০৬:৫৮ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫, ১৪ আষাঢ় ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
বিশেষ প্রতিনিধি:

আমি কবিতা দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ করি : আত্মরাষ্ট্রীয় কাব্যচেতনার ঘোষণা — মু. নজরুল ইসলাম তামিজী

  • প্রকাশিত ০৭:০৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫
  • ৬১ বার দেখা হয়েছে

আমি যখন কবিতা লিখি, তখন কেবল ভাষা খুঁজি না, খুঁজি এক নিজস্ব ভূখণ্ড, এক কাব্যিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
আমার কবিতা উচ্চারণ নয়, বরং আত্ম-ঘোষণা। আমি বিশ্বাস করি, একজন মানুষ নিজের মধ্যেই একটি রাষ্ট্র—
যেখানে প্রেম নাগরিক অধিকার, বিচ্ছেদ আইন, এবং ঈশ্বর নিঃশব্দ প্রশাসন।

এই উপলব্ধি থেকেই আমার কাব্যরীতি—“আত্মরাষ্ট্রীয় কাব্য ধারা” (তামিজী স্যার কাব্যধারা নামে বহুল প্রচলিত)। এটি কেবল একটি রচনাশৈলী নয়, বরং এক আত্মরাষ্ট্রীয় কাব্যতত্ত্ব (Poetics of Personal Sovereignty), যেখানে ভাষা, প্রেম, প্রযুক্তি, স্রষ্টা ও রাষ্ট্রের সঙ্গে কবির সম্পর্ক পুরনো নিয়ম ভেঙে নতুন ব্যাকরণে গড়ে ওঠে।

কাব্যিক রাষ্ট্রবোধ : প্রেম, স্রষ্টা ও ডিজিটাল নাগরিকতা—

আমার কবিতায় প্রেম কেবল আবেগের সমাহার নয়—এটি একটি রাজনৈতিক সম্পর্ক।
আমি যখন লিখি—

“তুমি চলে গেলে—
রাষ্ট্র এল, মামলা দিল,
ঈশ্বরও নীরব থাকলেন”
— তখন প্রেম এক নাগরিক সঙ্কট, বিচ্ছেদ একটি আইনগত বাস্তবতা।

এখানে ঈশ্বর নেই ধর্মের আশ্রয়ে, সেই না-থাকা যেন সর্বশক্তির এক প্রকার প্রতিস্থাপন।

“তুমি থাকো বা না থাকো,
আমি তবু তোমার শূন্যতার দিকে কাঁদি”

প্রযুক্তি আমার প্রতীক, আত্মা আমার মুদ্রা—

আমার সময়—আমার কবিতা—উভয়ই ঘটছে স্ক্রিনে, ক্লাউডে, টাইমলাইনে। তাই আমি লিখি :

“ভালোবাসা এখন
ফেসবুক লাইকের মতো ক্ষণস্থায়ী—
‘Seen’ লেখা উঠলেই
হৃদয়টা নেমে যায়
ব্রেকআপের বেসমেন্টে।”

এই Seen বা Screenshot কেবল শব্দ নয়, এগুলো নতুন যুগের প্রতীকতন্ত্র।
যেভাবে প্রাচীন কবিরা “নদী”, “পাখি” বা “জ্যোৎস্না” ব্যবহার করেছেন, আমি ব্যবহার করি “Typing…”, “Inbox”, “Delete History”।

বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে—

আমার এই কবিতা দর্শন বিচ্ছিন্ন নয়। এটি দাঁড়ায় বিশ্বকবিতার একটি বিশেষ ধারার প্রান্তসীমায়। তুলনামূলকভাবে দেখলে:

১. চার্লস বুকাওস্কি (Charles Bukowski)—

তিনি আমেরিকার গ্রাফিতিময় নগর বাস্তবতাকে কবিতায় এনেছিলেন—নোংরা, রুক্ষ, তবু সত্য।
আমি যেমন লিখি :

“তুমি reply দাওনি দুই ঘণ্টা
অথচ আমার হৃদয়ে
আলার্ম বাজে প্রতি মিনিটে।”
তেমনি বুকাওস্কি বলেন—
“I wanted the whole world or nothing.”

