেখেছেন অনন্য প্রতিভার স্বাক্ষর। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। এর আগে তিনি নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জের ভিক্টোরিয়া হাই স্কুলে শিক্ষকতা করেন।নারায়নগঞ্জের ঈসা খানের স্মৃতি বিজড়িত সোনারগাঁও এর প্রতিটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঘুরে ঘুরে দেখেন এবং ইতিহাসের উপাদান সংগ্রহ করেন। সেখান থেকেই তাঁর ইতিহাস চর্চার অনুপ্রেরণা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানেরর পর একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ আব্দুল হালিমের সাথে ইতিহাসচর্চায় আত্মনিয়োগ করেন।
প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ আব্দুল হালিম এবং উদয়মান অধ্যাপক আব্দুল করিম বিশিষ্ট প্রত্নবিদ ও ইতিহাসবিদ আহমদ হাসান দানীর তত্ত্ববাধে গবেষণা শুরু করেন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে “Social History of the Muslims in Bengal (A.D:1538) বিষয়ে প্রথম পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
পরে তা পাকিস্হান এশিয়াটিক সোসাইটি বর্তমান বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি গ্রন্থকারে প্রকাশ করে।
ড. আব্দুল করিম কমনওয়েলথ (Commonwealth) এর বৃত্তি নিয়ে উচ্চ শিক্ষা ও গবেষণার জন্য ইংল্যান্ডে গমন করেন। ২৯৬০-৬২ সাল পযর্ন্ত ড.আব্দুল করিম লন্ডনে অবস্হান করেন। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের “School of Oriental and African Studies ” বিভাগ হতে “Murshid Quli Khan His Times ” শিরোনামে অভিসর্ন্দভ রচনা করে ড.জে.বি হ্যারিসনের তত্ত্বধানে দ্বিতীয় বার পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
ইতিহাস বিষয়ে দুইবার পিএইচডি অর্জন আর নেই। ড.করিম লন্ডনে লোভনীয় সুযোগ পাওয়ার পরও দেশ মাতৃকার টানে দেশে ফিরে আসেন।
১৯৬৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববাদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য ড.এ.আর মল্লিক (আজিজুর রহমান মল্লিক)বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্নে যে ৭ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করেন তাদের মধ্যে অন্যতম ড.আব্দুল করিম। পরবর্তীতে তিনি বিশ্ববাদ্যালয়ে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করে শিক্ষা ও অবকাঠামোর উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করে তিনি ইতিহাস বিভাগের রীড়ার ও বিভাগীয় প্রধান পদে অাসীন হন।
১৯৬৬-৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি আলাওল হলের প্রভোষ্ট, ১৯৬৬-৭০ সাল পর্যন্ত কলা অনুষদের ডিন, ১৯৭০-৭৫ সাল পযর্ন্ত সিনেট সদস্য হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
বনাঢ্য কর্মজীবনে ড.আব্দুল করিম ১৯৭৫-১৯৮১ সাল পযর্ন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যের গুরুদায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৪ সালে তিনি চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। ১৯৭৩-১৯৭৭ সাল পযর্ন্ত বাংলাদেশ ইতিহাস সমিতির প্রতিষ্ঠা সভাপতি ছিলেন।
পরে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্সিটিউট অব বাংলাদেশ স্টাডিজ -এ সিনিয়র ফলো হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯২-১৯৯৬ সাল পযর্ন্ত ড.আব্দুল করিম “সুপারনিউমারাবি প্রফেসর “হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৯৫ সালে স্পিরিচ্যূয়াল ইউনিভার্সিটি নিউইয়র্ক এর ভিজিটিং প্রফেসর হন(অনারারী)