আমরা উভয়ে ব্যক্তিগত চাহিদা দিয়েই রাজনৈতিক অর্থ তৈরি করি।

২. রেইনার মারিয়া রিলকে (Rilke)—

রিলকে ঈশ্বরের মৌনতায় ভয় পান, আমি ঈশ্বরের মৌনতায় প্রতিবাদ করি।
রিলকে বলেন—

“God speaks to each of us as he makes us.”
আর আমি লিখি—
“ঈশ্বর কিছু বলেন না,
শুধু নীরবতার জবাব ফেরত পাঠান।”

রিলকে অস্তিত্বের মর্ম খোঁজেন সৌন্দর্যে, আমি খুঁজি ডিজিটাল শূন্যতার পোস্টমডার্ন শোকে।

৩. মহম্মদ সোলায়মান (Mahmoud Darwish)—
দারউইশ নিজের কবিতায় একটি রাষ্ট্রহীন আত্মার স্বর গড়ে তুলেছিলেন।
তাঁর লেখা :
“I come from there and I have memories.”
আমিও লিখি:

“আমি এখন রাষ্ট্র হতে চাই,
যেখানে ভালোবাসা হবে নাগরিক অধিকার,
আর বিচ্ছেদ হবে ফৌজদারি মামলা।”

আমার কবিতায় ‘ভূখণ্ড’ নেই, কিন্তু আছে আত্মরাষ্ট্রের সংবিধান।

৪. লেনারদ কোহেন (Leonard Cohen)—

লেনারদ বলেন,

“There is a crack in everything, that’s how the light gets in.”
আমার উত্তর—
“আমার কবিতার ছন্দেই ফাটল থাকে,
যেন সেখানে রাষ্ট্রের আলো ঢুকতে না পারে।”

আমার ভাঙনচর্চা উদ্দেশ্যহীন নয়—তা কবিতা দিয়ে ব্যক্তি-রক্ষা আইন নির্মাণের এক প্রচেষ্টা।

বাংলা সাহিত্যে এই চেতনার ব্যতিক্রম—

বাংলা কবিতায় এভাবে ব্যক্তিকে রাষ্ট্র বানিয়ে কবিতা লেখার প্রচলন বিরল।
রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে পূর্ণতায় খুঁজেছেন,
জীবনানন্দ সময়চ্যুতি ও স্মৃতিতে,
শক্তি প্রেমের উদ্বেলতায়,
আর নির্মলেন্দু গুণ রাজনৈতিক প্রতিবাদে।

আমি দাঁড়াই ভিন্ন এক ভূগোলে—
আমি একাকী, সংযুক্ত, প্রযুক্তিসম্পৃক্ত।
আমি প্রশ্ন করি—“রাষ্ট্র কি কবিতার বিষয় নয়?”
আমি বলি—“কবিতাই আমার রাষ্ট্র।”

আমি শুধুমাত্র কবি নই, একজন রাষ্ট্রনাগরিক—

এই কাব্যতত্ত্বের কেন্দ্র আমি নই—কেন্দ্র হলো সেই ব্যক্তি, যে আজ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, প্রযুক্তিতে বন্দী, স্রষ্টা থেকে বিভ্রান্ত, রাষ্ট্রের কাছে অনাহূত।
আমি তাঁর পক্ষেই কবিতা লিখি। আমি তাঁকেই কবিতার সংবিধানে স্বীকৃতি দিই।

“আমার কবিতা হাইকোর্ট নয়—
এটি একটি ইউনিয়ন পরিষদ,
যেখানে প্রেমিকেরা হাজিরা দেয়,
বিচ্ছেদ হয়,
এবং ঈশ্বর মৌন থেকে যান।”

Tag :
জনপ্রিয়

নাঙ্গলকোটের বক্সগঞ্জে জামায়াতের ইসলামী’র কর্মী সম্মেলন অনুষ্ঠিত

বিশেষ প্রতিনিধি:

আমি কবিতা দিয়ে রাষ্ট্র নির্মাণ করি : আত্মরাষ্ট্রীয় কাব্যচেতনার ঘোষণা — মু. নজরুল ইসলাম তামিজী

প্রকাশিত ০৭:০৩:৪৩ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৮ জুন ২০২৫

আমি যখন কবিতা লিখি, তখন কেবল ভাষা খুঁজি না, খুঁজি এক নিজস্ব ভূখণ্ড, এক কাব্যিক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।
আমার কবিতা উচ্চারণ নয়, বরং আত্ম-ঘোষণা। আমি বিশ্বাস করি, একজন মানুষ নিজের মধ্যেই একটি রাষ্ট্র—
যেখানে প্রেম নাগরিক অধিকার, বিচ্ছেদ আইন, এবং ঈশ্বর নিঃশব্দ প্রশাসন।

এই উপলব্ধি থেকেই আমার কাব্যরীতি—“আত্মরাষ্ট্রীয় কাব্য ধারা” (তামিজী স্যার কাব্যধারা নামে বহুল প্রচলিত)। এটি কেবল একটি রচনাশৈলী নয়, বরং এক আত্মরাষ্ট্রীয় কাব্যতত্ত্ব (Poetics of Personal Sovereignty), যেখানে ভাষা, প্রেম, প্রযুক্তি, স্রষ্টা ও রাষ্ট্রের সঙ্গে কবির সম্পর্ক পুরনো নিয়ম ভেঙে নতুন ব্যাকরণে গড়ে ওঠে।

কাব্যিক রাষ্ট্রবোধ : প্রেম, স্রষ্টা ও ডিজিটাল নাগরিকতা—

আমার কবিতায় প্রেম কেবল আবেগের সমাহার নয়—এটি একটি রাজনৈতিক সম্পর্ক।
আমি যখন লিখি—

“তুমি চলে গেলে—
রাষ্ট্র এল, মামলা দিল,
ঈশ্বরও নীরব থাকলেন”
— তখন প্রেম এক নাগরিক সঙ্কট, বিচ্ছেদ একটি আইনগত বাস্তবতা।

এখানে ঈশ্বর নেই ধর্মের আশ্রয়ে, সেই না-থাকা যেন সর্বশক্তির এক প্রকার প্রতিস্থাপন।

“তুমি থাকো বা না থাকো,
আমি তবু তোমার শূন্যতার দিকে কাঁদি”

প্রযুক্তি আমার প্রতীক, আত্মা আমার মুদ্রা—

আমার সময়—আমার কবিতা—উভয়ই ঘটছে স্ক্রিনে, ক্লাউডে, টাইমলাইনে। তাই আমি লিখি :

“ভালোবাসা এখন
ফেসবুক লাইকের মতো ক্ষণস্থায়ী—
‘Seen’ লেখা উঠলেই
হৃদয়টা নেমে যায়
ব্রেকআপের বেসমেন্টে।”

এই Seen বা Screenshot কেবল শব্দ নয়, এগুলো নতুন যুগের প্রতীকতন্ত্র।
যেভাবে প্রাচীন কবিরা “নদী”, “পাখি” বা “জ্যোৎস্না” ব্যবহার করেছেন, আমি ব্যবহার করি “Typing…”, “Inbox”, “Delete History”।

বিশ্বকবিতার পরিপ্রেক্ষিতে—

আমার এই কবিতা দর্শন বিচ্ছিন্ন নয়। এটি দাঁড়ায় বিশ্বকবিতার একটি বিশেষ ধারার প্রান্তসীমায়। তুলনামূলকভাবে দেখলে:

১. চার্লস বুকাওস্কি (Charles Bukowski)—

তিনি আমেরিকার গ্রাফিতিময় নগর বাস্তবতাকে কবিতায় এনেছিলেন—নোংরা, রুক্ষ, তবু সত্য।
আমি যেমন লিখি :

“তুমি reply দাওনি দুই ঘণ্টা
অথচ আমার হৃদয়ে
আলার্ম বাজে প্রতি মিনিটে।”
তেমনি বুকাওস্কি বলেন—
“I wanted the whole world or nothing.”