বিশ্ব বরণ্য ইতিহাসবিদ ড.আব্দুল করিম শিক্ষা ও গবেষণা ছাড়াও বিভিন্ন সংগঠন ও সমাজ সেবার সাথে নানাভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত ৪ বছর তিনি বায়তুশশরফ ইসলামী গবেষণা কেন্দ্রের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ সেমিনার -সিম্পেজিয়ামের প্রধান সঞ্চালক ছিলেন। ১৯৮৫ সালের ১৫,১৬ ও ১৭ অক্টোবর “বাংলাদেশে ইসলাম “শীর্ষক তিন ব্যাপী জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিলো। সেখানে তাঁর সহযোগিতায় ঢাকা, চট্টগ্রাম,রাজশাহী, খুলনা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের খ্যাতিমান ১৮ জন গবেষক তাদের জ্ঞানগর্ভ প্রবন্ধ উপস্হাপন করেন।তিনি বায়তুশশরফ ইসলামী গবেষণা প্রতিষ্ঠান হতে গবেষণাধর্মী জার্নাল “ইসলামি ঐতিহ্য ” প্রকাশ করেন।
বায়তুশশরফের বিখ্যাত পীর মরহুম মাওলানা আব্দুল জাব্বার (রঃ) সাথে ড. করিমের শ্রদ্ধামিশ্রিত মধুর সম্পর্ক ছিলো।
প্রখ্যাত জ্ঞানসাধক ড.আব্দুল করিম ৪০ টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। বাংলা ভাষায় তাঁর গবেষণাধর্মী গ্রন্থের সংখ্যা বেশি।আর ইংরেজিতে প্রকাশিত প্রবন্ধের সংখ্যা ১০ টির বেশি। প্রবন্ধের সংখ্যা সীমাহীন। তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্য বাংলাভাষার ৭৫ টি এবং ইংরেজি ভাষায় ৮১ টি। তাঁর অপ্রকাশিত এবং গবেষণাধর্মী নয় এমন প্রবন্ধ যা পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে এমন বিপুল সংখ্যক প্রবন্ধের সংখ্যা নির্ণয় করা যায়নি।
মূলতঃ ড.আব্দুল করিমের গ্রন্থগুলো ইতিহাস, ঐতিহ্য, সভ্যতা, সংস্কৃতি,ধর্ম ও সুফিসাধক, জীবনী ও জ্বানচর্চা বিষয়ক। তাঁর অমর গ্রন্থগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো-
১. বাংলার ইতিহাস(১২০০-১২৫৭)প্রথম খন্ড
২.বাংলার ইতিহাস(মোঘল আমল) দ্বিতীয় খন্ড -১৯৯২
৩.ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন -১৯৬৯
৪.শরীয়তনামা, নসরুল্লাহ খোন্দকার রচিত- ১৯৭৫
৫.সমাজ ও জীবন,প্রথম খন্ড -২০০৩
৬.সমাজ ও জীবন দ্বিতীয় খন্ড-২০০৮
৭.Agonies of Victimized Baby
৮.Morshidkuli Khan His Times-1963
৯.Corpous of the Muslim Coins of Bengal -1960
১০.বাংলা সাহিত্যের কালক্রম মধ্যযুগ -১৯৯৪
১১.বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য -১৯৯৭
১২.আব্দুল করিম সাহিত্যেবিশারদ:কর্ম ও জীবন
১৩.আব্দুল চৌধুরী ও তাঁর গবেষণা কর্ম-১৯৯৭
১৪.মোঘল রাজধানী ঢাকা
১৫.বাংলার মুসলমানদের সামাজিক ইতিহাস -১৯৫৯
১৬.মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য
১৭.ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন
১৮.চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য -১৯৭০
১৯.ঢাকাই মসলিন -১৯৬৫
২০.মক্কা শরীফে বাঙালি মাদরাসা-১৯৮৭
২১.ফতুহাত-ই-ফিরোজশাহী (ফিরোজশাহের আত্মজীবনী)-১৯৮৯
২২.চট্টগ্রামে ইসলাম
২৩.বাংলার সুফিসমাজ -১৯৮০
২৪.মোল্লা মিসকিন শাহ -১৯৮৭
২৫.Dacca Mughul Capital-1964
২৬.Catalogue of the Coins of Chittagong University Museum -1979
২৮.ঈসা খান মসনদ আলা -১৯৮০
২৯.রোসাঙ্গ বাংলা সাহিত্যে (আব্দুল করিম সাহিত্যেবিশারদের স্মারকবক্তৃতা -১৯৯৪
৩০.ইসলামের ইতিহাস(পশ্চিম এশিয়া,স্পেন ও উত্তর আফ্রিকা)-১৯৯৮
৩১.আলাওল(সাহিত্যেবিশারদের প্রবন্ধ)-২০০৩
যশস্বী পন্ডিত ও ইতিহাসবিদ ড.আব্দুল করিম বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, মাদরাসা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠায় ব্যাপক অবদান রাখেন। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৬৮ সালে হাটহাজারী ডিগ্রি কলেজ (বর্তমানে জাতীয়করণকৃত)প্রতিষ্ঠা করেন।
তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববতী অঞ্চলে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠা ছিলোনা। মানুষও তেমন শিক্ষিত ছিলোনা। বিশেষ করে তখন হাটহাজারী পশ্চাৎপদ এলাকা ছিলো। তাই তিনি কলেজ প্রতিষ্ঠা করার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।
একই সময় তিনি শিক্ষা ও অার্থ-সামাজিকভাবে অনুন্নত বাঁশখালীতে শিক্ষার আলোবর্তিকা জ্বালায়।
বাঁশখালী ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠায় তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। বাঁশখালী কলেজে উচ্চ শিক্ষা ও বিভাগ চালু ছিলো ড.আব্দুল করিমের অনন্য ভূমিকা।
১৯৯৫ সালে মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ২৬ মার্চকে স্মরণীয় করে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ। কলেজটি প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর পশ্চিম বাঁশখালীতে শিক্ষা- দীক্ষা ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। বিশেষ করে নারী শিক্ষার ক্ষেত্রে ড. আব্দুল করিমের হাতেগড়া এ বিদ্যানিকেতন ব্যাপক অবদান রেখে চলছে।
পশ্চিম বাঁশখালী উচ্চ বিদ্যালয়ও তাঁর হাতে গড়া। বাহারছড়া রত্নপুর উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায়ও তাঁর ভূমিকা রয়েছে।
চট্টগ্রাম ভেটোনারি কলেজকে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল এন্ড কলেজও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।
নিজগ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন মাদরাসা ও মসজিদ।
এছাড়াও তিনি বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠাতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকা রাখেন।
তিনি চট্টগ্রাম জাতীয় ঈদগা কমিটি, মা ও শিশু হাসপাতালের আজীবন সদস্য।
ইতিহাস গবেষণা, ইতিহাসচর্চা ও তাঁর অমরকীর্তির জন্য দেশ -বিদেশে পেয়েছেন নানা পুরুষ্কার, পদক, ফলোশীপ এবং সম্মাননা। তৎমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ-
১.ইন্ডিয়ান নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি কর্তৃক আকবর সিলভার মেডেল (বাংলার মুদ্রা সংক্রান্ত গবেষণার জন্য) -১৯৬০
২.গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সর্বােচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক “একুশে পদক “-১৯৯৫
৩.আই.এ.আর. এফ শান্তি পদক (জাতিসংঘের সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে “ইন্টারন্যাশনাল এসোসিয়েশন রিলিজিয়াস ফ্রিডম ” কর্তৃক) -১৯৯৫
ওয়ার্ল্ড সিটিজেনশীপ আইডেনটিটি কার্ড -১৯৯৫
৪.এ.এস.বি (এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ) এর সম্মানিত ফলো
৫.ওয়ার্ল্ড স্পিরিচ্যূয়াল ইউনিভার্সিটি অব নিউইয়ার্ক এর ভিজিটিং প্রফেসর (অনারারী)-১৯৯৫
৬.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এলামনাই উপলক্ষে এসোসিয়েশন কর্তৃক ৭৫ বছর সম্মানসূচক ক্রেস্ট প্রদান -১৯৯৬
৭.বাংলাদেশ জাতীয় জাদুগর কর্তৃক বিশেষ সম্মাননা -২০০০
৮.বায়তুশরফ কর্তৃক গুণীজন সংবর্ধনা ও পুরুষ্কার -২০০০
৯.বৃহত্তম চট্টগ্রাম উন্নয়ন সংগ্রাম সম্মিলন ও গুণীজন সংবর্ধনা-২০০০
১০.ড.এনামুল হক পদক -২০০০
১১.প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম সাহিত্যে একাডেমী পদক -২০০৩
১২.বাংলাদেশ ইতিহাস স্বর্ণ পদক -২০০৫
১৩.চট্টগ্রাম সমিতি,ঢাকা পদক-২০০৫
১৪.মনিরুজ্জমান ইসলামীবাদী গবেষণা পরিষদ স্বর্ণপদক-২০০৬
১৫.সাদত আলী আকন্দ পুরুষ্কার -২০০৭
১৬.ইসলামী একাডেমী কর্তৃক মরণোত্তর স্বর্ণপদক-২০১৪