আমরা উভয়ে ব্যক্তিগত চাহিদা দিয়েই রাজনৈতিক অর্থ তৈরি করি।

২. রেইনার মারিয়া রিলকে (Rilke)—

রিলকে ঈশ্বরের মৌনতায় ভয় পান, আমি ঈশ্বরের মৌনতায় প্রতিবাদ করি।
রিলকে বলেন—

“God speaks to each of us as he makes us.”
আর আমি লিখি—
“ঈশ্বর কিছু বলেন না,
শুধু নীরবতার জবাব ফেরত পাঠান।”

রিলকে অস্তিত্বের মর্ম খোঁজেন সৌন্দর্যে, আমি খুঁজি ডিজিটাল শূন্যতার পোস্টমডার্ন শোকে।

৩. মহম্মদ সোলায়মান (Mahmoud Darwish)—
দারউইশ নিজের কবিতায় একটি রাষ্ট্রহীন আত্মার স্বর গড়ে তুলেছিলেন।
তাঁর লেখা :
“I come from there and I have memories.”
আমিও লিখি:

“আমি এখন রাষ্ট্র হতে চাই,
যেখানে ভালোবাসা হবে নাগরিক অধিকার,
আর বিচ্ছেদ হবে ফৌজদারি মামলা।”

আমার কবিতায় ‘ভূখণ্ড’ নেই, কিন্তু আছে আত্মরাষ্ট্রের সংবিধান।

৪. লেনারদ কোহেন (Leonard Cohen)—

লেনারদ বলেন,

“There is a crack in everything, that’s how the light gets in.”
আমার উত্তর—
“আমার কবিতার ছন্দেই ফাটল থাকে,
যেন সেখানে রাষ্ট্রের আলো ঢুকতে না পারে।”

আমার ভাঙনচর্চা উদ্দেশ্যহীন নয়—তা কবিতা দিয়ে ব্যক্তি-রক্ষা আইন নির্মাণের এক প্রচেষ্টা।

বাংলা সাহিত্যে এই চেতনার ব্যতিক্রম—

বাংলা কবিতায় এভাবে ব্যক্তিকে রাষ্ট্র বানিয়ে কবিতা লেখার প্রচলন বিরল।
রবীন্দ্রনাথ ঈশ্বরকে পূর্ণতায় খুঁজেছেন,
জীবনানন্দ সময়চ্যুতি ও স্মৃতিতে,
শক্তি প্রেমের উদ্বেলতায়,
আর নির্মলেন্দু গুণ রাজনৈতিক প্রতিবাদে।

আমি দাঁড়াই ভিন্ন এক ভূগোলে—
আমি একাকী, সংযুক্ত, প্রযুক্তিসম্পৃক্ত।
আমি প্রশ্ন করি—“রাষ্ট্র কি কবিতার বিষয় নয়?”
আমি বলি—“কবিতাই আমার রাষ্ট্র।”

আমি শুধুমাত্র কবি নই, একজন রাষ্ট্রনাগরিক—

এই কাব্যতত্ত্বের কেন্দ্র আমি নই—কেন্দ্র হলো সেই ব্যক্তি, যে আজ সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন, প্রযুক্তিতে বন্দী, স্রষ্টা থেকে বিভ্রান্ত, রাষ্ট্রের কাছে অনাহূত।
আমি তাঁর পক্ষেই কবিতা লিখি। আমি তাঁকেই কবিতার সংবিধানে স্বীকৃতি দিই।

“আমার কবিতা হাইকোর্ট নয়—
এটি একটি ইউনিয়ন পরিষদ,
যেখানে প্রেমিকেরা হাজিরা দেয়,
বিচ্ছেদ হয়,
এবং ঈশ্বর মৌন থেকে যান।”