১৭.চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ব্যাপক সংস্কার, অঅবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার ক্ষেত্রে বুনিয়াদি অবদান রাখার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃকপক্ষ ২০০১ সালে প্রফেসর ইমেরিটাস এবং সরকার কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেটের বিজ্ঞ সদস্য মনোনিত করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই সর্বপ্রথম প্রফেসর ইমেরিটাস।
বিজ্ঞ প্রফেসর ড.আব্দুল করিম দেশ -বিদেশে অনেক আন্তর্জাতিক সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন।
উপহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয়েছে।
যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফান্স, জার্মানি,ইরাক, ইরান, সৌদিআরব, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড,মিয়ানমারসহ বিভিন্ন দেশে অনুষ্ঠিত সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেন।
১৯৯০ সালে তিনি পবিত্র হজ্বব্রত পালন করেন।
প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ জ্ঞানসাধক ড.আব্দুল করিম ব্যক্তিগত জীবনে ছিলেন সহজ,সরল ও নিরাহংকারী।
তিনি অমায়িক, ধর্মপরায়ন, ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ছিলেন।
বাঁশখালীর কাদা মাটিতে তাঁর জন্ম। তিনি ছিলেন মাটির নরম, সহিষ্ণু আর উর্বর মেধার অধিকারী।
বাঁশখালীর পশ্চিমের বঙ্গোপসাগরের মতো তাঁর মনও ছিলো উদার।জ্ঞানের গভীরতাও অপরিমাপযোগ্য।
দেশপ্রেমিক ও দেশ প্রেমিক এ মানুষটি ছিলেন দেশ,মাটি ও মানুষের কল্যানকামী। পঞ্চান্ন বছরের অধ্যাপনা ও নানা গবেষণায় জাতিকে দিয়েছেন অনেক কিছু। সমস্ত জীবনজুড়ে পেয়েছেন জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল মত নির্বিশেষে সকল মানুষের অফুরান্ত শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।
দেশে বিদেশে হয়েছেন স্মরণীয় ও বরণীয়।
বিশ্ববরেণ্য জ্ঞানতাপস সবসম বলতেন, “ইতিহাস চর্চাই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছে”।জ্ঞানচর্চা ও সত্যোনুসন্ধান উৎঘটন করা ছিলো তাঁর আত্মার খোরাক।
এ মহান ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি মহান আল্লাহতালার ইচ্ছায় ২০০৭ সালের ২৪ জুলাই দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর ইনতেকাল করেন। তাঁর অন্তিম ইচ্ছানুযায়ী বার আউলিয়ার সর্দার হযরত শাহসুফি গরীবুল্লাহ শাহ( র:) এর পবিত্র মাজারের পাশে সমাহিত করা হয়।
আজ ২৪ জুলাই। তাঁর ১৮
তম মৃত্যুবার্ষিকী।
এ মহান জ্ঞানসাধকের আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।
মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাতের সর্বোচ্চ মকামে অধিষ্ঠিত করুন।
প্রচারবিমুখ এ গুণী সাধক আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর বনার্ঢ্য কর্ম ও কীর্তির মধ্যে বেঁচে থাকবেন যুগযুগান্তরে।
দৃঢ় বিশ্বাস করি, তাঁর ক্ষুরধার লেখনি ও গবেষণাকর্মের উপর গবেষণা করে পন্ডিিতগণ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করবে। জ্ঞানপিপাসু ও আগামী প্রজন্ম তাঁর সৃষ্টিকর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী হবে।
বরেণ্য এ শিক্ষাবিদ ও প্রথিতযশা ইতিহাসবিদ ড.আবদুল করিমের
মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁর প্রতি রইল
গভীর শ্রদ্ধা ও অজস্র ভালোবাসা।
লেখকঃ মোঃ নেজাম উদ্দিন সাগর
প্রভাষক,ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ
পশ্চিম বাঁশখালী উপকূলীয় ডিগ্রি কলেজ
বাঁশখালী, চট্টগ্রাম
মোবাইলঃ ০১৮২৪-৬০৩২৪০
তারিখঃ ২৪ জুলাই ২০২৫